ঋতুপরিবর্তনের দিনে

এখন সময় এল ঋতুপরিবর্তনের-
আমরা পুরোনো ভূত যত সব পৃথিবীর
অনেক অস্ত্রের দাগ অস্ত্রোপচারের তালি ফেলে
এই বার চ’লে যাই- তবুও উইল ক’রে যেতে হবে
নিরন্ন উকিল ডেকে হেমন্তের অল্পপ্রাণ সূর্যের আলোক
টেবিলে বসায়ে রেখে- আমার হৃদয়ে এক বড়ো আলোড়ন
জেগে ওঠে অনেক দিনের কথা মনে ক’রে স্মরণীয় জীবনের
ঘড়ির ভিতরে আমি সময়কে খুঁজি নাই কোনও দিন
আমার কর্নিসে এসে সূর্যঘড়ি ভেঙে যেত। নীলাভ আকাশে
আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে টের পেয়ে আমি
আমার পিতার ঋণ শোধ ক’রে দিতে গিয়ে নাড়ির ভিতরে
অবৈধ দ্রুততা এক অনুভব ক’রে গেছি-
প্রান্তরের মধ্যপথে তাই
স্থির হয়ে দাঁড়ায়েছি চারি-দিকে সময়ের সমান্তরাল, উঁচু
তিত্তিরাজ-গাছ, পাখি, ধূসর কুয়াশা
মেঘের মুণ্ডের মতো সব পাহাড়েরা
পাহাড়ের মতো মেঘ ভেসে যায়। এই সব দেখে
আজও আমি জানি না ক’- কে পাহাড়- কারা মেঘ
কিংবা কোনও বড়ো বিদূষক নীল চীনাংশুকের
ড্রপসিন টেনে দিয়ে হাসি-মুখে হেঁট হয়ে রয়েছিল কী-না;
এ-রকম অনুভব আমার একার নয় তবু
আমার পিতার ঋণ আমার একার নয়। সকলেরই পিতা
রয়ে গেছে,- আরণির দিনে তারা পৃথিবীতে এসেছিল
আদি-অ্যামিবার থেকে এক দিন- কিংবা কোনও অকৃত্রিম
অপর পৃষ্ঠার থেকে লাঙ্গুলবিহীন ভাবে দীর্ঘ এক পুস্তকের…
মানুষকে বেঁধে গেছে তার পর আত্মারাম মুস্তফি’র গ্রন্থির মতন
মানুষের সন্তানের সাথে বহু দিন। অনেকেরই এই সব অনুভব;
তবু আমি সেই সব লোকদের চিনি- যাহারা আমার মতো।
প্রতি-দিন সব-চেয়ে আগে এসে ভোর
তাহাদের খুঁজে বার করে ঘাসে- শিশিরে- নদীর লোষ্ট্রে- জলে
সমুজ্জ্বল রাইফেল হাতে নিয়ে যেন তারা অপরূপ পাখির পিছনে
বার হল; পাখিরা ঘুমের পথে কাতর রয়েছে ব’লে আশ্চর্য আস্ফোটে
বুলেটের নিঃসরণ আধাে-অন্ধকার, হিম, জন্তুহীন নীলিমার দিকে
এ-রকম শব্দ আমি ভালোবাসি- পাখিকে চকিত ক’রে এই সব মৌন মানুষের
উজ্জ্বল রগড়, দীপ্তি- আমার এ-জীবনের সকল চিন্ময় অহঙ্কার
এরা পাবে- শেষ-রাতে আকাশের সিংহমণ্ডলের সব নক্ষত্রের থেকে
নেমেছে বাড়বানলে এরা সব;- সমুদ্রের ভিত্তি থেকে নদীদের দিকে
চ’লে যায়; নদীর ভিতর থেকে করুণ জলের ঢেউয়ে আলোড়িত হয়ে
বিবর্ণ বালির ফাঁসে- নগরীতে- রসাতলে- অন্ধকারে গিয়ে খোঁজ পায়
আদি-অন্ত পরিধির গোলকধাঁধার মতো নমুনাকে-

