(সংলাপ কবিতা)
সে-জাহাজ দেখেছে কি কেউ?
গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে ভুলে গিয়ে শীতের সাগরে
কোথাও চাঁদের আলো বরফের মতন সবুজ;
– সেখানে পালের শব্দ একবার শুনেছি বাতাসে,
যেন কার মস্লিন্ শাড়ির ভিতর থেকে এসে
নীল রেশমের মতো চোখের পাতার পথ খুঁজে
আসিতে সে চেয়েছিলো,- সেইসব আমাদের নাই;
জেগে উঠে তারে আর দেখি নাই কিছু!
তবু তুমি বল না কি সে জাহাজ আছে!
আমরা নাবিক;
মাথার ভিতরে এক সাগর রয়েছে যেন আমাদের!
ঢেউয়ের ফেনার ঝিমে আমাদের নীল শিরা ভ’রে গেছে;
আমরা হয়েছি তাই সমুদ্রের স্পঞ্জের মতন-
সাগরের ঢের গল্প খেয়ে ফেলে বেঁচে থাকে!
স্বপ্নের বুদ্বুদ্ ঢের সমুদ্রের সেইখানে জ’মে আছে,
আর তুমি নিঙড়ায়ে লও যদি-
নাবিক, অনেক বুড়ো হ’য়ে গেছো তুমি;
বুড়ো এক পেঁচার মুখের মতো জাহাজের হালে ব’সে থেকে;
তোমার এপ্রন পালে ডানা মেলে অনেক সমুদ্র ঘুরে এসে
কোথাও কখনো ঘুমে শুয়ে থেকে বুঝেছ কি তুমি
জাহাজের পোষা তোতা পাখা মেলে উড়ে যেতে চায়!
কেউ তারে নাম ধ’রে ডেকেছে কি অন্য এক ডেকে!
কোন ডেক্,
শুনেছো কি উড়ে যেতে গিয়ে পালকের রোম তার খসে গেছে,-
একখানা- দুইখানা- তিনখানা- পাখার পালক তার প’ড়ে যায়!
তবুও সে উড়ে গেছে!
জাহাজের নাবিকেরা তখন ঘুমায়ে থাকে
মাঝ-সমুদ্রের শীতে জ্যোৎস্নায় একা যদি জেগে ওঠে কেউ
ঢেউয়ের ভিতরে আলো চিতার মতন তারে কামড়ায়ে ফেলে যেন!
দুই হাত হিম হ’লে হৃদয়ে অনেক ব্যথা জ’মে যায়।
শুক্তির খোলায় ফুটো হ’য়ে গেলে রক্ত দিয়ে সেইসব ভ’রে ফেলে তারা;
জান তুমি সেই রক্তে কিসের অবাধ জন্ম হয়!…
অনেক সমুদ্রে তুমি বেঁচে থেকে সে-সব বুঝেছ।
যেইখানে আরসীর মতো সব মানুষের মুখে
আমাদের মানুষের মুখ সব দ্যাখা যায়
অনেক দেখেছি আমি সেইসব;
তাহাদের হৃদয়ের সব লোনা গল্প আমি জানি!
মাংসের পায়ের ‘পরে ভর ক’রে কাঠের ডেকের ‘পরে হাঁটে যারা,
কাপড়ের পাল তোলে,
যাহাদের জাহাজের অত উচু মাস্তুলের থেকে
সমুদ্রের তিমিরেও ইঁদুরের মতো মনে হয়,
তাহাদের সেইসব গল্প আমি জানি;
দাড়ির ভিতরে শাদা বরফের মতো বুড়ো-বুড়ো হ’য়ে জমে আছে সব!
তুমি কোনো অন্য এক জাহাজের পিছে পিছে যাও নাই?
উত্তরের হাওয়া ছেড়ে পৃথিবীর মধ্যের সাগরে
বিষুবের ঢেউ থেকে দক্ষিণের গরমের সমুদ্রের দিকে
স্পেইনের জল-ডাকাতের মতো
অনেক অদ্ভুত জলে আমরা ঘুরেছি!
