শস্যখেতের উর্বশী

এক দিন ফাল্গুনের স্ফটিকের মতো সাদা রাত্রির দুপুরে
দেখা গেল চাঁদ যেন আকাশের সমতলে দীর্ঘ এক কাশ্মীরীর মতো
মেষপালনের মতো এক রজনীর ঘুম ভেঙে রয়েছে দাঁড়ায়ে
নির্জন ব্যাপ্তির মতো চাঁদ যেন- আকাশের সাদা মেষ শস্যখেত জুড়ে
বল্লমের মতো দীর্ঘ- সমুজ্জ্বল- ধাতুময়- হে হৃদয়, কোনও দিন দেখেছ, বল ত’
এই চাঁদ- কৃষকেরে?- ডাইনে তার গোধূমের গন্ধ যেন- শব্দহীন ধবল ছাগল যেন অগণন- বাঁয়ে
এই দিকে পৃথিবীর নিচু খেত শূন্য ক’রে- চাষাদের গোলাঘরে কবে
চ’লে গেছে বাসমতী ধানের ফসল
এ খড়ের খেত তবু পালকের বালিশের মতন মাংসল
জ্যোৎস্নায় ঠেস দিয়ে চার জন বসেছে নীরবে
(আজ রাতে যেন এক আশ্চর্য গল্পের জন্ম হবে)

জানি আমি- ইহাদের কেউ নয় সে-কালের পাড়াগাঁ’র ভাঁড়
ধেনো মদ খায় না ক’- শুধু ভালোবাসে এই ফাল্গুনের মাঠের ফাটল
সোনালি খড়ের গন্ধ- গোরুর-গাড়ির দেশ- গোলাজাত ফসলের ঘ্রাণ
ফাল্গুনের রাতে যেই জেগে থাকে আধাে-সাদা আধাে-নীল কুয়াশার পাড়
কোনও এক ভৌতিক শাটিনের;- মদ নয়- কাচের গেলাসে এরা ভালোবাসে জল

ধানের গাঁজানো রস মাটির খুরিতে ভরা- নরকের নিম্নখেতে জন্মে যেই ধান
হৃদয়ের কাছে তাহা আবর্জনা নয় তবু- মানুষের স্বপ্নাহত হৃদয়ের কাছে
ইহারা সে-সব কথা জানে
মরণের অই পারে এক বার বৈতরণী নদীর সন্ধানে
যেতে হবে; সকলেরই যেতে হবে- না হলে নির্মেঘ ফুলে মন্দারের গাছে
সোনার পাখির মতো নীড় বেঁধে অবিরল- নাই কোনও আত্মা, কোনও মনীষার স্বাদ
কাচের গেলাসে ক’রে ইহারা তবুও খায় জল- আজও খায় স্থির জল
এক দিন সে-গেলাস ভেঙে দিয়ে হয়তো-বা হৃদয়ের কোনও গাঢ় ক্ষতি
টেনে নেবে অমৃতের দিকে ক্রমে- কালো শুশুকের মতো যারা রচিতেছে অদ্ভুত প্রবাদ
বৈতরণী তরঙ্গের অন্ধকারে (ডুবে-ডুবে) স্বর্ণপাখি হয়ে তারা এক দিন আকাশের তল
কাকলিতে ভ’রে দেবে- না হলে স্বর্গের স্বর্ণে বেলোয়ারি জ্যোতি
ইহারা ভাবিতেছিল মনে-মনে ফুরোনো শস্যের খেতে ব’সে
জলপায়ী দার্শনিক চতুষ্টয়, আহা,
উর্বশী মেঘের পরে টের পেল তাহা
প্রণয়ের টানে নয়- মৃত্তিকার চুম্বকে নেমে এল নিবিড় বয়সে-

পাড়াগাঁর শস্যখেতে- শেষ বাসমতী সোনা চ’লে গেছে কৃষকের ঘরে
ফুরোনো-ফসল খেতে নামিল সে- যেখানে বিচ্ছিন্ন খড় ঢালু উপাধান
নদীর সলিলপায়ী পৃথিবীর ত্যক্ত কবিদের
যেখানে বেকার পেঁচা উড়িতেছে অতিরিক্ত সন্ত্রাসের মতো অনাদরে
যেখানে চারটি যুবা খড়ের উপরে শুয়ে ঘুমায় নির্বাণ
ফাল্গুনের জ্যোৎস্নায় মস্তিষ্কে তাদের চিন্তা জমেছিল- জমেছিল ঢের
এ বিহীন শস্যখেতে প্রবীণ বয়সি
জানাবে কি এই যুবাদের
মাথায় তাদের বোধ জমেছিল- জমেছিল ঢের
চারটি পাখির মতো শুয়ে আছে ডানায় নির্জন ডানা ঘষি

