সমুদ্রচিল

সমুদ্রচিলের সাথে আজ এই রৌদ্রের প্রভাতে
কথা ব’লে দেখিয়াছি আমি;
একবার পাহাড়ের কাছে আসে,
চকিতে সিন্ধুর দিকে যেতেছে সে নামি;
হামাগুড়ি দিয়ে ভাসে ফেনার উপরে,
মুছে যায় তরঙ্গের ঝড়ে।
স্বপ্ন নাই- দাঁড়ায়েছি শতাব্দীর ধুলো কাঁচ হাতে।
(সে শুধু রঙের ছবি রৌদ্রের প্রভাতে)

তরঙ্গের তাড়া খেয়ে চ’লে যায় আরও দূর তরঙ্গের পানে
ফেনার কান্তারে-
বৃষ্টির প্রথম রোদ যেইখানে
তাহার সোনালি ডানা ঝাড়ে;
যেখানে আকাশ নীল কোলাহলময়,
সমুদ্র করিছে দূর সমুদ্র সঞ্চয়,
দিগন্ত হারায়ে যায় দিগন্তের প্রাণে।
(চ’লে যায় দূর- দূর- তরঙ্গের পানে)

চঞ্চল ধবল বুকে নাচিতেছে ফেনার আঙুল;
ধানের শিষের মতো দু’-পায়ের শিরা
নাচিছে স্প্যানিশ টাঙ্গো নীল ঢেউয়ে;
হৃদয় করিছে পান মালাবার হাওয়ার মদিরা;
ট্রুম্-ট্রুম্ ট্রাম্-ট্রাম্- ড্রামের মতন
শৈলে-শৈলে সমুদ্রের রুক্ষ আন্দোলন:
রৌদ্রে-রৌদ্রে ঝলসায় ঝিনুকের ফুল।
(সিন্ধুচিল, ওই মত্ত সমুদ্রের ফেনার আঙুল)

বিজ্ঞান কি মস্তিষ্কের বাক্সের মতন একাকী?
তোমার শরীরে জল- দ্রাক্ষার আঘ্রাণ;
তোমার হৃদয়ে পেকে ঝরিতেছে রৌদ্রের খেত,
জাগিতেছে নব-নব শস্যের সন্তান;
আমরা বন্দরে ফিরি- জনতায়-বসা মাংসে মুখ রাখি ঢাকি
ঘূর্ণিস্রোতে কুকুরের ক্ষুব্ধ লোল আঁখি
পাবে না কি লেজ তার? হো- হো- পাবে না কি!
(পাবে না কি লেজ খুঁজে কুকুরের মতো লোল আঁখি?)

কত দূর ছেড়ে দিয়ে… উত্তরের বাতাসের প্রাণে
জন্মেছে তোমার ডানা- জেগেছে হৃদয়;
সহস্র শতাব্দী- আহা, কাটায়েছি পথ আর ঘরের আঘ্রাণে-
আনন্দের পাই নি ক’ তবু পরিচয়;
জন্মে নি ধবল ডানা বিজ্ঞানের অণ্ডদ্বয় চিরি;
ভেঙ্গে গেছে আকাশের- নক্ষত্রের সিঁড়ি,
উৎসব খুঁজেছি রাত-বিরেতের গানে।

(খুঁজি নাই আলোকের জানালায়- সমুদ্রের প্রাণে)
পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়ায়েছি মনোবীজ, আহা,
আকাঙ্ক্ষার নিঃসঙ্গ সন্তান;
অথবা ঘাসের দেহে শুয়ে-শুয়ে কুয়াশায়
শুনেছি ঝরিতে আছে ধান;
অথবা সন্ধ্যার নীল জনালায়
অদৃশ্য কোকিল এসে গায়
এইসব বেদনার কর্কট শুধু; রেডিয়ামে সারে না ক’ তাহা।
(হৃদয়ের পথে-পথে এই সব ছড়ায়েছি, আহা)

মাঝে-মাঝে একবার ধরা দেই নক্ষত্রের হাতে
চ’লে আসি সমুদ্রের পাশে;
যে খেত ফুরাতে আছে- ফুরাইয়ে গেছে
তার তৃষ্ণা মিটিছে আকাশে;
চেয়ে দেখি সেই নীল আকাশের ছবি;
সমুদ্রের অজান্তব জানালার গল্পের সুরভি;
রৌদ্রের ডানার ভেসে সেইখানে পৃথিবী হারাতে
(চাই আমি; সমুদ্রচিলের খেলা তুলে নিয়ে হাতে)


রঙিন বিস্তৃত রৌদ্রে প্রাণ তার করিছে বিলাস;
কোনও দিন ধানখেতে পৃথিবীর কৃষকের প্রাণ
এই রৌদ্র পায় নাই,- জলপাই পল্লবের ফল,
জ্যৈষ্ঠের দুপুরে মাছি যে উল্লাসে গেয়ে গেছে গান,
কুমারী কোমল ঘাড় নুয়ে চুপে যেই পক্ক রৌদ্রে বেণী করেছে বিন্যাস,
নীল হয়ে বিছায়েছে পৃথিবীর মধুকূপী ঘাস,
তরমুজ খেতে শুয়ে স্বপন দেখেছে চৈত্রমাস,
(তার চেয়ে আরও ঘন গাঢ় মদে প্রাণ তার করিছে বিলাস।)

পৃথিবীতে যেই রূপ কোনও দিন দেখে নাই কেউ;
সিংহলের হীরা রত্ন নারী লুটে নাবিকের দল
ভারত সমুদ্রে নেমে নক্ষত্রের রজনীতে
তারপর ভোরবেলা দেখেছিল স্ফটিকের মত যেই জল;
তরঙ্গের ‘পরে ঘন তরঙ্গের মধু আর দুধ,
মেঘের গোলাপি মুখ- রৌদ্রের বুদ্বুদ;
তবু তারা দেখে নাই পুরুভুজ-বিছানায় নূপুর বাজায়ে নাচে ঢেউ
(বারুণির জানালায়: সিন্ধুচিল-মক্ষিকারা ছাড়া তাহা জানে না ক’ কেউ।)

অনেক রূপের স্মৃতি- ধ্বনিত ঢেউয়ের অগ্নি বয়ঃসন্ধি দিবসের স্তন হয়ে রক্তে নেমে আসে!
কবেকার!- তরঙ্গের উষ্ণ নীল তরমুজ খেতে
আমারে খুঁজিয়া পায় মৃত্যু যেন;
বিস্তৃতির পথে যেতে-যেতে
সমস্ত পৃথিবী যেন মিশে যায় রৌদ্রের সাগরে;
সিন্ধুচিল আর তার বনিতা যেখানে খেলা করে;
তাদের ধবল পাখা চোখে যেন ধীরে-ধীরে নীল হয়ে আসে
(মরণ আমারে যেন পায় সেই দারুচিনি হাওয়ার আশ্বাসে।)