কোথাও দেখেছি কোনো জাহাজের পালে আজো ‘স্কাল্’ আর ‘ক্ৰস্বোন্’ আছে,
বাবড়ির মতো চুল- দুই কানে মাক্ড়ি রয়েছে
কোথাও বা নাবিকের!
আজো তবে তারা বেঁচে আছে? তাহাদের জানি আমি,-
তাহারা অনেক সোনা চুরি ক’রে বাঁচে,
তোমার জাহাজ থেকে তোতা তবু চুরি ক’রে নেয় নাই তারা।
আবার তোতার কথা বল তুমি? শোন তবে, মনে প’ড়ে গেছে-
অনেক-অনেক দিন আগে এক রাজা ছিলো যেন,
তার এক রানী ছিলো;- শোন তুমি, রূপকথা নয়;-
তাহারা জাহাজে চ’লে একদিন আমাদের মানুষের পাশে এসেছিলো,
হয়তো তাহারা কোনো এল্ডোরেডো’র!
মস্লিন সোনার কথা শুনিবে না তুমি আর?
আমরাও অবসন্ন হ’য়ে গেছি অনেক রেশম রুপা দেখে,-
তবু সেই জাহাজের ভিতরের দিকে
একবার চেয়ে দ্যাখা যায়!
আমাদের সবুজ তোতারে সেই তাহাদের ভালো লেগেছিলো;
সারাদিন সেই পাখি টি-টি ক’রে কেঁদেছিলো তাহাদের কাছে গিয়ে তবু,
কেন? তুমি বল দেখি?
বিমর্ষ ঘুঘুর মতো সে রানীর মুখ?
হয়তো বা;
তার মুখে পৃথিবীর বিষণ্ণতা লেগে আছে;
তবুও তা এমন সুন্দর!
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি রূপ বেঁচে থাকে বিমর্ষের মুখে,-
তবুও তা পৃথিবীর;
অনেক সাগর ঘোরে যে সব জাহাজ
তাহাদের হাওয়ার ভিতর কোনো-কোনো পাখি থাকে
গল্পের ছবির মতো কি খেয়ে যে তারা বেঁচে আছে
সবচেয়ে বুড়ো-বুড়ো নাবিকেরা জানে নাকো!
কাহার সে পাখি?… জাহাজের নয়?
তবে কার?
কে তাহারে কিনেছিলো?…
বাইজেনটিয়ামে- রোমে- অজন্তায়- এলোরায় কোনো কারিগর
সোনার ভিতর থেকে গেলে-গেলে গড়ে নাই তারে;
যে-সব বিড়াল শাদা-
গল্পের ভিতরে থাকে পরীদের হাতে
তাহাদের সবুজ চোখের মতো পালকের রং!
হয়তো দেখেছি তারে…কে তাহারে কিনেছিলো?
বুয়েন্স আইরিস ছেড়ে
হয়তো জাভার দিকে চ’লেছিলো তখন জাহাজ,-
কোনো এক ট্যারা মানুষের কাছে কোথাও বন্দরে
হয়তো পেয়েছি তারে;- তার হাতে ঢের তোতা থাকে।
কুৎসিতের হাতে রূপ পৃথিবীতে আছে!
যখন বন্দর ছেড়ে তবুও জাহাজ
রুপার নখের মতো বাঁকা এক চাঁদের ভিতরে
ঢুকে-ঢুকে যেতেছিলো চুপে,
পৃথিবীর বুড়ো মেয়েদের সেই স্বপ্নের সময়,-
এখন তোমার তো কোনো এক গল্প বলেছে কি?
কারে?
সেই গল্প কারো মনে নাই?