চারটি পাখির মতো ইহাদের কুড়ায়ে- মেঘের পারে- নভে
নিয়ে যাবে?- কোথায়-যে ইহাদের নিয়ে যাবে তবু
চারটি বিশীর্ণ চিনেহাঁসের মতন সব প্রশ্নের কাকলি
অই দূর নক্ষত্রের পথ যাবে ভ’রে সেই মানবিক অর্ধসিদ্ধ মননের মতো কলরবে
হে মানুষ, জানো তুমি রূপ?- জানো প্রেম?- জানো তুমি কে তোমার? কী তোমার প্রভু
পুরুরবা এক দিন ভালোবেসেছিল এক অপ্সরিরে- আজও সেই জীর্ণ কাসুন্দির গল্প স্খলি
তোমার প্রাণের খাদ্য তৃপ্তি পায়- আমি তবু ভুলে গেছি কবে সেই কথা
আমার চুলের কালো নরকের নদীস্রোত দিয়া
করিতেছে সময় ঘূর্ণন
সময়ের চেয়ে তবু দীর্ঘ এই মন
জন্মে না সময়, আর সময়ের মৃত্যু হয়- তবু আমি শুধু এক সম্রাটের প্রিয়া

চেয়ে দেখ পৃথিবীতে আইবুড় রূপসিরা ক্রমে-ক্রমে বুড়ি হয় আরও
তার পর সাদা চুলে ব’সে থাকে- মনে হয় পউষের লাউমাচাখুঁটির উপরে
মৃত সন্দর্ভের মতো কে যেন রেখেছে হাঁড়ি সাদা চুনে মেখে
ছাতকুড়ো নষ্ট ক’রে দিয়ে গেছে কুলের আচার… সাধ তো হেঁয়ালি এই: বলিতে কি পারো
লাটিম ঘুরায়ে খুশি যে-বালক আজ ভোরে- কোনও স্পৃহা নাই তার কেন লাল লাটিমের তরে
মুহূর্তেই;- নারীরাও চায় না ক’ তারে আর- মাংসের পচন তার মনের ভিতরে যেন দেখে
অরণ্যের উঁচু-উঁচু পল্লবের ফাঁক দিয়ে অগণন সাদা-সাদা বকের মতন
বৎসরেরা উড়ে যায়- কবি আর দার্শনিক মানুষের কানের পটহে
সেই শব্দ চির-দিন শববাহকের হৃৎপিণ্ডের মতো কথা কহে
তবুও রয়েছে যবকুসুমের সাদা মেঘ- দূর রৌদ্রে- সময় করে না সেই শস্য আচ্ছাদন

ধূসর গোলাপ এক রয়ে গেছে- বিচ্ছেদ সে- যোগ আর বিয়োগের শ্লথ সমন্বয়
চিনেছিল- পৃথিবীর মনীষায়;- তবুও প্রগাঢ় ঊর্ধ্বে চ’লে গেল- শ্বেতাশ্বতর দীপ- আভা সেইখানে
অশিক্ষিত কিশোরীর মতো ডাঁশা- স্থির এক পরিপক্ক স্বর্ণজ্যোতি নিয়ে
প্রদীপ জ্বলিতে আছে- নিচে তার লক্ষ-লক্ষ খরগোশ-শাবকের মতন সময়
লক্ষ্য থেকে নির্ধারিত উপলক্ষ্যে ধাবিতেছে- মুহূর্তের ঘাসের সন্ধানে
সূর্য আর উপগ্রহ সৃজিতেছে প্রেম আর জীবনের সেলাই কাঠের মুখে আগুন জ্বালিয়ে
‘ধূসর গোলাপ এক রয়ে গেছে পৃথিবীর প্রতিভার পারে-?’
আধােঘুমে শুধাইল যুবা চতুষ্টয়
বলিল কে-এক যুবা: ‘অগোচর গোলাপের কথা থাক- জলপাই-আচারের মতো মনে হয়
রাইসর্ষের মতো মনে হয় আজ এই শস্যখেতে, হে নারী, তোমারে’

‘সূর্যের রশ্মির ঢেউয়ে তবুও তো কোটি-কোটি জীবাণুর সোনালি আস্বাদ
রয়ে গেছে’, বলিল উর্বশী হেসে আধাে-লোভে- ঘুমের ভিতর সব যুবাদের ঠোঁট
উঠিল অস্পষ্ট ন’ড়ে আনন্দের মূঢ়তায়- মনে হল দুগ্ধসাদা মেঘ যেন তাহাদের মুখের উপরে
লঘু হয়ে উড়িতেছে- অলৌকিক সান্ত্বনায়- যেন তারা এই বার মরিবার সাধ
জ্ঞাপন করিতে পারে তাহাদের পরিতৃপ্ত হৃদয়যন্ত্রেরে,- জ্ঞান আর বিজ্ঞানের মিটেছে আখখোট
মক্ষিকা-রঙিন শব্দে নিঃসময় রূপসির- ফাল্গুনের মাঝরাতে- আধাে-ঘুমে- পৃথিবীর মাংসল খড়ে
তন্দ্রা যেন ধূসর চশমা হয়ে তাহাদের চোখ জুড়ে আছে
তাহারা তবুও যেন সুপক্ক ফলের মতো আকর্ষণের স্বাদে দেখিতেছে চেয়ে
গ্রামিক বালিকা এক দাঁড়ায়েছে- আধাে-হাসি যেন তার কান থেকে কানে গেল ছেয়ে
তীক্ষ্ণ উল্লাসের ক্ষোভে- জ্যোৎস্নায়- কবেকার উর্বশী দাঁড়ায়েছে কাছে।