সময়ের বলিচিহ্নহীন

এক দিন লুঘায়ুম নদীর ভিতরে
সকালের উত্তেজিত সূর্যে এক ঝরনাকে দেখে
পৃথিবীকে মায়াবীর সৃষ্টি ব’লে মনে হয়েছিল
সোনালি সিংহেরা সব সিংহীদের গিয়েছিল ডেকে

হাওয়ার ভিতরে নীল আকাশের নিচে
ধূর্ত কুয়াশা তার বধির জানালা খুলে দিয়ে
গাধার দুধের মতো সাদা সব কাপোলা মিনারে
প্রকাশিত করেছিল অজস্র শিল্পীর আতালিয়ে

তখন বালক আমি- অথবা স্থবির
অথবা হৃদয় যেন পুরাণপুরুষ-
সূর্যের আগুন খেয়ে উদ্ভিদের মতো
খেয়েছিল পৃথিবীর শরীরের জুস

বিচিত্র নগরীদের স্পাইরাল ধোঁয়ার ভিতরে
মধ্যযুগ থেকে শুরু ক’রে তবু আজ
যে-সব অদ্ভুত গ্রন্থে স্বর্গীয় জন্তুরা
ছবির মতন ভেঙে গ’ড়ে গেছে সামন্তসমাজ

ক্ষ্মের- চোল- ধারাপুরী- মহাবলিপুরে
এক দিন জন্মেছিল যেই সব ভীম কারিগর
তাদের আমোদে এসে বাঘের চোখের অগ্নি হল
গোমেদের মতো স্নিগ্ধ হলুদ পাথর

পবিত্র শরীর চেয়ে সূর্য, অগ্নি, নদী, গ্রন্থ, বায়ু
পার্বত্য প্রান্তরে উঁচু বালিকার কাছে
মনে হয়েছিল দেহ: ধোঁয়া-ভরা নীলিমার তলে
নৃসিংহ ও সিদ্ধার্থের আত্মা ধ’রে আছে

সেই সব নগরীর নাম আমি দিয়ে যাই:
বেলায়ন, মিমিরিন, লুহমান, ক্লিন
ইহাদের শিল্প, গান, প্রভাতের ম্যয়ড়িয়াল
মনে হয়েছিল মূঢ় সময়ের বলিচিহ্নহীন।

ক্রমেই আঁধার হাওয়া ডাক দিয়ে নিয়ে গেল
অন্য সব শহরের অবিরল বারে
ক্ষুৎপিপাসাকে ক্লান্ত বিড়ালের মতো
দেখেছি পিঙ্গল অন্ধকারে

লাফ দিয়ে চ’লে যায় আরও এক ঋজু আলিসায়
তুলে নেয় তারে দীর্ঘ রামেসেস-সম্রাজ্ঞীর হাত
সমস্ত ভারত, চীন, মঙ্গোল, এশিয়া- ধূর্ততায়
কুশ্রী আলানস্করের মতো দেখা দেয় অকস্মাৎ

হয়তো-বা মন্ত্রণা রয়েছে কিছু চর্বি-বাতির অন্ধকারে
হোয়াংহো গঙ্গার পারে নক্ষত্রবৎসরের
যোনির চাকায় ঘুরে আজও ক্লান্ত মুণ্ডিত মানুষ
বিড়ালশল্কের মতো নিজের সত্তাকে পায় টের

এই কথা ভেবে তবু এই সব নদীদের তীরে মনীষীরা
তাহাদের নিজেদের চতুরাস্ত্র মৌজের থেকে উঠে এসে
লক্ষ বৎসরের সব ধূমাময় স্মৃতির ভিতরে
পুনরায় হারায়ে যেতেছে নিরুদ্দেশে

তাহাদের মাঝ থেকে এক জন- দুই জন- কখনও সভয়ে
সময়কে অনুভব ক’রে দেখে প্রাণের ভিতরে
হৃদয় ক্রমেই আরও স্থবির- স্থবিরতর হয়ে
সহনীয় আলোকের মতো শেষে চোখে এসে পড়ে

এই সব কথা জেনে নগরীর পথে তারা হাঁটে
পৃথিবীর সব-শেষ নগরীর শেষ গ্যাস-থামে
সেইখানে শেষ গম্বুজের রেখা গোল হয়ে গিয়ে
গোলাকার পরিধির গ্রাসে গিয়ে নামে

পুনরায়; সেইখানে বারের নির্মল পাত্রে জল ঢেলে দিয়ে
বায়ুর ভিতরে তুলে যখন সে মুখে দিতে যায়
গেলাসের জলে এক মত্ত কুকুরের মুখ
নরকের নিম্নতর অন্ধকারে তাহাকে তাড়ায়।