শতাব্দী নদীর পারে

শতাব্দী নদীর পারে শুনেছি অনেক পেলিকান
ঢের বর্গমাইল জুড়ে স্থির হয়ে আছে
তাহাদের নীড় গড়ে- তাহাদের দীর্ঘ ঠোঁট দিয়ে তারা পৃথিবীর কান
বিরক্ত করে না কিছু- প্যাগোডা’র শান্ত বুদ্ধ তাহাদের কাছে
সমস্ত দিনের শেষে অবসরে খানিক সময়
রোজই এসে তাহাদের নির্বাণের মন্ত্র দিয়ে যায়
লক্ষ-লক্ষ বিহঙ্গযোনিকে সেই একটি পাখির মতো পূর্ণ মনে হয়
জ্বলন্ত রৌদ্রেরও রূঢ় খোঁচা খেয়ে মগ্ন থাকে আত্মার চিন্তায়
উদরে আশ্চর্য ক্ষুধা তাহাদের- তবু, আহা- মাঝে-মাঝে তাহাদের সানুদেশ থেকে
একটি কী দু’টি পাখি উড়ে আসে মোদের ভূভাগে
যাহারা ফরাসবিল, সবজির মতো প্লুত, মানুষসমাজ আজ তাহাদের ডেকে
নিয়ে যায় নিরুদ্দেশে- এতখানি শ্যামলতা যেন কোন ধূসরতমের কাজে লাগে

. . .
নীরেন রায়ের কথা আজ মনে পড়ে
সারা-দিন কাটাত সে চায়ের দোকানে ঘুরে-ঘুরে
কোনও দিন প্রশ্ন তারে করি নাই- তবু ঢের নাগরিক নির্জলা উত্তরে
আমারে সে ইঞ্চি-ইঞ্চি ঠেলে দিত- ধূসর পাতার মাংস জুড়ে

যেন এক শক্তিকায় রক্ত প্রজাপতি
নিজেরে সে ভেবেছিল- আমিও ভেবেছি- বহু দিন
আজ এই রজনীতে কোথায় সে পেল অব্যাহতি
অথবা এখনও ঢের কথা আছে?- হেগেলের কাছে ঢের রয়ে গেছে ঋণ

. . .
অথবা গাঙ্গুলি ছিল- সারা-দিন হ্যাট-কোট এঁটে
শেয়ার-মার্কেট- রেস- চোরাবাজারের থেকে নিষিদ্ধ জিনিস
লুকায়ে রাখিত তার হৃদয়ের কোটের পকেটে
দু’ মুহূর্ত!- পরলোকতত্ত্ব তবু ছিল তার দু’ চোখের বিষ
বরং সে পরকীয়া নিয়ে ঢের ক্রূর অবধানে
জীবনের ধাত্রীকেও ক্ষেপায়ে দিয়েছে যেন: বোমার মতন ফেটে হেসে!
গোমেদমণির মতো নিটোল অভিজ্ঞ এক জ্যোতির ব্যাদানে
সামাজিক জীবনকে ঊর্ধ্বে ধ’রে রেখেছিল- বহু দিন নিস্তব্ধ সে আমাদের দেশে

. . .
আমারই নিকটতম হৃদয়ের- কোনও এক ম্লান পরিজন
পঠনের দিনগুলো ছিল তার ঢের সমুজ্জ্বল
তবু যত বড় হল- শুধু চিন্তা- শুধু নিপীড়ন
তাহারে করিল গ্রাস- দেখিলাম কাঁচের গেলাসে ক’রে জল
ঠোঁটের নিকটে তুলে আবার সে রেখে দিত- কোনও এক গুরুতর কথা আছে ব’লে
কোনও এক গোপনীয় বাতাসের সাথে যেন পাশের ঘরের টেলিফোনে
তাহা যদি অর্থ হত, জ্ঞান হত, প্রেম হত- হাসিমুখে আমিও তা হলে
কলমের থেকে কালি দিতাম ছিটায়ে তার জলের গেলাসে- কুটিল মেয়েটির মনে