আমরা তোতার গল্প শুনি নাই;
কানে তবু পালের হাওয়ার শব্দ ঢের শোনা যায়;
জাহাজের হাল ঘেঁষে শুয়ে থেকে সেসব শুনেছি আমি জ্যোৎস্নায়- শীতে
তবুও তো বুঝি নাই অন্য কোনো জাহাজের ডেক থেকে কেউ
আমাদের সবুজ তোতারে কবে শিস্ দিয়ে ঢেকে গেছে!-
কখনো কি শোন নাই?
কেউ কি শুনেছে?
এমন নাবিক তবু থাকে না কি সমুদ্রের পরে…
পালের হাওয়ার গান শুনে-শুনে যাদের খাবার
ঠাণ্ডা হ’য়ে যায়!
কোথাও আস্বাদ বেশি র’য়ে গেছে পৃথিবীর মাংসের চেয়ে!
কোথাও আমরা ছায়া,- আমাদের স্বপ্ন সব শরীরের মতো!
কোথাও রয়েছে বাতি,- আমরা তাহার ছায়া শুধু।
সবচেয়ে বেশি যারা স্বপ্ন দ্যাখে তাহাদের মাথার ভিতরে
মুক্তার মতন ঘোলা আলো র’য়ে গেছে,-
একদিন ক্রমে-ক্রমে তারার মতন
আরো আলো প্রসবের স্থান হবে তাদের হৃদয়ে;
আমরা এমন ক’রে বাড়ি;
জালের ছ্যাঁদার থেকে সমুদ্রের জলের মতন
সকল নীলাভ গল্প সকলের হৃদয়ের থেকে
পলায়ে যেতেছে তবু!
মাছের মতন মাংস পাই না কি তবু?
শুধু এক চামচের নীল ঢেউ তবু যদি ধ’রে রাখা যায়
মাছের আঁশের সাথে ছাই তবে হবে না মিশাতে!
ঘটাতে হবে না তবে কিছু আর!
সেইসব- সেইসব ব্যথা ভুলে যাবে।
সেসব বেদনা তবু করেনিকো বিষণ্ণ আমারে;
জলের ভিতরে ডুবে স্নান ক’রে সমুদ্রের জাহাজের মতো
আমিও উঠেছি বেড়ে,- বুড়ো হ’য়ে- আরো বুড়ো হয়ে!
সাগরের ঈগলের মতো আমি,
শরীরে শাদা-শাদা লোম থেকে সমুদ্রের লোনা জল ঝরে!
সকালের আলো থেকে দুপুরের- দুপুরের রোদ থেকে বিকালের নীল জ্যোৎস্নায়
দুই হাতে দুই পায়ে- লোমে- মাংসে বেঁচে আছি আমি,-
তোমরা বিমর্ষ তবু হও!
তুমি এক অন্য কোনো নাবিকেরে দেবে কি পাঠায়ে?
সকল সমুদ্র ঘুরে এমন বিষণ্ণ কেউ থাকে?
বিমর্ষ রানীর মুখ মনে আছে?
কোথাও সাগরে আমি তেমন বিষাদ আর দেখি নাই,- জানি;-
তাহাদের সে জাহাজ কবে চ’লে গেছে!
কোনদিকে?
কেউ তার খোঁজ জানে নাকো;
তোমরা সে জাহাজের পিছে আর যাও নাই?
আমরা তাদের মতো নই;
তোমাদের ক্ষুধা আছে,
তবুও সেখানে আরো ক্ষুধা বেঁচেছিলো;-
আরো ক্ষুধা? আমাদের চেয়ে আরো বেশি?
আরো বেশি;
বেতের লতার মতো সরু এই সূতার ভিতরে?
ভিতরের সেই ক্ষুধা আমাদের মাংস খেয়ে ফেলে।
আমরা খাপের মতো,
আগুন লেগেছে যেই তরোয়ালে, সেই ক্ষুধা তাই!
আমার হৃদয়ে ক্ষুধা জ’মে উঠে ঝরে যায় নাকো;
সে কোথাও- সে কোথাও বেঁচে আছে তবে;
যার চোখে মুখ দ্যাখে মুছে যাবে আমার চোখের…।
যে-চুমার স্বাদ খুঁজে দুই ঠোঁট তিতা হ’য়ে আছে
কোথাও রয়েছে বেঁচে সেই ঠোঁট!
