পুনরায় এক দিন

পুনরায় এক দিন- হেমন্তের বেলা প্রায় শেষ হয়ে গেলে
যখন মাঠের থেকে ফিরে যাই দু’-একটা ধূম্র মাইলস্টোন
পিছে ফেলে- রেলওয়ে-লাইন- কালভার্ট
ঢের দূরে- ডান পাশে ছেড়ে দিয়ে আমি
তবুও বেপথুমান হয়ে কদাচিৎ
দু’-একটি মসৃণ টেলিগ্রাফ-পোস্ট কবলিত ক’রে নিয়ে
তাদের বুকের ‘পরে কান পেতে বাতাসের শব্দের মতন
নগর-নগরান্তরে উপ্ত সব ব্যস্ত মানুষের
অন্ধকার ধ্বনি শুনি- সূর্যের তির্যক ঠান্ডা আলো
অমৃত মিশ্রের সাদা মাথাটাকে অনায়াসে ঘিরে
জালের ভিতরে যেন- (কোনও এক) স্বচ্ছ নিৰ্ঝরের
ছবির মাছের মতো ধ’রে আছে- মনে হল যেন
সবই ছবি- দেখা দিল হেমন্তের দিন প্রায় শেষ হয়ে গেলে
ঈষৎ অপরিচিত অন্য এক মাঠের ভিতরে।
আমি সেই মানুষের দিকে চুপে অগ্রসর হয়ে
দাঁড়াতেই আগন্তুকের দুষ্ট আমিষের মতো গন্ধ পেয়ে
অথবা আমার দীর্ঘ ছায়া দেখে- ধীরে
মাংসপেশির ক্লেশে ব্যথা পেয়ে বিগলিত কোনও শকুনের
রাজশকুনের মতো তার আজকের অধম মাথাকে
ধীরে-ধীরে উঠাল সে- আমার শরীর দেখে নিতে।
এইটুকু কঠিন ব্যায়াম
এখন কঠিনতম তার কাছে- তবুও এমনই দৃঢ়তর
মানুষের মন তার প্রতিকূল বিষয়ীর চেয়ে
আবার সে মাথা ভেঙে- হেঁট ক’রে- তেমন নীরবে
খুরপি চালাতে গিয়ে হাতিশুঁড়া- ঘেঁটুবন- শেয়ালকাঁটা’র
জারকের রসে ব’সে হেমন্তের নিড়োবার কাজ
ক’রে গেল- আমাকে সে চিনেছিল হয়তো-বা।

অথবা সে ভুলে গেছে- অথবা মানুষ কোন কাজের ধ্বনির
উপেক্ষিত মানুষের কাছে এসে পরিবাদী মেঘের মতন
কথার ডিণ্ডিম শুধু- পুনরুক্তি- রোল-
জিহ্বায় লুকায়ে রেখে অশ্রান্ত শব্দের অবয়ব
আত্মায় বহন করে- কেবলই কথার লোভে ফেঁপে?-
এই ভেবে চুপ ক’রে রয়ে গেল-
এই সব অবিচার (হয়তো-বা) মানুষের প্রতি
কেননা সে এ-জীবনে অধিক বিচিত্রতর কোনও অন্তঃসার
পায় নাই- ঢের দিন আগে তুচ্ছ বাড়ি
ক্রোক হয়ে উড়ে গেছে কড়কানো নুলো বিড়ালের
বিবর্ণ আঁশের মতো নিয়তির নির্ঘণ্টের দিকে
কোনও এক সহৃদয় মুসলমান এসে
নিকা ক’রে নিয়ে গেছে গৃহিণীকে- ক্ষিতিজ রেখার
অই পারে- কোথাও পাটের জোরে তারা সব আজ
সুবেদার- অথবা সে ছিঁড়ে গেছে- ফেঁড়ে গেছে- পৃথিবীর পথে
মরে নি- তবুও তার মৃত্যু হয়ে গেলে
বুড়ো কিছু শোক পাবে- (অদ্ভুত ভাঁড়ের টুপি এঁটে
বিদূষক শোক এসে খোঁচা দেয় কোনও-কোনও নির্জন প্রাণীকে)
ভয়াবহ ভাবে একা হয়ে যাবে- মৃত্যু হলে আপনার মরণের আগে
ভয়াবহ একা হবে

সন্তানেরা অন্ধকার রাতে ভিজে স্পর্শাতুর সাপের মতন
প’ড়ে থাকে বিড়ে বেঁধে- তবুও স্পর্শের বস্তু নয়
দিনের আলোয় তারা অমৃত মিশ্রের
কেউ- কিছু নয়- তবু- কোথাও তাদের হাওয়া কোনও দিন কেউ
পায় না ক’- কেননা তাহারা সব ক’রে খায়- যে যাহার তরে
ক’রে খেতে গিয়ে তারা সমীচীন সময়ের হাতে
মার খেয়ে প’ড়ে আছে নানা-দিকে- তাদের সমাধি
কালের চাকায় চ’লে কবরের মতো জেগে উঠে
মুমূর্ষু পিতার জন্য শ্মশানের থেকে
ঢের দূরে- স্বতঃসিদ্ধতায় সব দাঁড়ায়ে রয়েছে
তা হলে মৃত্যুর দেশও এ-রকম- সেখানেও জল
চলে না ক’ পরস্পরের হাত থেকে হস্তান্তরে
হৃদয় সেখানে কোনও নদী নয়।

স্বপ্নের ফিরিস্তি শুধু এই সব বুড়োর মাথায়।
এ-সব দুঃস্বপ্ন তবু। ঠিক নয়। সন্তানেরা তার
লাঠিয়াল- যে যার ঘাঁটিতে ব’সে- যে-কে-সে’র শিষে
দিনের আলোয় তারা লাফ দেয়- বলের মতন
সমুদ্র ডিঙোতে গিয়ে তার পর সুরমা’র মুখে
নিভে গেছে- কেননা লেমুর তারা- হনুমান নয়
ম’রে গেছে একে-একে।- নগরীর ভোটের ব্যালটে
না হলে ছয়টি ভোট পাওয়া যেত- আজ তবু হেমন্তের পথে
চাঙড়ের মতো এই তাহাদের নিস্তেজ পিতার
লেঠেলের প্রয়োজন ছিল কিছু- হাতার ভিতরে
আমাকে লাঠিয়ে দিত অন্তত- তবুও শকুন
আপন ক্ষমতা বুঝে ন্যূব্জ হয়ে খানিক দাঁড়াল
অবশ কাস্তে হাতে- আমাদের দু’ জনার বিজল শরীরে
মাংসের ন্যক্কার ছাড়া কিছু নেই জেনে
বিশ্বাসীর মতো চোখ বুজে নিয়ে সে তার নরকে
চ’লে গেল- আমি কিছু অবান্তর জোর পেয়ে তবু
গ্যাসের আলোর ভিড়ে- মনে হল বৈকুণ্ঠের পানে
স্বতই যেতেছি উঠে- উইকএন্ড টিকিটের জোরে।