প্রত্যাবর্তন

চীনের সম্রাট যেন আমাকে হুকুম দিল বায়ুর ভিতর থেকে এসে
“এখন এমন ছবি এঁকে দাও আমার দেয়ালে
যাতে আমি গাঢ় নক্ষত্রের থেকে এই মূর্খ পৃথিবীতে
পুনরায় নেমে এসে- এই প্রত্যাবর্তনের মূলে
তোমাদের সকলের অগোচর ক্লান্ত অভিশাপ
রয়ে গেছে- তবুও নির্দেশ আছে পৃথিবীতে গিয়ে
স্থাণুর মতন আমি স্থির হয়ে ব’সে থেকে যদি
পুনরায় ব’সে থাকি- তা হলে শরীর
শান্তি পাবে- হৃদয় সকল প্রজ্ঞা মোমের আলোর মতো ধীরে
নিজের উদর নিজে গ্রাস ক’রে- দ্বিতীয় মৃত্যুতে
আবার বিলীন হয়ে জ্ব’লে যাবে- সরমা, নক্ষত্রে
অথবা যেখানে বুদ্ধ- নাগার্জুন- ফাহিয়ান- রোডামান্থাস কেউ নেই
তবুও এখন এই পৃথিবীতে কী ক’রে মানুষ
স্থির হয়ে ব’সে থাকে- বই পড়ে- প্রেমের উন্মীল
চিন্তা করে? অথবা কী ক’রে আমি অকৃত্রিম সাঙ্কেতিকতায়
সমস্ত মঙ্গোল চীনে- পৃথিবীতে- সাড়ে-তিন হাত দীর্ঘ খাট
মশারি, টেবিল, গ্রন্থ, পরমাত্মা প্রণয়ের জন্ম দিতে পারি?
এ-সব বিষয় নিয়ে বিবেচক বেলুনের মতো
অনেক ভেবেছি আমি বায়ুর ভিতরে উড়ে
হাজার বছর আগে মৃত মানুষের
কোথায় রয়েছে দায় পৃথিবীতে? কোথায় এঁটিলি আছে নীল
অবয়বহীন- বড়ো- উপরের আলোর ভিতরে
তবুও প্রভুর ঘরে ক্রীতদাস- মূঢ় কুকুরের মতো বেগে
আবার এসেছি ফিরে- সততই পৃথিবীর থেকে
অসংখ্য ধুলোর বীজ আকাশের বহু ঊর্ধ্বে- সরমার দিকে
উড়ে যায়- কী ক’রে তা হলে মূল চীনে-মাটি রঙের কুকুর
শান্তি পাবে- রূপান্তর পেয়ে যাবে জননীর প্রাঙ্গণেও
যদিও অত্যল্প ধুলো সেখানে প্রবেশ পায়- তবু
কুকুর তবুও তার নিজের নিয়মে তাকে মৃত্তিকার স্তর
মনে করে- রুধিরের সংস্কারে দুই পা বাড়ায়ে
আমিও খুঁড়েছি সেই বাতাসকে (শীত-রাতে) কুকুরের কালো কেনেলের
মাটি ভেবে- অনন্ত মাইলের পথ অন্ধকারে খুঁড়ে
এখানে এসেছি আমি- অয়নরেখার সাথে বিস্তৃত লেজুড়
বেঁধে নিয়ে অনুভব ক’রে গেছি আহ্নিক গতির সাথে ঘুরে
প্রাক্তন কুকুরগুলো এইখানে এখন মানুষ
হয়ে গেছে- বিষুবক্রান্তির রাতে এখন কুকুর:
হেরম্ব, সজনী, হারু;- জলের তরঙ্গ যেন জলের ভিতরে
বল্লমের মতো বেগে চ’লে যায়- নদীর কিনারে
উদ্ভিদ জল্পনা করে অই বিম্ব নৃমুণ্ডের মতো
আর অই প্রতিবিম্ব: বাঘা, ভুলো, পাট, পিকিনিজ
সর্বদা অদ্ভুত শব্দ জলের ভিতরে
বেজে ওঠে- জানি- তবু- সফল, সমূহ জল দেখে
পিপাসা গভীর হয়ে গেলে তাকে জলের কুহক
অধিক গভীরতর ক’রে দেয়-
চেয়ে দেখি পৃথিবীর উৎসাহী, শৌণ্ডিক, সুধী, জালার মতন
অনেক গ্যালন জল পেটে রেখে বিশুদ্ধ সমাজ;-
আকর্ণ তৃষ্ণায় এই জল খেতে এসে তবু- চুপে
ভয় পেয়ে স’রে যায়- বিম্বের ভিতর
প্রমত্ত কুকুরদের মুখ দেখে ফেলে।
আমিও কুকুর- তাই নরকপালের ছবি দেখি।

হাজার-হাজার সম্বৎসর ধ’রে আমাদের গোল পৃথিবীতে
সর্বদা অগস্ত্য আছে- তবুও জলের বিন্দু নেই
সর্বদাই জলে আছে- তবুও পিপাসা
নেই কারু। জলের প্লাবনে ভিজে ভোট হয়ে তবুও মানুষ
গোবির বালির মতো শুষ্ক হয়ে আছে সততই।”

কোনও এক মৃত মনীষীর হিম পিঙ্গল দেয়ালে
তাহার চিতার থেকে দু’-একটা কঠিন অঙ্গার
তুলে নিয়ে নির্জন হেমন্ত-রাতে আমি
হাজার বছর আগে লুপ্ত এক চীন-সম্রাটের
মাথার বিহ্বল ছবি এঁকে ফেলে- তার পর টুপি
এঁকে টেনে দিতে গিয়ে- দেখি অকৃত্রিম সময়ের দোষে
সেই মুণ্ড প্রাণ পেয়ে এই সব কথা ব’লে গেল।