পৃথিবীতে পাও নাই কিছু?
যখন দুপুরবেলা পৃথিবীর পথে ব’সে থেকে
শরের ভিতরে ভিজে বাতাসের শব্দে ব্যথা পাই,
বাজকুড়ুলের ডাকে যখন হৃদয়ে ব্যথা পাই;
তখন বুঝেছি আমি পাই নাই!-
পৃথিবীতে পাওনি যা সমুদ্রের পথে তারে পাবে?
কোনো এক জাহাজে সে আছে!
কোথায় শুনেছো?
বিকালের অন্ধকারে ডেকে ব’সে থেকে
সমুদ্রের দিকে চেয়ে হয়তো দেখেছি তারে!
হঠাৎ পেয়েছি তারে,- অনেক নিকটে যেন থাকে;
এতো কাছে চ’লে এসে তবুও সে ফিরে যায়,
জাহাজের রেলিঙের ‘পরে হাত রেখে
আঙুলে আবার শীত লাগে!-
কাল রাতে তোমারে পাইনি কেন বিছানায়?
আমি কি অনেক রাত বিছানায় কাটাইনি তবু?
ডেকে তুমি গিয়েছিলে?
ডেকে;
তোমার লোমের কোট পিছে রেখে গিয়েছিলে কেন?
শাল কেন নেও নাই?
কাল রাতে জেগে উঠে এসব দেখেছি,- প’ড়ে আছে;
তবুও তোমারে আমি দেখি নাই,- এমনই কি কোনোদিন হত?
কোনোদিন হয়নি যা একদিন তবুও তা হয়;
শিস্ কেউ দিয়েছিলো?
আমি কারু পোষা পাখি?
জাহাজের ‘পরে ঢের ট্যারা লোক থাকে-
মাথার ওপর থেকে তাহাদের টুপি খ’সে যায়!
একরাশ পরচুলা তাদের মাথার থেকে ঝুলে পড়ে;
তাহাদের বাঁ-পায়ের মোজা খুলে প’ড়ে গেছে গুড়লির পরে;
তাহারা অনেক রাত জেগে থেকে ঝিনুকের মালা গাঁথে,-
জালের মতন খিঁচে সাগরের জলে ফেলে দেয়!
তবুও জাহাজে সব মেয়ে থাকে তাহাদের তামাশায় আছে!
তাহাদের হয়তো বা তামাশার সময় এসেছে;
সমুদ্রের জাহাজের ‘পরে ঢের ভাঁড় বেঁচে থাকে,
পৃথিবীতে এতো নাই!
এখানে চাঁদের আলো ঘুমন্তের মাথা নিয়ে খেলা করে,
কোথাও এমন চাঁদ পৃথিবীতে দেখেছে কি কেউ!
সাগরের থেকে এক বাঁকা মরা মাছের মতন
তাহার সবুজ মুখ ভাসে যেন সমুদ্রের জলে!
সাগরের ফেনার মতন হাত হিম হ’য়ে যায়
ডেকের রেলিঙ আরো ঠাণ্ডা- আরো ঠাণ্ডা হ’য়ে আসে!
আর কেউ ডেকে ছিলো?
দেখি নাই;
অসম্ভব জলে-জলে যখন জাহাজ চরে তখন ঘুমাতে হয়!-
পুরুষের রক্তে তার যেইখানে বিছানা গরম
তখন সেখানে তার বিবাহের মেয়েলোক থাকে।
সেখানে থেকেছি আমি বিবাহের শীত রাত থেকে;
সে রাতে কি শীত ছিলো?
ঢের শীত জমেছে শরীরে তবু বিছানায় শুয়ে।
ডেকে আরো বেশি শীত।
সেখানে তবুও লোক থাকে;
লোক? মেয়েলোক?
