প্রবীণ গল্প

এখনও সে-সব দিন ক্লান্ত হয়ে বেঁচে আছে পৃথিবীতে
তবুও প্রবীণ গল্প শোনো এক- হয়তো চীনের-
হয়তো মালাক্কা- জাভা- তিব্বত- উরের
কিংবা টালি- বালিগঞ্জে ফুটপাতে আজও
ভিখিরিনিদের পিতা সেই কথা জানে।
কেননা এ গল্প নয়- আমার নিজের অভিজ্ঞতা
অতএব পৃথিবীর সর্বসাধারণ-
স্বেচ্ছায় দেয়াল ঘেঁষে নির্জন মোমের
আলোকের রঙে ক্লান্ত তুলট পাতায়
ঝুঁকে যেতে পারে-
অদ্ভুত গল্পকে এক কীর্ণ হতে দেখে
তার পর পৃথিবীর রৌদ্রের আলোয় ফিরে গিয়ে
ঘড়ি ধ’রে একটি ঘণ্টা তারা ভ্রূণ হতে পারে
হেসে- কেঁদে- পরস্পরের পেটে- পুরুষের পেটে
অন্তঃসত্ত্বা রমণীর মতন নিটোল
হৃদয়াবেগের গোল বেলুনকে দেখে।

দু’-চার লাইনের গল্প এই:
প্রত্যহ শীতের রাতে দুইটি কুকুর
কেবলই ধূসর মাটি খুঁড়ে যেত আমার উঠানে
মাটির প্রবীণ মাংস গায়ে মেখে সারা-রাত
হয়তো শীতকে তারা এড়ায়েছে ভেবে
শীতকে এড়ায়ে যেত; তবু রোজ ভোরে
তাদের অদ্ভুত ধূসর দেহ দেখে
পুকুরের পাড় থেকে মুখ তুলে মাছরাঙা দু’টো
চেরা চ্যাঁচারির শব্দে হেসে উড়ে যেত।
গম্ভীর বিড়াল- রাত্রে- ডেকে গেছে পেঁচা’র উদ্দেশে:
কী ক’রে এ-জন্তুদের তুমি
মানুষের মতো কিছু আত্মচিন্তা দেবে?
ধোপার প্রাচীন গাধা বলেছে আস্ফোটে:
কী ক’রে-বা সারমেয়দের
মানুষের মতো ক’রে তোলা যায়? পাখিরাও শীতে
খড়-কুটো শনের ভিতরে শুয়ে সমীচীন।
শীতের কাপড় তাই দেয়া গেল কুকুর দু’টোকে
ঘরের ভিতরে স্থান দেয়া গেল
আমাকে নির্জন দেখে তাহাদের চেঁচাবার ক্ষোভ
নিভে গেল ক্রমে-ক্রমে- বেশি রাত হলে
মানুষের মতন নিয়মে কফি- চায়ের আরক- চিনি-
সবিশেষ ভাবে চিনি খেয়ে যেত আসল ঘুমের
বড়ো অন্ধকারে।

ঘুমের ভিতরে স্বপ্নে এক দিন তারা
নিরবয়ব ধূর্ত কফির পেয়ালা ভেঙেছিল
সে-সব টুকরোগুলো খুঁজেছিল ভোরবেলা
স্বাভাবিক গৃহিণীর মতো মর্যাদায়
কোথাও ফ্রয়েড তবু আমার টেবিলে আছে ব’লে
অথবা ফ্রয়েড আমি মনের ভিতরে
লুফে গেছি জেনে তারা স্বপ্নের সম্পূর্ণ মানে বুঝে
উদাসীন হয়ে গেল অত্যধিক জ্ঞানীর মতন
হেঁয়ালির ঊর্ধ্বে উঠে- নিবিড় নিবিড় কুকুর দু’টো।

আমাদের সকলের চেয়ে বেশি ক্ৰমেলক-প্রাংশু হয়ে গেল
নিসর্গের চেয়ে ঢের সমীচীন হয়ে
অনেক নতুন বই লিখে গেল তারা
যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্র এক তিসি’র ভিতরে
দুইটি কুকুর ক্রমে মানুষের তীক্ষ্ণ ইতিহাস
নীরবে খসাতে গিয়ে টের পেল- আধুনিক কাল
একটি ত্রিভুজ যেন- ত্রিভুজের চূড়া
ভবিষ্যৎ অতীতের প্রক্ষিপ্ত বাহুর ‘পরে দাঁড়ায়েছে
অথবা ভিত্তির ‘পরে- কেননা তাদের বাহু নেই।
কিংবা প্রতিজ্ঞার ‘পরে- কেননা অতীত ভিত্তিহীন-
দাঁড়ায়ে রয়েছে ব’লে কোটি সারমেয়
এত দিন পরে পূর্ণ বিচারের মানদণ্ড পেল
তাদের সবের দৈর্ঘ্য প্রস্থ মুখ যমজের মতো
সকলের হাতে টিন- জয়- হাসি- বিবাহ- টিকেট
সমান মাপের সব- সকলেই সস্মিত ঘরণী
জীবনের; ঝড়ের দুপুরে তবু এক দিন তারা
এমন প্রমত্ত হয়ে ত্রিভুজকে নীল গোলাকার
ক’রে দিতে গেল যাতে নিসর্গ নিজেই
তাহাদের দু’ জনকে কেড়ে নিয়ে উপরে আকাশে
অনেক ধুলোর সাথে তুলে নিয়ে গেল।
অগণ্য কুকুর সেই মধ্যশূন্যে বহুল মাটির বীজ পেয়ে
আশাতিরিক্ত সুখে সম্মুখের দুই পা বাড়ায়ে দিয়ে কুকুরের মতো
খুঁড়ে গেল মত্ততায়- যেন কোনও জ্যাম সাইকেলে
প্যাডেল চলেছে ঘুরে বিদ্যুতের মতো ক্ষিপ্র বেগে
তবুও সকলই ছায়া- ছবি- স্থাণু- যদিও মানুষ তারা- তবু
জন্মেছিল এক দিন সরমার পরিমিত পেটে।