সান্যাল

অন্ধকারে দেখা হল সাড়ে-পাঁচ হাত দীর্ঘ সেই এক জীবনের সাথে
মনে হল দানবের মতো যেন বহু ক্ষণ দেয়ালের অই পারে নক্ষত্রের রাতে
মিশে ছিল;- হয়তো সুদীর্ঘ মই বেয়ে এক- কোনও এক গ্রহ থেকে নেমে
পেয়ারাগাছের ছায়া ঠেস দিয়ে আমার চোখের দিকে চেয়ে ছিল থেমে

এখানে থামিল কেন- কী আমোদে?- পৃথিবীর ব্যাস-পথ মাড়াতে-মাড়াতে
এতো ভেবে সান্যাল- উসকায়ে দিল কিছু টেবিলের বেলোয়ারি বাতি
কী যেন লিখিতেছিল- সেই সব রেখে দিয়ে- খানিকটা সন্দেহের ভয়ের বিভাতি
মুখে নিয়ে- ঢোঁক গিলে- টেবিলের কিনারায় কাচের কুঁজোর থেকে খেয়ে নিল জল
সাদা কাগজের ‘পরে যারা চায় ভৌতিক অক্ষরের নিরন্ন সম্বল
বাম পদ প্রসারিয়া মারিল তাদের মুখে ভয়ঙ্কর জৈবিক লাথি-

কারণ, সে সংসার ভালোবাসে- অথবা সে বেসেছে ভালো, এই হেতু শুধু:
উটের বিশ্বাসী গ্রীবা যত দূর চ’লে যায় অনুভব ক’রে শুধু ধু-ধু
মরুভূর জল্পনা- বালি আর সূর্যের সঙ্কলিত ব্যাসের আমোদ
আত্মার ধূসর লোমে তাই তার নাই আর অন্য কোনও বোধ
মরুর গুবরে-পোকা তাই তার কানে গায়: ঢু-ঢু ঢু-ঢু ঢু-ঢু-

‘সান্যাল, তুমিও অই উটের মতন-‘ কেউ তারে বলিবে কি আজ এই রাতে
কেউ তাহা বলে না ক’- কেউ তাহা বলিবে না যখন বালিশে ঘুম রাত্তিরে প্রভাতে
কেউ তাহা বলিবে না- ট্রামের জানালা থেকে যখন এ-চৈত্রের দুপুরে:
উড়ে গিয়ে অফিসের জানালায় বসিবে সে লাটিমের মতো যেন ঘুরে
লাটিম কি প্রতিবাদ করে কিছু ঘূর্ণিপাক খেতে-খেতে বালকের হাতে

‘কোনও এক শৈবালের নীড়ে যদি উঁচু গাছে হ’তে তুমি ডিম:
পাখিনীর? অপ্সরির?- ভেবে লোক খুন হত’- এই কথা ভাবে কি লাটিম
ডাইনোসর কোনও দিন এই কথা ভাবে নাই- আনন্দিত মানুষেরা তবে
এ-কথা জানিবে কেন?- তারাও তো ডাইনোসর-নিঃশব্দতা হবে।
বোকা কথা; আমি জানি মানুষের কোনও দিন নাই অন্তিম।

কারণ, অগ্রিম গতি মানুষের: কালা ধলা বিড়ালের প্রায়
আধো-কালো বিড়ালের আধা-আধি বখরারে ভীষণ খেপায়
রগড়ের কলরবে;- দু’-একটি বায়ুপায়ী মানবিক দার্শনিক সেই সব স্বর
সারা-দিন শুনে-শুনে বুঝে গেছে মানুষের জীবনের অনাদি রগড়
শুধু এক স্নিগ্ধ ভয়: এত হেসে স্বর্গীয় হায়নার পেট ফের নাহি ফেটে যায়।

নক্ষত্রের বীথি যেই স্বর্ণ রোজ ফেলে দেয় পৃথিবীতে ঝেড়ে
নক্ষত্রেরা এক-আধ বার ভাবে অবসরে- সেই সব গভীর প্রেমেরে
মানুষেরা সুশাসনে কোন খন্দে ঝেড়ে ফেলে ফের-
টের পায়: পুরু ঠোঁটে দুগ্ধসাদা ফেনা সব লক্ষ-লক্ষ ক্লান্ত মজুরের
সেই সব প্রেম খায়- গাঁজার মতন টেনে মহিষের মতো শিং নেড়ে

দেখে চেখে, বায়ুপায়ী দার্শনিক না হেসে কি পারে
নক্ষত্রেরা হেসে খুন- পেটে খোঁচা দিয়ে তারা গাঢ় নীলিমারে
হাসায় তোতার মতো সাদা মেঘ-কলরবে- নীলিমার মনে প’ড়ে যায়:
ডাইনোসর ম’রে গেছে হয়তো-বা ভয়ে- রোষে- জিঘাংসায়- কিংবা মূর্খতায়
দিয়ে গেছে মানুষেরে এই সব- মৃত্যু তবু গ্রাসিবে না তারে।