এমন মানুষ আছে
সমুদ্রের ঢেউয়ে দুলে অন্ধকারে ঘুমায় না আর!
দোলনায় শিশুদের মতো এই সমুদ্রে আমরা,
এখানে সহজে ঘুম আসে!
সকল মানুষ আর শিশু নয়,- কেউ-কেউ বেড়ে যায়!
জাহাজের ইঁদুরের মতো তারা,- তাহাদের অসুখ রয়েছে!
জাহাজের মানুষের চেয়ে তবু জাহাজের ইঁদুর তরাসে;
অসুস্থ জাহাজ ছেড়ে চ’লে যায় তারা,
তাহাদের বেশি ব্যথা আছে।
তবুও জাহাজ আজো পচে নাই,
কেউ কারে ডাকে তবু অন্য এক জাহাজের ডেকে?
এমন সময় চ’লে আসে
কুঠুরির অন্ধকারে শুয়ে থেকে ঘুম ভেঙে যায়;
তখন কেবিনে ভেঙে প’ড়ে এলোপাথারি সাগর!
সমুদ্রের বাতাসের মুখ কোনো মানুষের মতো কথা কয়!
কারে সে ঘুমাতে দেবে? ঘুম নাকি সবচেয়ে ভালো?
তবুও ঘুমের থেকে ভালো এই জেগে থাকা,- এই জেগে থাকা!
আমরা বাঁচিয়া থাকি আমাদের হৃদয়ের দোষে,-
অবসাদ ধ’রে গেলে অবসন্ন হ’তে চাই আরো!
পালকের বিছানায় শুয়ে তাই অপরাধ জমে,
অপরাধ- অপরাধ- অপরাধ- অপরাধ জমে!
মাঝের সমুদ্রে এসে এইখানে কোথাও তবুও
হৃদয়ের হাত থেকে রক্ত মুছে ফেলে
মুক্তার গেলাসে আমি জলের মতন তারে রেখে দিতে চাই!
কখন হৃদয়ে তার পাপ জমেছিলো?
কেউ আর সেই কথা জানিবে না!
আমিও না?
তুমিও না,- একজন ছাড়া।
একজন ছাড়া? কোথায় সে?
সে কোথাও আছে;
এই ডেকে?
ডেকে গিয়ে দ্যাখা যায় তারে?
কখন?
তোমার বিছানা ছেড়ে যখন তাহার কাছে যাই;-
মেয়েলোক, তোমার পুরুষ যেই বিছানায় আছে
সেইখানে কি রয়েছে?
তারে ছেড়ে অন্য এক বিছানায় মেয়েলোক কেন তবু যায়!
আমি কোনো মেয়েদের বিছানায় কোনোদিন যাই নাই;
এখন অনেক আলো দিনের সমুদ্রে দ্যাখা দেবে
এইসব অসম্ভব ইচ্ছা মুছে যাবে;
এখন ঘুমায়ে পড়,- ঘুমায়ে-ঘুমায়ে পড় তুমি;
ঢের-ঢের অসুস্থ হয়েছ!
তুমি নও,- আমি কারো হৃদয়ের বোন!
কার?
আমারে অনেক ভেবে চুল তার শাদা হ’য়ে যায়।
কখনো পড়ার বইয়ে এই কথা থাকে? কোথাও গল্পের বইয়ে?
অন্ধকারে- দিনের আলোয়- পৃথিবীতে- সমুদ্রের শেষে-
আমি কারো- আমি কারো হৃদয়ের বোন।
কোনদিকে জাহাজ চ’লেছে?
চলে গিয়ে কোথাও সে হৃদয়েরে নিয়ে যাবে;
এখানে সমুদ্র খুব দোলে।
হয়তো জাহাজ আর কোনোদিন আসে নাই এমন সাগরে;
জাহাজের নাবিকেরা পথ ভুলে গেছে?
