শায়িত ঘাসের ভিড়ে

শায়িত ঘাসের ভিড়ে আমি এক অতিকায় পাখির মতন
কিংবা এক দীর্ঘতর তৃণ হয়ে নিজের চিত্তকে
অনুভব ক’রে গেছি ভোরবেলা- রোদের সাগরে
কে-বা এই অবিরল হেমন্তের আগুলফলম্বিত
রোদের ভিতরে ঘুরে আপনাকে এক বার কীট
এক বার পাখি, ঘাস, লোষ্ট্র, মেঘ, ধানখেত ছাড়া
অন্য কোন তন্ময়তা পেতে পারে- তবুও মানুষ
হয়তো পকেটে তার কারুকার্যে গোল ঘড়ি রয়ে গেছে ব’লে
সহসা চকিত হয়- ব্যথা পায়- জননীর চেয়ে
কোনও এক গৃহিণীর টানে যেন বেশি ক’রে
পৃথিবীর অন্ধকার চুম্বকের দিকে
চ’লে যায়- আমিও গিয়েছি ঢের দিন
এই সব প্রান্তরের পথে রোদ যখন ক্রমশ
অধিক প্রকাণ্ড হয়ে উঠে ক্রমে অভিভাবিকার মতো চোখে
সমস্ত আকাশ, নদী, মরখুটে ঘোড়া, মানুষের
ব্যবহারে লেগে গেছে- আধেক বিমূঢ় হয়ে তবু
ততোধিক সন্দিহান হয়ে আমি এই পথ ছেড়ে
চ’লে গেছি মাথা হেঁট ক’রে ধীরে দাশরথি ভুঁইমালীদের
সমতল সাধু ভূখণ্ডের দিকে- নয় ধনু দূরে।
তবুও, ততটা কিছু সাধু নয়- তত সমতল
হয়তো-বা দূর থেকে মনে হয়- কাছে গেলে অগণন শর
ঢিল- ছাই- এবড়োখেবড়ো সব দুঃস্থ মানুষের
আমিষ ছানচেতলা হাঁ ক’রে তাকায়
সবের উপরে প্রিয় হেমন্তের ক্ষুদ্র রোদ তবু
ক্রমেই বিশাল হয়ে কোনও এক মৃত
চালুক্য বংশের শেষ সম্রাটের মতো
পৃথিবীর অন্য কোনও শেষ সম্রাটের মতো যেন রক্তাল্পতায়
তবুও রক্তিম হয়ে ক্রমশই উগ্র হয়ে থাকে
শরের ভিতর দিয়ে সারা-দিন সবুজ বাতাস
নিজেকে বহাতে গিয়ে মাটি- জল- ডিম
মাঠের ভিতর থেকে সমুৎকীর্ণ মৃত বৈদেহীর
আনকোরা কঙ্কালের মতো বেজে শুষ্ক শূন্যতায়
মিশে যায়- এই সব শরগুলো বাতাসের হাতে প’ড়ে গিয়ে
এ-রকম- হয়তো-বা এ-রকম নয় কিছু- দাশরথি জানে
তাহার হৃদয়ে তারা অন্ধকার শয়তানি- আর এক রকম।
হুঁকো’র ধোঁয়ায় নীল হয়ে থেকে মহান আমিষ
দাশরথি ভূঁইমালী হয়তো-বা জেনেছিল সব।
বুড়ো আজ ঢের দিন হল ম’রে গেছে।
যত দূর মনে পড়ে পনেরো বছর আগে- নিজের দাওয়ায়
এ-রকম কোনও এক কার্তিকের রোদে
আকাশকে অপরূপ বেলোয়ারি নীল
মহানুভবতা ব’লে অনুভব ক’রে
আধেক সত্যের থেকে লুপ্ত হয়ে চ’লে গেছে হয়তো-বা পরিপূরণীয়
আধেক বৃত্তাকার অন্য এক প্রতীতির দিকে
অথবা সে বায়ু আজ- তাহার স্ত্রী-ও আজ বাতাসের মতন শরীর
এই সব অববাহিকার কাছে কীর্ণ শরের ভিতরে
বুঝেছে বায়ুর মানে- মানুষের মরণের রীতি।
তবুও মৃত্যুর আগে তারা সব জীবনের বায়ু বিতাড়নে
বিড়ম্বিত হয়ে গিয়ে এক দিন অন্য বিধর্মের
ভিতরে রসের চেয়ে হয়তো কিছুটা তার গণনারূপের
অনুকূল অব্যর্থতা অনুভব ক’রে- চুপে- করুণ আমাদে
হয়ে গিয়েছিল ক্রমে মুস্লিমি মুসলিম সকলেই
ভিড়ে গিয়েছিল ক্রমে সেই দলে সকলেই
শুধু সেই অন্ধকার দাশরথি ভূঁইমালী নিজে
আর তার পৃথিবীর ততোধিক নিরালম্ব ভৌতিকতা ছাড়া
সকলেই উবে গেল; যেমন ঘড়ির বুকে সেকেন্ডের কাঁটা
নিজের নির্লিপ্ত পথে চ’লে তবু অন্য দু’টো কাঁটার সংশ্রবে
অপরিবর্তনীয় মনে হয়- তবুও তা নয়

