সন্ধ্যার নদীর জল

সন্ধ্যার নদীর জল এখন ফিরিতে আছে কাশবনে,- হোগলার ঘরে
সেখানে রৌদ্রের ব্যথা নিভে যায়- শিশিরের দেহ ঘিরে দু’-একটা বিস্মিত বাবুই
উড়ে-উড়ে গাহিছে ঘরের গান- এখুনি সে নীড়ের ভিতরে

শান্তি পাবে; সমস্ত দিনের শেষে এসেছে যে তাহাদের আসন্ন সময়
আচ্ছন্ন ধানের মতো তোমার মনের স্বপ্ন যদি আমি ছুঁই
সোনা হয়ে উঠিবে না? ঝ’রে যাবে?- আমার প্রেমের এই ভয়

আমার প্রেমেরে তুমি কেন ভীরু বানায়েছ? কেন তুমি এমন নীরব?
জামের পল্লব ঘিরে এক বার আধ বার নেচে উঠে মুনিয়ার কান্নার মতন
তবু ভয় ঝ’রে যায়; জেগে ওঠে ভোরের চিলের কলরব

হৃদয়ে আমার; এখন এসেছে হাওয়া উৎসবের মতো হাত নিয়ে
অসংখ্য জানালা অই মিলিতেছে- ছায়ার মতন অগণন
ঝাউয়ের শরীরে; তোমার হৃদয় কেন বুজে র’বে, প্রিয়ে

সমস্ত আঁধার রাত্রি ঘুমায়েছি মৃত্যুর মতন
বুকে হাত তুলে দিয়ে নদীর জলের কোলে শব,
তবুও তোমার মুখ দেখে মৃত্যু ভেঙে গেল- বাসমতী শস্য আহরণ

করিতে এলাম আমি- এই পৃথিবীর তীরে আর এক বার
আশ্বিনের রাঙা রৌদ্রে চিল যেন ডানার গৌরব
বুঝে নিল,- মেরুপাখি পেল উষ্ণ জলের ঝঙ্কার

যেন দূর সমুদ্রের,- লক্ষ-লক্ষ মাইল ঘিরে সূর্য আর সোনা
ঢেউয়ের বিস্তৃত খেত- ফেনার ফসল
তরঙ্গের বুনুনিতে কেবল রঙের ছবি বোনা

কেবল স্বপ্নের ছবি; তোমার মুখের রূপ যে দেখেছে ফিরিতেই হবে
মৃত্যু ছেড়ে জীবনের পথে তারে- পাখির মতন কোলাহল
বুকে তার উথলিবে,- তবু তুমি- তুমি কেন স্তব্ধ হয়ে র’বে

বলিব কি ঝাউদের ডেকে-ডেকে তোমাদের অবিরল শাখার জানালা
ক’রে ফেল অন্ধকার- বলিব কি? বাতাসেরে ডেকে?
বলিব কি ঘুঘুদের, বলিব কি নক্ষত্রকে কেন প্রেম কেন আলো জ্বালা?

তবু তারা আলো জ্বালে- গান গায়- তবুও প্রেমের কথা কয়
সারা-দিন মাঠে-মাঠে গুচ্ছ-গুচ্ছ শালিধান যেইখানে রৌদ্রে ওঠে পেকে
আমার প্রেমের মতো জেগে উঠে তাহাদের রঙিন হৃদয়

হাওয়ার শাড়ির গায়ে উড়ে-উড়ে পৃথিবীর ভালোবাসাময়
গেয়েছে রক্তের গান- রৌদ্রে-রৌদ্রে সারা-দিন অন্নের উল্লাস
তুমি আর আমি ব’সে শুনিয়াছি- সন্ধ্যার সঞ্চয়

তোমার খোঁপার মতো তবু কেন স্তব্ধ এত- রহস্যে কঠিন
কখন প্রেমের হাত পৃথিবীর পাখি নদী ঘাস
আমার হৃদয় থেকে ছিঁড়ে নিল,- হয়ে গেল সমাশ্রয়হীন

আমার প্রাণের নিচে পৃথিবীর অনুভূতি শিশুদের দল
কঠিন জননী তুমি তাহাদের- আনন্দ বেদনা অশ্রু উদ্যম বিস্ময়
আজ শুধু প্রেম নিয়ে- কঠিন খোঁপার মতো রহস্যে নিশ্চল

প্রেম নিয়ে,- তুমি এই পৃথিবীরে দেখিতেছ- পৃথিবীর বর্ণ, গন্ধ, গান
তোমার চোখের খোলা জানালায় মায়াবীর সমুদ্রের মতো মনে হয়
আমার হৃদয় সেই দূর মায়া-সিন্ধুর সন্তান-

তুমি এই পৃথিবীরে দেখিতেছ: যখন কুয়াশা থেকে জন্মেছিল প্রথম আকাশ
প্রথম পৃথিবী এই জন্মেছিল- তুমি আমি মেঘের কিনারে
ইন্দ্রধনু-রঙে ব’সে তখন পেয়েছি প্রেম, বেদনা ও মৃত্যুর আভাস

আমি প্রেম, তুমি রূপ- প্রেম নয় রাজকন্যা, পথের ভিখিরি সে যে, আহা
তুমি ব্যথা, তুমি রূপ- রূপ থেকে রূপ আরও সঞ্চয় করিছ তুমি পৃথিবীর পারে
প্রেম থেকে দূর প্রেমে যতই কুড়াতে যাই তাহা

সমুদ্রের পথ আরও বড় হয়- আকাশ খুলিয়া যায় আকাশে-আকাশে
গল্পের সমাপ্তি আর থাকে না ক’- মনে হয় মৃত্যু ও বেদনা
তারা সব মুখবন্ধ- এ-জীবন এক-আধ পাতা শুধু পাণ্ডুলিপি পৃথিবীর ঘাসে

উড়িতেছে- ছিঁড়িতেছে- হয়তো-বা এক-আধ বার তুমি তুলে নাও তাহা
আবার ভুলিয়া যাও- নক্ষত্রের নিচে তবু নব আলোচনা
হবে, প্রিয়ে, এক দিন- এখনই তোমার চোখে তার ঘন আসন্নতা, আহা-