সবচেয়ে বুড়ো-বুড়ো নাবিকের চোখে
সমুদ্র চোখের ধুলো দেয়।
জাহাজ আবার দুলে উঠিতেছে;
আমাদের কেবিনের অন্ধকারে এলোমেলো হ’য়ে গেছে সব,-
গুছায়ে দেবে না তুমি?
এইখানে ওইসব এলোমেলো হবে;
তবুও গুছাবে চল;
এখন না;
তোমার মাথার থেকে খোঁপা
পালের মতন ছিঁড়ে যায়
তোমার মুখের চুল গুছাবে না!
এখন না;
দাও,- আমি সাজায়ে দিতেছি;
সমুদ্রের দোলা শেষ হ’লে,-
সমুদ্রের দোলা শেষ হয়?
কারা যেন কেঁদে ওঠে।
কোথায়?
শোনা না কি?
জাহাজ কি ডুবে যায়?
হয়তো;
না- না- না- না- কেউ আর কাঁদেনাকো;
জাহাজ ডোবেনি, তবুও কোথায় যাও তুমি?
না- না- না- না,- জাহাজ ডোবেনি!
ডুবে-ডুবে বেঁচে গেছে!
এখানে এসেছো কেন এতো রাতে? ডেকে আর কেউ নাই।
কেবিনে যাবে না ফিরে তুমি?
না- না- না- না- এইখানে চাঁদের আলোয় আমি শিস্ দিতে ভালোবাসি
তবু আমি ফিরে যাবো;
কোথায়?
একদিকে ফিরে যাবো;
হঠাৎ তোমারে এই কালো কোটে এইখানে দেখে
অনেকের ভয় লাগে!
কেউ তবু এইখানে থাকেনাকো এমন সময়!
কেউ-কেউ এসে পড়ে!
না- না- না- না- এখন ঘুমায়ে থাকে সব!
ঘুমায়ে-ঘুমায়ে কেউ হাঁটিবে না?
এখন,- তুমি কেন এখানে এসেছো?
এইখানে বার-বার পায়চারি ক’রে আমি দেখেছি তাকায়ে
আমার লম্বা ছায়া একাই আমার সাথে হাঁটে!
কখনো বা ডান দিকে,- কখনো চলিতে থাকে বাঁয়ে,
কখনো সুমুখে এসে পড়ে,- কখনো পিছনে তারে পাওয়া যায়;
তবু, জানো?- এমন এ-জ্যোৎস্নায় কেউ আর কোনোদিন নিকটে থাকেনি
আমার লম্বা ছায়া ছাড়া!
সেই ছায়া মাঝে-মাঝে বেঁটে হ’য়ে যায়,- তবুও সে কাছে থাকে;
আমার এ-হৃদয়ের কাছে আর কেউ থাকে নাকো,
কেবিনের অন্ধকারে ছায়া তবু চ’লে যাবে,- সেইখানে কেউ-কেউ রবেনাকো আর।
তাই এই জ্যোৎস্নায় শীতে কেঁপে তবু আমি ভালোবাসা শিখি-।
কোথায় তোমার ছায়া?
এবার পিছনে;
দ্যাখা যায়:
চেয়ে দেখ, আবার সুমুখে চ’লে আসিবে সে!
দেখা যাবে;
একবার চ’লে যাবে ডান দিকে, একবার চ’লে যাবে বাঁয়ে;
কুকুরের মতো ক্ষেপে সমুদ্রের ঢেউ যদি খেতে আসে
ভয় পেয়ে পিছাবে না!
কোনো এক মেয়েমানুষেরে আমি ভালোবাসি যদি
হিংসা ক’রে তবুও সে আমারে কি ছেড়ে যাবে?- এই ছায়া?
মেয়েমানুষেরা তবু একদিন ভালোবেসে আমাদের হিংসা ক’রে ছেড়ে যায়;
বইয়ে প’ড়ে দেখেছি সে-সব!
আমিও দেখেছি,
বইয়ে- বইয়ে- বইয়ে- বইয়ে পড়ে!