আমিও অনেক ভূত দেখে গেছি কল্মাষের উনুনের কাছে
কাঁধে শকুনের পাখা- পায়ে খুর- সমস্ত শরীর
স্কাঙ্কের মতো বাসি- লাফায়ে-লাফায়ে তারা আধো-উড়ে লাল, অবিনাশ
আগুনের উন্মীল বল্লম খুলে কলরব ক’রে ওঠে কঙ্কালকড়ির
বৃষ্টির মতন শব্দে- যখন আগুন শুধু চারি-দিকে- অগ্নির জননী
কোনও দিকে নেই আর- যখন অগ্নির থেকে সর্বদাই নৃমুণ্ডের ডিম
ডিণ্ডিমের মতো বেজে উল্কার গন্ধকে উড়ে নরকের চাতালের দিকে
পরস্পরের কাছে বালচুরের সার্কাসের ভাঁড়ের মতন।

এই সব দেখে গেছি- অনুভব ক’রে গেছি-
মানুষের বারংবার পরাজয়ে ম্লেচ্ছের মাংসের মতো ভোগ্য হয়ে সব
তার পর পৃথিবীর পথে ক্রমে সেই সব তিন ফুট রাঙা আরণির
আর কোনও মানে নাই- একটি বৃহৎ আলো আপনাকে গুটায়ে নিয়েছে
ইন্দ্রধনু, সূর্য, মেষ, ঢিল, জল, শিশু, পাখি, মহিলার মুখ থেকে
অথবা নতুন ঋতুপরিবর্তনের দিন পেয়ে মানুষের পুরোনো প্রতিভা
নিজেকে নতুন করে; আমাদের পূর্বপুরুষেরা কোন্ বাতাসের শব্দ শুনেছিল?
আমরা নতুন বই লিখি, কিনি, প্রেম করি-
চিন্তাজাল বুনে যাই অবহিত হয়ে ইস্পাতের মতন উজ্জ্বল
নিট আলোকের নিচে। সমুদ্রসবুজ আলো নেমে আসে ইস্পাতের থেকে
যেখানেই চ’লে যাই মসৃণ ইস্পাতে আলো- অবতার-
অদ্ভুত টমটম যেন বেজে ওঠে- তরঙ্গেরা করতালি দিয়ে হাসে অবিকল
নতুন ভোরের স্পর্শে যেন এক অন্তহীন কাগজের সমুদ্রের থেকে।

এই সব গোধূলিসন্ধির নৃত্য। আগেকার সূর্য জল বনানীর সুর
ইন্দ্রধনুকের কোনও মানে নাই- অথবা নতুন অর্থ পেয়ে গেছে তারা
চোলাইয়ের থেকে জেনে।- আমি জানি মানুষের সব সৌন্দর্যের
প্রথম একটি সুর ঘুরে যায় পরিধির বিন্দুর ভিতরে- শেষে
যদিও অস্পষ্ট মধ্যপথে প্রাণ টেঁসে যায় এক চুল
গোধূলিসন্ধির রোল বেজে ওঠে বড়ো দুন্দুভির মতো নিজের আবেগে
আমরা এ-সব নৃত্যে ম’রে যাব ভয়ঙ্কর রতিসঙ্গমের শেষে কীটের মতন
সঙ্গিনীর প্রসবের সঙ্কল্পকে প্রাণ দিয়ে। এখন নিঃসঙ্গ হেমন্তের
বিকেলবেলার আলো নেমে আসে এই-ওই-সেই নগরীর
বিঘোর প্রার্থনাচক্রে- বাজারে- কার্নিভালে- আঘাটায়-
সর্বদাই বিয়োগে- মরণে- মানুষের মস্তিষ্কের মেটেমসাইকোসিসে ফিরে
লামাদের মতো সব ঘুরে যায় মক্ষিকার গুঞ্জরণ ভুলে
অন্য সব নগরীর চেয়ে এই অধিক নিস্তেজ নগরীতে

আমারও টেবিলে আলো নিভে আছে। আমার টেবিল নেই
কোথাও সুস্থির কোনও গৃহের ভিত্তি নেই ব’লে।
তবুও লিখন রেখে দিয়ে যাই: কোনও এক চকিত শিশুর
হৃদয়ে সুলভ আশা ছিল; কোনও এক বালকের প্রাণে দীপ্তি
অধীর আকাঙ্ক্ষা ছিল যুবকের সর্বদাই মূল কারণের পিছে ঘুরে
তবু তার ক্রীতদাস হবে না ক’। এই সব
অস্পষ্ট দীপ্তির কথা সন্দেহজনক এক পুরোনো স্কুলের
বিবর্ণ বোর্ডের। এখন নতুন স্কুল উদ্বোধিত হবে।