সততই সন্ধ্যা-রাতে আমি

পৃথিবীতে শীত এলে সততই সন্ধ্যা-রাতে আমি
মাঠের ভিতর থেকে ফিরে আসি তবে
সারা-রাত ক্রিয়াশীল থেকে যারা নিজেদের কাজ
ভালো ক’রে বুঝে যায়- সেই সব পুনর্বসু- ভাদ্রপদ- মৃগশিরা- স্বাতী
এই সব সময়ের অন্তরীণ, অপ্রগলভ নক্ষত্রের কাছে
বিবর্ণ লাঙ্গলটাকে ফেলে রেখে- সেই সব নক্ষত্রের গতি
প্রাজ্ঞদের ব্যবহারে- কাজে লাগে- হয়তো-বা এই অনুভব
এক বার- আধ বার অন্ধকারে তুলে ধ’রে নিজের পশ্চাতে
খেতের মাটির ‘পরে ফেলে দেয়- কৃমিকীট যাতে
মানুষের হৃদয়ের অভিনব অনুভবগুলো
নিজের সুবিধা বুঝে খেতে পারে- তবুও গফুর তাহার
নির্বিচার কৃষকের মতো নয়- ঠিকাদারও ঠিক
নয়- বস্তুত সকল কাজে হাত দিয়ে বুড়ো
পরম আয়ুকে তার পাকায়েছে পাড়াগাঁ’র নোনার মতন
দেখে গেছে এই সব কুঁড়ে- ধান- গরু- ঢিল- রোগ
কুয়াশা- নক্ষত্র- মৃত্যু- প্রান্তরের পথে
মানুষ যা কিছু কাজে হাত দিয়ে হৃদয়ের কাছে
তিরস্কৃত হতে পারে- কিছুটা অন্যায় শান্তি পেতে পারে তবু
‘মারাব্বা’ বলেছে ব’লে সারি দিয়ে ধূসর গাধারা।

কোনও কাজে না টিকেই- পুনরায় জীবনের শেষে
এখানে খেতের কাজে টিকে গেল- হয়তো লাঙ্গল
বিবর্ণ লাঙ্গল এক পেয়ে গিয়েছিল ব’লে ভাইপোর কাছে
যখন সে-রুগ্ন ছেলে বহু-বিধ অপার্থিব অহঙ্কার নিয়ে
নদীর ভিতরে ডুবে এক দিন- হেমন্তের জলের ভিতরে
বিড়ম্বিত ভাদ্রপদে ঢুকে গেল- বেরুল না আর।
তবুও গফুর নিজে এক দিন পাড়াগাঁ’র গুরুদের কাছে