হাতের চুরুট আর জ্বালাবে না?
জ্বালাবো;
ভেবে-ভেবে জ্বালাতে পারেনি আর এতোদিন;
কতদিন?
তিনদিন- চারদিন আঙুলের ফাঁকে র’য়ে গেছে,
কখনো পকেটে নেমে- কখনো ডেকের ‘পরে পড়েছে গড়ায়ে;
জ্বালাবে তবুও;
দেশলাই আছে?
এতো রাতে ডেকের উপরে?
হয়তো আমার কাছে আছে তবু,- এখানে বাতাসে সব নিভে যায়।
কেবিন তো ভালো ছিলো?
হুঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ- চুরুট জ্বালাতে,-
এইখানে তার চেয়ে বেশি কিছু আছে?
এইখানে পায়চারি ক’রে-ক’রে তবু কিছু পাওয়া যায়!
কোথায় চ’লেছো তুমি?
কোনদিকে জাহাজ যেতেছে?
জাহাজের দিক নিয়ে যারা বাঁচে তুমিও কি তাদের মতন?
আমার নাকের নিচে এই ডেক- একখানা ডেক বেঁচে আছে।
তবুও ডেকের নিচে ফুটো ক’রে ইঁদুরের মতো লেজ তুলে
হৃদয় এখানে কারে খোঁজে!
কাহারো পায়ের পাতা তারে এসে পিষে ফেলে যদি,
সে যদি শুকায়ে থাকে চার ঠ্যাং তুলে,
প’চে যায়-প’চে-প’চে যায়,
তখন তোমরা তারে সমুদ্রের জলে ফেলে দেবে!
সমুদ্রের ঢেউয়ে আমি এখন ঝাঁপায়ে পড়ি যদি
তাহলে তোমরা এসে জাল দিয়ে মাছের মতন
আমারে তুলিতে তবু যাবে!
এই কথা ভাব তুমি?
এইসব ভেবে-ভেবে আমার হৃদয় ঢের বুড়ো হ’য়ে গেছে।
বেঁচে থেকে আরো বুড়ো হ’য়ে যাবে!
সমুদ্রের জলে গিয়ে পচা-পচা ইঁদুরেরা লেজ তুলে খুঁজে-খুঁজে মরে না কি আর।
সেইসব দ্যাখা যাবে সমুদ্রের জলে গেলে;
আগে তবু একবার জলের ভিতরে গিয়ে ডুবে থাকা চাই!
চলো তবে;
চলো;
ডেকের উপর থেকে দুইজন লোক চ’লে গেছে
তাদের দেখেছে কেউ?
এইখানে এতো রাতে তুমি?
কি হয়েছে?
দুই হাত হিম হ’য়ে যায়!
দস্তানা আছে হাতে?
সে-সব হারায়ে গেছে,- কোনোদিন ছিলো নাকো আর!
তাহলে শীতের আর দোষ?
কুঠের হাতের মতো অনেকের হাত থেকে দস্তানা খসে যায়, তবু,
তাদের আঙুল হিম হ’য়ে যেতে চায়!
সেইসব জানি নাকো,- কতো রাত?
রাত ঢের!
কোনদিকে জাহাজ চলেছে?
ওসব কে জানে!
কোথাও বন্দর আছে কাছে?
কেন?
জাহাজের ইঁদুরেরা পালাতেছে না কি?
কে বলেছে?
তাহাদের শব্দ আর শুনি নাকো!
তুমিও কি জাহাজের ইঁদুরের শব্দ নিয়ে অন্ধকারে বেঁচেছিলে?
তোমার মুখের পরে ইদুরে লেজের ছায়া ফেলে নাই তবু।
কতো রাত?
অনেক,- অনেক!
ভোর খুব কাছে?
দেরি আছে;
অন্ধকারে পায়চারি করা যায়;
দুইজন এইখানে পায়চারি ক’রে গেছে;
তাদের দেখেছি আমি;
আমিও দেখেছি;
কোথায় পালাল তারা?