. . .
অন্য এক সন্নিবদ্ধ রহস্যের উত্তেজনা নিস্তার দেয় নি তারে আর
কেন জীব হত্যা করি?- মানুষের অত্যাচারে মাছ পাখি পশুদের মন্থর মরণ
কী ভীষণ- ভেবে-ভেবে কার্ল মার্কস- সাম্যবাদে হাত দেওয়া হল না ক’ তার
ভেবেছি অনেক দিন- অজাত শিশুরা যদি পেত তার বরণীয় স্তন
তবু সে জলের দামে বিক্রি হয়ে গেল পৃথিবীতে
জাপানি চিমনি এক কিনে নিল নক্ষত্রের আলো
‘মহিলারা এ-রকমই!’- ভেবে মুখ টিপে হেসে রাক্ষস-রাশিতে
চিমনিটা স’রে গেল জ্যোতিষ্কের শূন্য প্রসবের পরে- অন্ধকারে কোথায় হারালো।

. . .
সমতল প্রান্তরের পাশ দিয়ে নির্জন দুপুরে
রেলগাড়ি চ’ড়ে আধাে-তন্দ্রায় চ’লে যেতে-যেতে
অকস্মাৎ চোখ মেলে যদি কোনও শকুনের সুরে
হে হৃদয়, দু’-এক মুহূর্ত হয় থতমত খেতে

তবে মনে হবে কি যে, অবিনাশ দত্তর কথা
কুৎসিত- তবুও এক অমায়িক নিগুঢ় শকুন
ছিল এই জীবনের- এ-মানবজীবনের;- তাহার রূপসি পতিব্রতা
ধবল তোতা’র মতো উড়ে এসে- হাড়ে তবু দায়িত্বের ঘুণ

ক্রমশ জমায়েছিল- অধর্ষণীয় সে এক খুঁটির মতন
বহু দিন- (আমাদের মনে হল)- তোতা যেন হয়ে গেল পেচকী’র মতো
আমার মতন তবু এক দিন দেহ তার উড়ে গেল দূর স্বর্গে- হয়তো-বা মন
ভূটানের প্রজাপতি- ক্রমে-ক্রমে ম’রে গেল- নীল লাল সাদা গুঁড়ি ঝেড়ে অবিরত

সেই থেকে অবিনাশ হয়ে গেছে পাড়াগাঁর টেলিগ্রাফ-পোলের মতন যেন আরও
দেহ দিয়ে আকাশকে ছোঁবে যেন- ধরে যদি লামা’র উদ্যান
ধ’রে দিতে আমাদের- সাধ্য নাই জাগরূক রূঢ় বিধাতারও
আকাশের আচ্ছাদনে তিরোহিত আড়ম্বরে মায়াবীর দড়িটিকে করে অপমান

তবুও বিমর্ষ গল্প- হয়তো-বা আছে কিছু কাসুন্দির শাঁস
এক দিন কার কাছ থেকে যেন কী রকম পক্ষীবিদ্যা কিনে
অবিনাশ ছেড়ে চ’লে গেল এই শাল-ধুতি-পাঞ্জাবির মানবসমাজ
বিচিন্তিত শকুনের পাখা মেলে;- তিন্তিড়ি’র গাছে সেই বেদনার রগড়কে নিতে হবে চিনে

. . .
ভৌতিক প্লানচেট নিয়ে ঢের নাড়াচাড়া করেছিল সোমেন বসাক
এ-পৃথিবী তার কাছে মনে হত সর্ষেবীজের মতো ছোট
কোথাও দ্বিদল আছে- ভাবিত সে- চরাচর শুঁকে-শুঁকে দীর্ঘতম হয়ে গেল না ক’
ক্যামেরাও পায় নি ধরিতে কোনও স্পিরিটের ফোটো

তবুও সে নিসর্গকে চির-দিন বামাচারী পাখিদের স্থল
মনে ক’রে চোখ কান বুজে ফেলে- কোনও এক অন্যতর বৃত্তের সন্ধানে
ঢের বই প’ড়ে গেছে- মনে হত ভয়ঙ্কর আমলকীটারে যেন তার পাণিতল
কান ঘেঁষে হারায়েছে;- তার দেহ যথাস্থানে- আমলকী-ফল যথাস্থানে