মৃত্যুরে সে বডকিন দিয়ে মারে- সুমধুর খেলা
দুই গাল গর্ত হয়ে যায়, তবু কর্তব্য করে না অবহেলা
স্ট্রেচারের পিঠে শুয়ে আরও গাঢ় অর্থ-সুনীতির কথা ভাবে
প্রাণের বীজনে তার অন্ধকার থেকে দূর অন্ধকারে নাবে
যদিও বলেছি আমি নক্ষত্রকে, ‘পৃথিবী হাল্কা বোন- কখনও মেরো না তারে ঠেলা-‘

‘আমরা সে-পৃথিবীর কানও ঘেঁষে কোনও দিন চলি নাই ভুলে
গর্ভে তার লক্ষ-লক্ষ আলপিন- পেট তার ফানুসের মতো আছে ফুলে’
বলিল নক্ষত্রদল;- তার পর পৃথিবীর- মানুষের কথা
বলিল না তারা আর- নীলিমা বেণির মতো ভেসে গেল- আবার নিরতা;
পাতলা রবার এই জীবনের- পৃথিবীর- কত দিন বেঁচে রবে ঝুলে!

সান্যাল কি জানে তবু ক-খ-গ-ঘ- নিজে সে মানুষ
সান্যাল কি জানে তবু এ-পৃথিবী-গ্রহ এক আসন্ন ফানুস
রবারের খেতে কত কোটি টাকা- পৃথিবীর ব্যাসের রবার
তবুও-যে এক কণা মিঠে সুদ পায় না ক’ তার
এ-সব অপার্থিব গল্প নিয়ে প্রাণ তার করে না ক’ কভু উসখুস

যদিও সে ফুটপাথে কোনও দিন কেনে না ক’ ফাউন্টেন-পেন
তবুও গরিব এক- মুখ তার যেন কোন রহস্যে সফেন
এক তাড়া নোট নিয়ে দাঁড়ায়েছে রাস্তার চৌমাথা জুড়ে
‘এক-শো টাকার নোট ছ’ আনায় চ’লে যায়-‘ বলিতেছে অবিরাম ঠোঁট-কাটা সুরে
সান্যাল আস্বাদ পায়; যদিও বেকুবি সব: ‘হুজুর, একটা নোট আপনি লিবেন!’

চায়ের-টেবিলে ব’সে কালো ফাটলের রেখা কবেকার মৃত পেয়ালার
মনে তার জাগে না ক’;- বরং তাহারে দাও খানিকটা বিলেতি আচার
মেঠো মণ্ডপের কথা ব’লে-ব’লে নিজেই সে হল কংগ্রেস
যেন সে আদিষ্ট শুধু- আর সব বৃহৎ আদেশ
বাইরে ঠাণ্ডা তাই সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে বাঁদরটুপির দরকার

কোনও নারী কোনও দিন বলেছে কি শুধায়ে তাহারে:
চেয়ে দেখ বৎসরেরা কেবল গোধূলি পায়- কেবল আঁধারে
ডুবিতেছে অবিরাম সাদা-সাদা পরিচিত সারসের মতো
তবুও গোলাপ এক- জানো না কি- কোথাও রয়েছে অব্যাহত
আমার হৃদয় সেই শ্বেত ফুল: হে প্রেমিক, চেনো না আমারে?

এমন নিবিড় কথা এই অসঙ্গত যুগে বলিতে কি পারে কোনও নারী
অনুভব ক’রে তবু: যেখানে ফসল থাকে মাইলের-পর-মাইল- যেখানে গোরুর-গাড়ি
পেঁপের সুঘ্রাণ পায় নীরব পথের পাশে- তরমুজ ক্ষীরুইয়ের খেতের কিনার দিয়া
ভেসে যায় পতঙ্গের মতো যেন- সেখানে সান্যাল তার পাবে না ক’ প্রিয়া
তার বধূ দাঁত প’ড়ে গেলে দাঁত বেঁধে নেবে মিসেস ঘোষের মতো সাত-তাড়াতাড়ি

ধাতব-চশমা তার প’ড়ে ছিল টেবিলের এক পাশে খাপের ভিতরে
খুলে নিয়ে ঘ’ষে নিল শ্যাময়ের চামড়ায়- কোনও কিছু বীক্ষণের তরে
বহুদিন ব্যবহৃত মানুষ সে- তবুও হৃদয় তার বন্দরের কঙ্করে নবীন
ব্যাঙ্ক-নোট, গণিকার আখখুট, ভাইটামিন, লটারির দিন- বহু-বহু আলপিন।