শৈশব

প্রথমে শিশুর কথা তবু মনে পড়ে
এখনও লুকায়ে আছে- তবে- মনে হয়
মাঝে-মাঝে উঁকি দেয় বয়স্কের হাড়ের ভিতরে
এখনও মানবপ্রাণে যেন এক ধাতু টিকে থাকে
কুয়াশার মতো এক নরম ধাতব
নির্জন জিনিস আছে- মাঝ-রাতে আমি
আঙুলে নদীর জল প্রবাহিত হলে তাকে করি অনুভব

সমুদ্রের ঊর্ণা থেকে উঠে আমি এক দিন পৃথিবীতে এসে
মনে হয় হাতি’র-দাঁতের-গড়া কোনও এক কৃত্রিম বিদেশে
প্রথম জলের রূপ দেখে গেছি- পৃথিবীতে- পানপাত্রে-
মর্মরের অতিকায় আধো-অন্ধকার হিম জালার ভিতরে
প্রথম অগ্নির রূপ দেখে গেছি
পিতৃব্যের জিভ থেকে স্ফুলিঙ্গের মতো যেন ঝরে
প্রথম বায়ুকে আমি অনুভব ক’রে গেছি
করকচের মতো ম্লান সন্ধ্যার আঁধারে
আমার বিবর্ণ চুল নদীর গুল্মের মতো নাড়ে
তার পর সততই সহজ ভাষায়
পিতৃব্যের জিভ থেকে সূর্যের পরিধি
জালার ভিতর থেকে সচ্ছল নদীকে
প্রাণপণ আলোড়ন ক’রে আমি বার ক’রে নিতে
হেসেছি- কেঁদেছি- দুরাশায়

আজও এই পৃথিবীতে শিশুলোক হাসে
পুনরায় কেঁদে ওঠে-
অন্ধকার রজনীর নির্জন বাতাসে
যতিচিহ্নহীন ভাবে ঘুরে যায়
সর্বদাই বামনের মতো পায়
সংক্রামিত হয়ে আমি জেগে উঠি
বয়স্কের অভিভাবনার থেকে ফিরে-
আমার শৈশব- সব পৃথিবীর ক্লান্ত শৈশবের
গুরুতর পীড়া মনে আসে।

সহসা বালক এল তার পর নিজের জগতে
আধো-জিজ্ঞাসার পথ ছেড়ে দিয়ে নিরপেক্ষতায়
ডোরাকাটা জামার ঝিনুক-বোতাম ছিঁড়ে ফেলে
পরিপূর্ণ বিষয়ের স্তরে
ভোরবেলা প্যাঙ্গোলিন নদীর বিবরে
দুপুরের লুঘায়ুম নদীর ভিতরে
বিকেলের কুহুলিন নদীর হৃদয়ে
তাহার মুখের ধূর্ত অবয়ব-রেখা-
উদ্ভিদধূসর দ্রুত গোসাপের মতো যেন নড়ে

অগ্নিপায়ী প্রাকপৃথিবীর সব গোসাপের ভিড়
বনের খোঁড়ল থেকে চেয়ে দেখে- উত্তেজিত হয়
তবু তারা বহু দিন আগে মৃত- সব
দিবসে দেদীপ্যমান বালকের হাড়ে
এক বার জ্ব’লে উঠে চারি-দিকে শোনে কলরব
বায়ু, মাটি, সূর্য, নদী- সব
এই সব বিষয়ের অপ্রাকৃত অন্যায় ভাস্বরতা করে অনুভব
বৈকুণ্ঠ ও নরকের মাঝ-পথে- মৃত্তিকার স্তরে
বালকের হৃদয়কে ধরে তারা
সেই সব মৃত সঙ্কল্পের জীব
সেই সব মৃত কর্তব্যের হাড়
অনর্গল হৃদয়কে উদ্বোধিত করে।

ভোরের শিশিরে সাদা হেমন্তের ঊর্ণাজাল
মাছরাঙা-বর্ণের ঊর্ণনাভ কেন্দ্রের ভিতরে;
অথবা যে-শালগম নিসর্গের তামাশায়
বিদূষক মানুষের মতো চেয়ে থাকে;
চাঁদের আলোয় যেই ধূসর ইঁদুর
শকুনশিশুর মতো ডাকে;
বর্তুল বাতাবিলেবু নিশীথের ডালে;
নির্জন প্রান্তরে এক দ্বিচক্ষু কুকুর
যেই সব বামন ও দানবকে দেখে;
আকাশ পাতাল মর্ত্যে যেই সব সর্পিণীরা
মানুষের মতো কথা কয়;
রাত্রি হলে যেই সব মহিলাকে শঙ্খ মনে হয়
অরণ্যের মগডালে-মগডালে কুয়াশার স্তরে
কিমাকার পাখিদের দূর পরলোকস্থিত সুর
সর্বদাই ঘুমের ভিতরে দুই-তিন ইঞ্চি ডুবে গেলে
বালকের থেকে তারা কয় ধনু দূর?

অথবা সে-সকালের আলোর ফেনায়
হেঁটে যায় সিনোটাফ, মনুমেন্ট- চোরা হাটবাজারের রঙে
নগরীর পরিকীর্ণ রাস্তার ‘পরে
বেলুনের মতো বড়ো গোলাকার আলো
লঘু পাখিদের হাড় বুকে নিয়ে
সততই ত্রিসীমায় চ’ড়ে
হয়ে যায় সর্ষের মতো বিম্বাকার

তাহার কঙ্কালে এক ধূমা মাখে
সাটিনের মতন সূতার
নির্মল কুকুর তার পেটে লাথি খেয়ে
কেঁদে ওঠে ক্যানারি’র বিগর্হিত সুরে।
যেন কোনও অন্য এক শতাব্দীর প্রায়ান্ধ গলির পারে এসে
ভিন্ন এক শতাব্দীর বিশীর্ণ বন্ধুরে
এই সব কথা আমি জানায়েছি- ঢের আগে- কোনও এক দিন
তার পর অন্ধকার যুগ এল- আমিও হয়েছি সমীচীন।