সোনালি ডানার শঙ্খচিল

মনে পড়ে সেই কলকাতা- সেই তেরো-শো তিরিশ-
বস্তির মতো ঘর
বৌবাজারের মোড়ে দিনমান
ট্রাম করে ঘরঘর
আমাদের কিছু ছিল না তখন
ছিল শুধু যৌবন
সাগরের মতো বেগুনি আকাশে
সোনালি চিলের মন

ছেঁড়া শাড়ি প’রে কাটাইতে দিন
বাটনা-হলুদ মাখা
বিভারানী বোস, তোমার দু’ হাতে
ছিল দু’টো সাদা শাঁখা
সাদা শাঁখা শুধু তোমার দু’ হাতে
জুটিত না তেল চুলে
তবুও আমরা দিতাম আকাশে
বকের পাখনা তুলে

জুটিত না কালি কলমে আমার
কাগজে পড়িত টান
তোমার বইয়ের মার্জিনে, বিভা,
লিখিতাম আমি গান
পাশের বাড়ির পোড়া কাঠ এনে
দেয়ালে আঁকিতে ছবি
আমি বলিতাম- ‘অজন্তা…, বিভা!’
তুমি শুধাইতে: ‘ঈগল কবি!’

চক্ষে তোমার মিঙ্-যুগ ভাসে
কাঙড়ার ছবি দু’ নীল চোখে
আমার হৃদয়ে অনুরাধাপুর
পুরানো ফরাসি গানের বোকে
সে-দিন আমার পথে-পথে হাঁটা
সে-ও তম্বুরা- ম্যান্ডলিন
তোমার সে-দিন ঘর সিঁড়ি ভাঙা:
বাংলার পট, পুরোনো চীন।

পৃথিবীর মুখে তুড়ি দিয়ে-দিয়ে
দুইটি হৃদয় সেই
ডাল তেল নুন জোটে না যাদের
জামা শাড়ি কিছু নেই
তবুও আকাশ জয়ের বাসনা:
দু:খের গুলি সে যেন ঢিল
আমরা দু’ জনে বেগুনি আকাশে
সোনালি ডানার শঙ্খচিল-

শরীরের ক্ষুধা মাটির মতন
স্বপ্ন তখন সোনার সিঁড়ি
মানুষ থাকুক সংসারে প’ড়ে
আমরা উড়িব পৃথিবী ছিঁড়ি
সকাল হয়েছে: চাল নাই ঘরে
সন্ধা হয়েছে: প্রদীপ নাই
আমার কবিতা কেউ কেনে না ক’!
তোমার ছবিও ঘুঁটের ছাই!

ছ’ মাসের ভাড়া প’ড়ে আছে না কি?
ঘরে নাই তবু চাল কড়ি নুন?
আকাশের নীল পথে-পথে তবু
আমার হৃদয় আত্তিলা হূণ
আকাশের নীল পথ থেকে পথে
জানালার পর জানালা খুলে
ভোরের মুনিয়াপাখির মতন
কোথায় যে দিতে পাখনা তুলে

সংসার আজ শিকার করেছে
সোনালি চিলেরা হল শিকার
আজ আমি আর কবিতা লিখি না
তুমিও তো ছবি আঁকো না আর
তবুও শীতের শেষে- ফাল্গুনে
মাতাল যখন সোনালি বন
তেরো-শো তিরিশ- দারিদ্র্য সেই-
ফিরে চাই আজ সে-যৌবন

ফিরে চাই আমি তোমারে আবার
আমার কবিতা, তোমার ছবি-
শুধাতাম আমি, ‘অনুরাধাপুর-‘
শুধাইতে তুমি, ‘শকুন কবি-‘
সেই যে আকাশ খোঁজার স্বপ্ন
দুখের ছররা- সে যেন ঢিল
আমরা দু’ জনে বেগুনি আকাশে
সোনালি ডানার শঙ্খচিল।