পিরামিড

-বেলা ব’য়ে যায়!
গোধূলির মেঘ-সীমানায়
ধূম্র মৌন সাঁঝে
নিত্য নব দিবসের মৃত্যু-ঘণ্টা বাজে!
শতাব্দীর শবদেহে শ্মশানের ভষ্মবহ্নি জ্বলে!
পান্থ ম্লান চিতার কবলে
একে-একে ডুবে যায় দেশ, জাতি, সংসার, সমাজ,
কার লাগি, হে সমাধি, তুমি একা ব’সে আছ আজ?
কী এক বিক্ষুব্ধ প্রেতকায়ার মতন!
অতীতের শোভাযাত্রা কোথায় কখন
চকিতে মিলায়ে গেছে পাও নাই টের!
কোন্ দিবা-অবসানে গৌরবের লক্ষ মুসাফের
দেউটি নিভায়ে গেছে- চ’লে গেছে দেউল ত্যজিয়া,
চ’লে গেছে প্রিয়তম- চ’লে গেছে প্রিয়া!
যুগান্তের মণিময় গেহবাস ছাড়ি
চকিতে চলিয়া গেছে বাসনা-পসারী
কবে কোন্ বেলাশেষে, হায়
দূর অস্তশেখরের গায়!
তোমারে যায় নি তারা শেষ অভিনন্দনের অর্ঘ্য সমর্পিয়া;
সাঁজের নীহারনীল সমুদ্র মথিয়া
মরমে পশে নি তব তাহাদের বিদায়ের বাণী!
তোরণে আসে নি তব লক্ষ-লক্ষ মরণ-সন্ধানী
অশ্রু-ছলছল চোখে, পাণ্ডুর বদনে!
-কৃষ্ণ যবনিকা কবে ফেলে তারা গেল দূর দ্বারে বাতায়নে
জানো নাই তুমি!
জানে না তো মিশরের মূক মরুভূমি
তাদের সন্ধান!
হে নির্বাক পিরামিড, অতীতের স্তব্ধ প্রেত-প্রাণ
অবিচল স্মৃতির মন্দির!
আকাশের পানে চেয়ে আজও তুমি ব’সে আছ স্থির!
নিষ্পলক যুগ্মভুরু তুলে
চেয়ে আছ অনাগত উদধির কূলে
মেঘ-রক্ত ময়ূখের পানে!
জ্বলিয়া যেতেছে নিত্য নিশি-অবসানে
নূতন ভাস্কর!
বেজে ওঠে অনাহত মেম্ননের স্বর
নবোদিত অরুণের সনে
কোন্ আশা-দুরাশার ক্ষণস্থায়ী অঙ্গুলি-তাড়নে!
-পিরামিড-পাষাণের মর্ম ঘেরি নেচে যায় দু’দণ্ডের
রুধির-ফোয়ারা
কী এক প্রগলভ উষ্ণ উল্লাসের সাড়া!
থেমে যায় পান্থবীণা মুহূর্তে কখন!
শতাব্দীর বিরহীর মন
নিটল নিথর
সন্তরি ফিরিয়া মরে গগনের রক্ত-পীত সাগরের ‘পর!
বালুকার স্ফীত পারাবারে
লোল মৃগতৃষ্ণিকার দ্বারে
মিশরের অপহৃত অন্তরের লাগি
মৌন ভিক্ষা মাগি!-
-খুলে যাবে কবে রুদ্ধ মায়ার দুয়ার!
মুখরিত প্রাণের সঞ্চার
ধ্বনিত হইবে কবে কলহীন নীলার বেলায়-
-বিচ্ছেদের নিশি জেগে আজও তাই ব’সে আছে
পিরামিড, হায়!
কত আগন্তুক-কাল- অতিথি-সভ্যতা
তোমার দুয়ারে এসে কয়ে যায় অসম্বৃত অন্তরের কথা!
তুলে যায় উচ্ছৃঙ্খল রুদ্র কোলাহল!
-তুমি রহ নিরুত্তর- নির্বেদী- নিশ্চল!
মৌন, অন্যমনা!
-প্রিয়ার বক্ষের ‘পরে বসি একা নীরবে করিছ তুমি
শবের সাধনা
হে প্রেমিক- স্বতন্ত্র স্বরাট!
-কবে সুপ্ত উৎসবের স্তব্ধ ভাঙা হাট
উঠিবে জাগিয়া!
সস্মিত নয়ন তুলি কবে তব প্রিয়া
আঁকিবে চুম্বন তব স্বেদকৃষ্ণ, পাণ্ডু, চূর্ণ, ব্যথিত কপোলে!
মিশর-অলিন্দে কবে গরিমার দীপ যাবে জ্বেলে!
ব’সে আছ অশ্রুহীন স্পন্দহীন তাই!
-ওলটি-পালটি যুগ-যুগান্তের শ্মশানের ছাই
জাগিয়া রয়েছে তব প্রেত-আঁখি- প্রেমের প্রহরা!
-মোদের জীবনে যবে জাগে পাতা-ঝরা
হেমন্তের বিদায়-কুহেলি,
অরুন্তুদ আঁখি দু’টি মেলি
গড়ি মোরা স্মৃতির শ্মশান
দু’দিনের তরে শুধু- নবোৎফুল্লা মাধবীর গান
মোদের ভুলায়ে নেয় বিচিত্র আকাশে
নিমেষে চকিতে!
-অতীতের হিমগর্ভ কবরের পাশে
ভুলে যাই দুই ফোঁটা অশ্রু ঢেলে দিতে!