রবীন্দ্রনাথ

তার পর তুমি এলে
এ-পৃথিবী সলের মতন তোমার প্রতীক্ষা ক’রে ব’সে ছিল
সলের মতন দীর্ণ যুবা এই দানব পৃথিবী
শক্তিমান রাজার মতন রূঢ় রূপবান রক্তাক্ত নক্ষত্র এই আমাদের
ঝলমল আলম্বিত চোগা প’রে প্রবল উষ্ণীয় শিরে রেখে দিয়ে
কঠিন অসির ‘পরে ভর ক’রে
অসীমের অনাবৃত হলঘরে ক্ষণিকের দম্ভ ভুলে ক্যাম্পের নিষ্ঠুর ধাতব বাদ্য
ইশারায় স্তব্ধ ক’রে দিয়ে
চোখ বুঁজে আধোমুখে

এ-পৃথিবী মুহূর্তের কাজ তার ভুলে গিয়েছিল
মুহূর্তের চিন্তা এসে কখন হঠাৎ তারে সচকিত শঙ্কিত ক’রে দিয়ে
চ’লে গিয়েছিল ব’লে
মুহূর্তের স্বপ্ন এসে লক্ষ কোটি বছরের সম্পন্ন কাজের সমৃদ্ধির শিরস্ত্রাণ
নিজের পায়ের তলে রেখে দেয় ব’লে
আমাদের এ-পৃথিবী নিজেরে ব্যথিত বোধ করেছিল
পরাহত- পাণ্ডু- ক্ষুব্ধ;
অবসাদে হিম নীল জর্জরিত হয়েছিল।
হয়েছিল না কি?

তুমি এলে।

আমাদের উপভোগ লালসার এত শক্তি সমুদ্রের মতো এক ব্যথারেও বহিতে পারে যে, বহিতেছে;

আমরা জানি না তাহা
আমাদের অসুর পৃথিবী জানে নি ক’।
কীট পোকা ফড়িং হরিণ পাখি মানুষের অবিশ্রাম জীবনের সাগরের ঢেউয়ের ভিতরে
মুহূর্তে-মুহূর্তে যেই বেদনারা এশিরীয় সৈন্যদের মতো বর্শা তুলে নেচে ওঠে
তারা পরাজিত হয়
ফড়িঙেরও পাখার ভিতরে ব্যথা: তার শক্তি সম্রাটের ক্রুর আঘাতের চেয়ে আরও
ঢের কঠিনতা নিয়ে বেঁচে আছে
কীটেরও জীবনে এক সহিষ্ণুতা প্রাণ পায়
পাখিরও জীবনে এক প্রেম
এক ক্ষমা- এক প্রেম মানুষের হাতের প্রতিটি কাজে বেঁচে থাকে
সৃষ্টি চলে তাই সুন্দরের দিকে
ক্ষমা প্রেম স্থিরতার পানে
নক্ষত্রের শান্তির উদ্দেশে।

এরা কি সুন্দর নয়? ব্যথার সমুদ্রে ফোটে এই সব সূর্যমুখী

সবচেয়ে আসুরিক বিজয়ের সাম্রাজ্যের থাম ভেঙে সুন্দর পাবে না তো তুমি কিছু
সেখানে যে সহিষ্ণুতা নাই- ক্ষমা নাই- প্রেম নাই
কোনও দিন ব্যথা ছিল না ক’- ছিল না ক’ ব্যথাবোধ
তাহাদের শক্তি ছিল- ব্যথিত ঘাসের কীট যেই শক্তি জানে, ছিল তাহা।

তবু তাহা সম্ভোগে অন্যায়ে জয়ে অত্যাচারে লক্ষ লাল লাম্পট্যের রাতে
রক্ত মাংস মাটি হয়ে গেছে
আর কিছু হয় নাই।

এই গান গাহিয়াছ, কবি, তুমি
গেয়ে চ’লে গেছ।

অবনত রূঢ় বিদ্ধ ভ্রূকুটিপীড়িত মুখে কোনও এক দৈত্যসম্রাটের মতো
আমাদের পৃথিবী- শতাব্দী তাহা শুনিয়াছে
যেমন শুনেছে সল ডেভিডের গান
এক দিন
আন্দোলিত হয়েছিল এক রাত
তুমি এই পৃথিবীরে তোমার গানের সূতা দিয়ে আকাশের অন্য সব নক্ষত্রের সাথে বেঁধে দিয়ে চ’লে গেছ।

আজও তাই নক্ষত্ররা এত কাছে, সুন্দর নিকটে এত- শান্তি, প্রেম, ক্ষমা।
আজও তাই নক্ষত্রেরা এত কাছে
তাদের নৃত্যের সুর তবু থেকে-থেকে ক্ষীণ হয়ে আসিতেছে
কবি, তুমি ক্রমে-ক্রমে হিম হয়ে পড়িতেছ ব’লে
সুন্দর যেতেছে ম’রে ধীরে-ধীরে

শান্তি আর থাকিবে না।

ব্যারাকে ধাতুর বাদ্যে হৃদয়ের ধাতব আঘাতে
রুপালি গলার সেই দীর্ঘদেহ গানগুলো বিচ্ছিন্ন রক্তাক্ত হয়ে প’ড়ে রবে

মৎস্যনারীদের মৃত শরীরের মতো।
ব্যথা রবে শুধু
সহিষ্ণুতা রবে।
প্রেম রবে।