তেমন অনেক দিন- তার পর- দাশরথি পৃথিবীর পথে
নীরবে কাটায়ে গেছে জীবনকে,- গৃহিণীর মরণের পরে
ম’রে গেছে- হেমন্তের ভোরের বাতাসে
ঘোড়া’র নালের মতো পুরাতন- পরিত্যক্ত হয়ে
ঘাসের ভিতরে শুয়ে বুঝে গেছে- মরচে’র গুণ
এত দিন পরে এই নিসর্গের কাছে এসে- তবু গুণময়
নয় আর- কোথাও তবুও গুণ রয়ে গেছে নদীর ভিতরে
আকাশের নীলিমায়- উঁচু-উঁচু হেমন্তের গাছে- ডালে- কুয়াশায়
আমার পায়ের নিচে অতীব দুরূহ নিরাকুল
তবুও সক্রিয়, স্নিগ্ধ ঘাসের বিস্তারে- তার প্রতিভার মতো
এই সব শুষ্ক শরদের বুকে নির্জন বাতাসে
এখানে মানুষগুলো ক্রমেই লালিত হয়ে তবু
ক্রমেই জৃম্ভিত হয়ে ঝ’রে গেছে মরচে’র মতো
কোথাও নক্ষত্র- পাখি- শরতের ঘাসের নিকটে
অননুভবের মতো- অথবা ভূতের মতো বেড়ে
অন্ধকারে ক্ষ’য়ে গিয়ে তার পর- প্রকৃতিকে তারা
অধিক অভিজ্ঞ ক’রে রেখে গেছে- হয়তো-বা
লক্ষ যুগ আগে এক মুমূর্ষু বিজল ডাইনোসর
সহসা মানবাত্মা পেয়ে গেলে দাশরথি মালী’র মতন
প্রকৃতিও শিহরিত হয়ে উঠে যদি সেই দিন
নিজের চেতনা, ভাষা উন্মোচন ক’রে দিয়ে যেত
তা হলে তা- তবু এই আজকের আলোর ভিতরে
অধিক প্রবীণ, সাধু, নিসর্গের সমতুলনায়
সংজ্ঞাহীন শিশুর কাকলি ব’লে মনে হত না কি?
মানুষ কি আপনার ক্যাথারসিসের প্রতিভায়
ক্রমেই অধিকতর সচেতন- সমীচীন করে নাই পরিপ্রেক্ষণীকে?
আমি এই কথা ভেবে ঘড়ি-ধরা একটি প্রহর
খইয়ের খেতের পাশে নির্জন লোষ্ট্রের ‘পরে ব’সে
নিঃসহায় ভাবে হাসি- মানুষের জ্ঞানের চেতনা
পরমাণুবীজগুলো ছিন্ন ক’রে তবু এক দিন
কতটুকু অন্তঃসার পেয়ে যায়- অন্তঃসারহীন
তবুও তো কিছু নয়- আমার চোখের চারি-দিকে।

এক দিন অর্থনীতি সমধিক শুদ্ধতর হলে
মানুষ যে-তৃপ্তি পাবে পৃথিবীর পথে
আমার শরীর সেই আস্বাদের নির্জন ধারণা
অনুভব ক’রে নিয়ে বিকেলের আলোর ভিতরে
নীলিমার নিচে ব’সে- বায়ুর চুম্বনে
ধীত হয়ে- সর্বদাই। যেন এক লম্বকর্ণ সাদা ছাগলের
শরীর পেয়েছে কেউ দুপুরের ঘুম থেকে জেগে
গোধূম-খেতের বায়ু রৌদ্রের ভিতরে এক শ্বেত ছাগলীকে
কাছে পেয়ে- চারি-দিকে স্নেহময় সাদা মুভমেন্ট
কালের দুয়ারে রোজ ইঞ্চি-ইঞ্চি অগ্রসর হয়ে
অজ্ঞানীকে রক্ষা করে- কল্যাণের আগে জ্ঞান, বোধ
নিবিড়, নিপুণ ভাবে মেড়ে দিয়ে রোজ
তবুও আগামী ভোরে কাজ করে অন্য এক ক্রামশিকতায়।

কোনও-কোনও মানুষের হৃদয় তবুও সেই সমাজের বুকে
খানিকটা নিঃসহায় হয়ে রবে- চারি-দিকে নিসর্গের বধিরতা যদি
সে-দিনও বধির থাকে এ-রকম- সকল সুস্থির
সময়ের প্রকর্ষের কাছে এসে সেই দিনও বোবা
হয়ে থাকে- অথবা মানুষ তার নিজের সম্ভ্রম ফিরে পেয়ে
তাহার পায়ের নিচে হেমন্তের মাঠের ফাটলে
একটি রেখার মানে বার ক’রে নিতে গিয়ে তবু
হয়ে থাকে ডাইনোসরদের মতো অর্থবিহীন
কালো নীল লাল নেকটাই প’রে নিট
কাফস্কিন লেদারের জুতো এঁটে

ওখানে সমাধি নয়- দাশরথি মালী’র কবরে
(কবর তা হয়েছিল সময়ের সহজ নিয়মে)
সন্ধ্যার তির্যক রোদ কোনও এক বিষয়ীর টর্চের মতো
নিজেকে ঘুরায়ে নিয়ে নিভে গেল- সাধু হেমন্তের
সমীচীন অন্ধকারে- আমাদের হৃদয়ের হেমন্তিকতায়।