দু-জন ইদুর;-
কোথায় গিয়েছে?
তারাও জাহাজ ছেড়ে পালায়েছে;
এখানে সমুদ্র খুব দোলে!
জাহাজের হাল ভেঙে যায় যদি- হঁদুরেরা পালাতেছে তাই!
যাদের বুটের তলে আঁটা নাই পিছলায়ে প’ড়ে যায় তারা,
জাহাজ তবুও তার বন্দরের দিকে চ’লে যাবে।
-বন্দরের দিকে ঠিক যাবে? জান তুমি?
নাবিক, তোমার কি মনে হয়?
অনেক খারাপ গল্প শুনেছি আমরা
আমাদের এসব বয়সে-!
গল্প তবু গল্প ব’লে শেষ হয়,
তাদের ভিতরে কোনো রক্ত নাই,- মানুষের মাংসে তারা বাঁচে নাকো।
মানুষের কেবিনের জানালায় তবু তারা বেঁচে থাকে!
জানালায় আমরা পর্দা টেনে দেই;
সমুদ্রের বাতাসের হাত এসে সেইসব তুলে ফেলে;
কেন?
কোথাও সমুদ্রে আলো এইখানে পৃথিবীতে চাঁদের আলোর মতো নয়!
কোথাও হৃদয়ে খুব শান্তি আছে,- তবুও সেসব শান্তি দেরি ক’রে আসে;
এখানে জলের শব্দে- সমুদ্রের বাতাসের স্বরে
ঘুম থেকে জেগে উঠে যাহারা বিবর্ণ হ’য়ে যায়,
কোথাও কোথাও গিয়ে একদিন শান্তি পাবে তারা!
ফুটো কলসির মতো ঘুমায়ে-ঘুমায়ে কোনো শান্তি আছে আজ?
এইখানে কে কাহারে চুমো দেয়।
চেয়ে দ্যাখো।
একদিন সে কাহার বিছানায় ছিলো!
তোমারও বিবর্ণ হ’তে হবে।
কোন কথা ভেবে?
তোমার বিছানা ছেড়ে একজন চ’লে গেছে;
সে কাহারও বিছানায় যায় নাই!
বিছানায় নাই কিছু… কোথায় যেতেছো তুমি?
ওইখানে আরো আগে ডেকে।
ভোর হ’য়ে গেছে!
সমস্ত সমুদ্র ভ’রে এখন কুয়াশা!
শীত লাগে?
এই শীতে হৃদয়ের ভালো করে;
তোমার আঙুল তবু হিম হ’য়ে গেছে;
একদিন জাহাজের রেলিঙের চেয়ে আরো বেশি হিম ছিলো তো আঙুলে,
সেদিন সাগরে তবু রোদ ছিলো;
তবু এই কুয়াশার দিকে তুমি চেয়ে দেখ;
মাথার ভিতর থেকে যদি কোনো শাদা চুল দ্যাখা দেয়
এ-কুয়াশা সেইসব মুছে ফেলে যেন;
বড় হ’য়ে বেড়ে গিয়ে একদিন কুয়াশার দিকে আর চেয়ে দেখি নাই,
সাগরের ‘পরে তবু আবার সকাল আসে যখন হৃদয় বুড়ো নয়!
এই শীতে একদিন তবু এক অন্য কথা মনে হ’তো,
তখন বুকের পরে শাল রেখে চেয়েছি সহজ হ’তে,
কিন্তু তবু সেইসবে কোনোখানে কোনো এক খোঁচ র’য়ে যায়!
চেয়ে দ্যাখ বুকের ওপরে আজ কিছু নাই,-
এই শীতে- কুয়াশায় কোথাও এসেছি তবু সেইসব দিনে
পৃথিবীর বুড়োদের সাথে মিশে হৃদয় যেখানে আর ফিরিতে পারে না।
রচনাকাল: ১৯২৯ (?)
শারদীয় প্রতিদিন: ১৪০৬