সিন্ধুসারস

আদি লেখন

দু-এক মুহূর্ত শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি
হে সিন্ধুসারস!
মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতিদূর তরঙ্গের জানালায় নামি
নাচিতেছ টারন্টেল- রহস্যের; আমি এই সমুদ্রের পারে চুপে থামি
চেয়ে দেখি বরফের মতো শাদা ডানা দুটি আকাশের গায়
ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীর আনন্দ জানায়।

মুছে যায় পাহাড়ের শিঙে-শিঙে গৃধিনীর অন্ধকার গান
হে সিন্ধুসারস,
আবার ফুরায় রাত্রি, হতাশ্বাস;- আবার তোমার গান করিছে নির্মাণ
নতুন সমুদ্র এক, শাদা রৌদ্র, সবুজ ঘাসের মতো প্রাণ
পৃথিবীর ক্লান্ত বুকে; আবার তোমার গান
শৈলের গহ্বর থেকে অন্ধকার তরঙ্গেরে করিছে আহবান!

জানো কি অনেক যুগ চ’লে গেছে? মরে গেছে অনেক নৃপতি?
হে সিন্ধুসারস,
অনেক সোনার ধান ঝ’রে গেছে জানো না কি? অনেক গহন ক্ষতি
আমাদের ক্লান্ত ক’রে দিয়ে গেছে,- হারায়েছি আনন্দের গতি
ইচ্ছা, চিন্তা, স্বপ্ন, ব্যথা, ভবিষ্যৎ, বর্তমান,- এই বর্তমান
হৃদয়ে বিরস গান গাহিতেছে আমাদের- বেদনার আমরা সন্তান?

জানি না কি ওগো পাখি, শাদা পাখি, ওগো নীল মালাবার ফেনার সন্তান।
হে সিন্ধুসারস,
তুমি পিছে চাহো নাকো, তোমার অতীত নাই, স্মৃতি নাই,
বুকে নাই আকীর্ণ ধূসর
পাণ্ডুলিপি; পৃথিবীর পাখিদের মতো নাই শীত রাতে
ব্যথা আর কুয়াশার ঘর।
যে-রক্ত ঝরেছে তারে স্বপ্নে বেঁধে কল্পনার নিঃসঙ্গ প্রভাত
নাই তব; নাই নিম্নভূমি- নাই আনন্দের অন্তরালে
প্রশ্ন আর চিন্তার আঘাত।

স্বপ্ন তুমি দ্যাখোনি তো,- পৃথিবীর সব পথ সব সিন্ধু ছেড়ে দিয়ে একা
হে সিন্ধুসারস,
বিপরীত দ্বীপে দূরে মায়াবীর আরশিতে হয় শুধু দেখা
রূপসীর সাথে এক;’- সন্ধ্যার নদীর ঢেউয়ে আসন্ন গল্পের মতো রেখা
প্রাণে তার,- মান চুল,- চোখ তার হিজল বনের মতো কালো;
একবার স্বপ্নে তারে দেখে ফেলে পৃথিবীর সব স্পষ্ট আলো

নিভে গেছে;তুমি স্বপ্ন দ্যাখো নাকো- যেখানে সোনার মধু ফুরায়েছে,
করে না বুনন
হে সিন্ধুসারস,
মাছি আর; হলুদ পাতার গন্ধে ভ’রে ওঠে অবিচল শালিখের মন,
মেঘের দুপুর ভাসে- সোনালি চিলের বুক হয় উন্মন
মেঘের দুপুরে, আহা, ধানসিড়ি নদীটির পাশে;
সেখানে আকাশে কেউ নাই আর, নাই আর পৃথিবীর ঘাসে।

তুমি সেই নিস্তব্ধতা চেনো নাকো,- অথবা রক্তের পথে পৃথিবীর
ধূলির ভিতরে

হে সিন্ধুসারস,
জানো নাকো আজো কাঞ্চী বিদিশার মুখশ্রী মাছির মতো ঝরে;
সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে;
গভীর নীলাভতম ইচ্ছা চেষ্টা মানুষের,- ইন্দ্রধনু ধরিবার ক্লান্ত আয়োজন
হেমন্তের কুয়াশায় ফুরাতেছে অল্পপ্রাণ দিনের মতন!

এই সব জানো নাকো প্রবালপঞ্জর ঘিরে ডানার উল্লাসে
হে সিন্ধুসারস,
রৌদ্রে ঝিলমিল করে শাদা ডানা শাদা ফেনা-শিশুদের পাশে
হেলিওট্রোপের মতো দুপুরের অসীম আকাশে!
ঝিকমিক করে রৌদ্রে বরফের মতো শাদা ডানা,
যদিও এ-পৃথিবীর স্বপ্ন চিন্তা সব তার অচেনা অজানা।

চঞ্চল শরের নীড়ে কবে তুমি- জন্ম তুমি নিয়েছিলে কবে
হে সিন্ধুসারস,
বিষণ্ণ পৃথিবী ছেড়ে দলে-দলে নেমেছিলে সবে
আরব সমুদ্রে, আর চীনের সাগরে,- দূর ভারতের সিন্ধুর উৎসবে
শীতার্ত এ-পৃথিবীর আমরণ চেষ্টা ক্লান্তি বিহ্বলতা ছিঁড়ে
নেমেছিলে কবে নীল সমুদ্রের নীড়ে!

ধানের রসের গল্প পৃথিবীর- পৃথিবীর নরম অঘ্রান
হে সিন্ধুসারস,
পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই;- আর তার প্রেমিকের ম্লান
নিঃসঙ্গ মুখের রূপ,- বিশুষ্ক তৃণের মতো প্রাণ,
তুমি তাহা কোনোদিন জানিবে না; সমুদ্রের নীল জানালায়
আমারই শৈশব আজ আমারেই আনন্দ জানায়।