(অনেক আগের কথা এই সব- আমাদের পিতা-পিতামহীদের আগে
হয়েছিল- যে-দেয়াল পৃথিবীতে আজ
নেই আর- তাহার নোনা’র রং- সচকিত, তবু কিছু অর্থগভীর
মনে হয়) কিছু-কিছু লেখাপড়া শিখেছিল ঢ্যাড়াসই ছাড়া।
তবুও সে-সব ভুলে মেরে দিয়ে অকৃত্রিম শরীরের পথে
তবুও সে বিচরণ করে নাই- জানি আমি
তবুও শরীর ছাড়া কোথায় দ্বিতীয় তার পথ।
এক দিন পুনরায় শীত এলে- বিকেলের কমলা আলোয়
তাহার প্রাঙ্গণে ছোট ঢ্যাঁরশের খেতে
বুড়োকে পেলাম আমি- অবিকল বেতের বুনোনে
ডালা বোনে- দশম দশায় তীর্ণ কোনও এক তিতিরের মতো।
মানুষের আলাপনে মঙ্গলের জীবের মতন
চমকিত হয়ে গিয়ে দাঁড়াল সে দীর্ঘ কোদালের
উপরে দু’ হাত রেখে ভর দিয়ে- এখানে মানুষ কেউ নেই।
‘কে তুমি- কোথায় ছিলে- আবার এসেছে সেই বোকা ইয়াসিন-
ইয়াসিন- মনে নেই- ‘ ইয়াসিন ছাড়া
এত দিন পরে আমি- তুমি- আমি- আমাদের মনের রুচির
অন্য কোনও অর্থগুণ নেই তবে-
নিকোলাজ গোমেজের চাপরাশি- ছেলেটাকে ডেকে আমি বলি
মনে হয় বলি যেন- তবুও বলি নি তাকে, আহা,
বাবা, তুমি অত দূরে চ’লে গেলে রাতকানা মনে
কী ক’রে নিজেকে দেখি- কী ক’রে-বা লাঙ্গলের ‘পরে
হাত রেখে টের পাই লাঙ্গলের ‘পরে
হাত আছে- ‘আঁতুড়ে দুধের দাঁতে ছেলে
জন্মেছিল- ইয়াসিন- জীবনের প্রথম দিনেই
দুধ-মা’কে খেয়েছিল- ‘ বাধা দিয়ে বলা গেল- ‘তবু তো, গফুর,
এখনও তোমার বউ বেঁচে আছে- জানি আমি- তবুও সে কবে
ম’রে গেল?’- ‘রয়ে গেছে- মরে নাই’, বুকের উপরে হাত রেখে
সমাহিত হয়ে তবু ব’লে গেল- ম’রে গেছে- বেঁচে নেই যদিও নীরবে
অদ্ভুত ধবল মাথা নিয়ে এক নীয়মান বুড়ি
কাছেই দাঁড়াল এসে- বুনো ঢ্যাঁড়শের পাশে একা
সাদা চুল- তাহার সমস্ত শীর্ণ মুখ
কোনও এক পুরাতন পৃথিবীর জ্ঞানময় পেঁচা’র মতন।
মদের দোকানে ব’সে গোমেজের কয়েকটি ইয়ারের সাথে
সারা-দিন জল খায়- তাস খেলে- বার্ডসাই ফোঁকে বটে- তবু
জানি আমি কোনও দিন সেই ছেলে আপনার মনের ভুলেও
কিছুই ছোঁয় না আর- আমি বলি মদের বোতল
হয়তো ভেঙেছে কিছু- গায়ে তেল- কিছুটা তাগদ
সকলেরই বেড়ে যায়- মুখ্যুদের চেয়ে তবু খাসিদেরই বেশি।
শপথ শিখেছে ঢের- জানি আমি- বকে
কিন্তু তবুও সব ইংরেজিতে- যখন শীতের রাত বেড়ে গেছে খুব
তবুও সে জল খায়- আমাদের চালের উপর
যে-সব হুতোমপ্যাঁচা, কালপ্যাঁচা জ্যোৎস্নায় গালমন্দ দিয়ে
কিষানকে ত্যক্ত করে ইয়াসিন সারা-রাত সে-সব পাখিকে
কেবলই উড়ায়ে দেয় ঢিল মেরে-
এ-রকম আরও ঢের কাজ ক’রে যায় বটে- তবু
সর্বদাই জল খায়- মেয়েদের ভালোবাসে- রাঁড়িদের দিকে
কখনও বেঁকে না তবু- ‘দামাল ছেলেরা
কী ক’রে মায়ের প্রাণ ভেঙে ফেলে- সাদা সাধারণ
গেরস্তের মেয়ে ঝেড়ে- ‘, ভুরু কোঁচকায়ে তার স্বামী
বৌয়ের বিদূর গল্প শুনে গেল- আমিও ঘণ্টা-টাক থেমে
না শুনেও শুনে গেছি- অনুভব ক’রে গেছি অববাহিকাকে
ভালো ক’রে মনোযোগ দিয়ে তবু গফুরের দিকে
তাকাতেই দেখা গেল খালি-গায়ে (খানিকটা) লবেজান কার্তিকের শীতে
অত্যন্ত নিবিষ্ট হয়ে ব’সে সে-ও চিনে নেয় সব।
হয়তো যথার্থ ব’লে মনে হয়; হয়তো কোথাও
ক্ষতি ক্ষয় নেই আর- হেমন্তের পরে শীত-ঘুম
নেমে এলে এই সব নিস্তব্ধতা মৃত্যুর ভিতরে।

এদের মৃত্যুর পরে এই সব বাড়ি- মাঠ- ধূসর জলের ঘ্রাণ- পেঁচা
ইয়াসিন কর গুণে বুঝে নিয়ে তবু
নিজের গণনাহীন জীবনের আমোদের কাছে
অপরিবর্তিত ক’রে রেখে দিল- যত দূর- যেমন- সম্ভব।