আজ রাতে;- তবুও সন্দেহ হয় অন্ধকার গড়ায়ে-গড়ায়ে নুড়ি জমায় শৈবাল
সোমেন-যে বলেছিল পোষা টিয়েটির মতো উড়ে গিয়ে মরণের পর
এক দিন আমাদের কাছে এসে দেখা দেবে- সূচ হয়ে ঢুকে গেছে, বেরুল না ফাল
আজও রাতে;- কিংবা ঘোর অহঙ্কারে ভুলে গেছে আমাদের জল আর কালীদ’র সর।

. . .
আজিকার এ-পৃথিবী নির্জন- মন্থর- মৃত্যু- লয়কারী সুরসিক দানবের হাতে
কৌতূহলে চোখ বিস্ফারিত ক’রে শুনেছে অনেক বার নীহারিকা সেন
জানি আমি;- চায়ের পেয়ালা তার শীতের বাতাসে তবু টেবিলের উপরে জুড়াতে
দেয় গিয়ে;- যদিও ভেবেছে ঢের সারমেয় এই এক শম্বর হরিণ

আমি তবু জানিতাম- হারায় না একটিও সেফটি-পিন তার
এ-পৃথিবী লুটে গেলে তবু তার কুশনের কোনও আলপিন
বিবর্ণ জন্তুর মতো স’বে না ক’ ক্ষমাহীন অন্ধ বাতাসের ব্যবহার
চির-দিন পরিচ্ছন্ন ফ্ল্যামিঙ্গো’র মতো ডানা রহিবে রঙিন

তবুও সে পৃথিবীর মৃত সঙ্গীতের ঢেউয়ে যায় নি ক’ ভেসে
বরং সে চিন্তাক্লেশে ভেবেছিল- মানুষের দেহের ভিতর
লুকায়ে রয়েছে এক প্রাথমিক হাড়- শিরা- ইন্দ্রজাল- বিজ্ঞান এড়ায়ে নিরুদ্দেশে
সেই স্বাদ সেই চিহ্ন ধরা গেলে মানুষের মৃত্যু আর হবে না ক’ চক্ষুপীড়াকর

নিজের চিন্তার চেয়ে তবুও সে দ্রুত ছিল- কিংবা বড়?- ক্রমে-ক্ৰমে টিটকারি দিয়ে
স’রে গেল- অন্য এক মাংসে তার এল অভিরুচি
মনে হল রাজহংসী যেন তার প্রাথমিক দ্যোতনা হারিয়ে
উটপাখি হয়ে গেল বালির ভিতরে মাথা গুঁজি

এর পর শিশুদের গল্প লিখে- নিরন্ন অসার এক মাসিক চালিয়ে
অবৈতনিক স্কুলে টিচারির কাজ ক’রে হয়ে গেল আইবুড়ো শেষ হাড়গিলা
মানুষের কুৎসা দ্বেষ শামুকের মতো গিলে- জতুগৃহে শরীর গালিয়ে
চালুনির লক্ষ ছিদ্রে আজ রাতে সে যেন ক্বাথের মতো ঢিলা

এরা সব বিচিত্র বিচার হাসি খেদ নিয়ে ছিল পৃথিবীতে
বুনোহাঁস ঝপ ক’রে প’ড়ে গেছে যখন গভীর জলে- নদীর ভিতরে
গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে সুদীর্ঘ তরঙ্গ এক প্রত্যুত্তর চেয়েছে খুঁজিতে
এক-গাল শ্লথ জল তবুও এসেছে ফিরে স্তব্ধ হয়ে- নিজের বিবরে

আমি সেই নিস্তব্ধতা চিনি- তবু চিনি না ক’;- প্যাগোডায় শান্ত বুদ্ধ হয়ে থাক হিম
লক্ষ বর্গমাইল জুড়ে নীরবে জুড়াক পেলিকান
হঠাৎ শুনেছি আমি নিষিদ্ধ দুয়ার খুলে নরকের ভীষণ ডিন্ডিম
সূর্যের কিরণে লক্ষ জীবাণুর নৃত্যে ঝলে রূপসির মাকড়ির মতো অভিমান।