সূর্যের শেষ বিম্ব

যখন সূর্যের শেষ বিম্ব ধীরে নিভে যায় সরাঙ্গি পর্বতে
নিজের আত্মারে যেন কেমন নিরন্ন বোধ করিল শমন
ক্লান্তিহীন কলমের দিকে চেয়ে বলিল সে ধীরে
দু’ চামচ কাসুন্দি কি দিতে পার, চিত্রগুপ্ত
তা না হলে অমৃতের অবিরল ক্ষারে
অম্ল যেন জমিতেছে
জেরুজালেমের এক ইহুদির কথা, প্রভু, মনে আছে-
শমন সহসা তারে বাধা দিয়ে বলিল বিরক্ত মুখে
আবার সে-সব কথা কেন পাড় তুমি, চিত্রগুপ্ত-
কেন-বা ইহুদি তারে বলো তুমি, আহা,
সে যা হোক, মানুষেরা জানে দুই সহস্র বছর
সেই দীন ধর্মভীরু ছেলে চ’লে গেছে আলাস্কায়
দালাইলামার মতো- আহা, কী-যে বলি
এমনই নিশীথে চোখ ধূসর চশমা হয়ে যায়
কান যেন পীত বরফের ডিন্ডিম শুনিতে পায়
যাজ্ঞবল্ক্য লোল চোখে গার্গেয়ী’র শিরচ্ছেদ করে
একটি মশা’র মতো প্রবীণ গুঞ্জন তুলে
গোলাপজামের থালা ঘিরে
গোল হয়ে- গোল হয়ে ঘুরিতেছে

প্লীহা থেকে যেন ঢের বিস্মৃতির জন্ম হয়।
ত্রিভঙ্গিম গ্লাসিয়ার জেগে ওঠে:
তবুও মেরুর মৃগ খুর দিয়ে বরফের চাঁই ফুঁড়ে
শস্য খায়;- সমস্ত শরীর বরফের গর্তে ঢুকে গেছে
লেজের চামরটুকু শুধু জ্যোৎস্নায়
ধূসর দাড়ির মতো নড়িতেছে
যেন ক্লান্ত- স্থবির ইয়ার
বিশীর্ণ দস্তানা খুলে- অন্ধকার জেভের ভিতর
ধীরে-ধীরে পূরিতেছে;- করুণার গুরুগাম্ভীর্যকে
নিজেই চেনে না যেন- করুণার বালিকারা।

ঠিক, প্রভু, যদিও মরণ নাই কোনও দিন আমাদের
আমরা স্থবির হয়ে পড়িতেছি তবু-
আমাদের জীবনের জ্যামিতির রেখা সব-
উচ্চতর জ্যামিতি যদিও- মানুষেরা- কীটেরাও
চিনে ফেলিতেছে ক্রমে- আমরা তো কম্পাসের মতো কাঁটা
মানুষের হাতে সূক্ষ্ম সূক্ষ্মতর হয়ে
নিশীথের মশারির মতো রূপ পাব এক দিন
ভিতরে আফিংখোর- সিঠে মেরে প’ড়ে আছে
কিছু বেশি খেয়েছিল- শান্তি- শান্তি
ধর্মদণ্ড, মানুষ গভীর চাবি আবিষ্কার ক’রে
এক দিন বিষুবরেখায় আমাদের টেনে নিলে
(ঘুরিতাম চক্রাকারে- স্ফুট হয়ে- লাটিমের মতো যেন
শুধাতাম: হে জামিরতরু,
তুমি মূল, তুমি তরু, অথবা কুসুম তুমি,
হে জামির, হে জামির, হে জামিরতরু)
ঘুরিতাম চক্রাকারে- ধূসর ফেনার মতো
মন্থনদণ্ডের তাড়নায়
কোনও এক গাঢ় গোয়ালিনী যেন আমাদের দিকে চেয়ে আছে
শুধাতাম, হে জামিরতরু…

স্বপ্ন- স্বপ্ন তবু
তারও আগে পিঁপড়ে- মাকড়- কৃকলাস
সমস্ত পৃথিবী জুড়ে একাকী বালিকা এক হি হি ক’রে
গিমে শাক চিবুতেছে দেখে
সেই সব অসার সবজি হাতে টেনে নিয়ে
বুনিবে লুতার জাল স্থির দুন্দুভি’র শব্দে
কিল্লমরা লজ্জা পাবে- সারা শূন্যে ছায়া তার
বিষণ্ন হলুদ দাঁত এক গাল বাতাসের
হিমে ঘ’ষে শান্তি পাবে তার পরে
কিন্নরের বিকল্পিত সামান্য স্বপ্নকে
(পৃথিবীতে আরও ঢের বড় স্বপ্ন ছিল)
অবশেষে কীটপতঙ্গেরা এক সিদ্ধি দিল
লক্ষ-লক্ষ ডিমে জন্মে অনিবার- তবু-
ডিমের প্রসবে ব্যস্ত থেকে
গোমেদ-রঙিন তার রং দেখে- লজ্জা পেয়ে
বিতর্কের প্রক্রিয়ায় তারে
ইঁদুর-ধূসর জলপ্রণালীর মতো অর্থ দেবে- বেগ দেবে-
(পৃথিবীর সোনা রূপা প্রতিভার বেগ
কর্তিত লেজের মতো যেন এক গৈবী গোধিকার
কোথাও সমুদ্রপাড়ে নড়িতেছে- সেই দিন-
মৈথুনের আর কোনও অবসর নেই জেনে)
আতা’র বীজের মতো পৃথিবীর ক্ষুদ্র পেটে
জীনস’এর অগণিত সমস্ত নক্ষত্র যেন জন্ম নিল
তবুও ম্যাজিক- কোথাও ঘর্ষণ নাই- (রাত্রির আনন্দ ছাড়া)

নাল আছে- বল্গা আছে- ঘোড়দৌড় আছে
তবু কোনও ঘোড়া নাই- যাহারা বেতালসিদ্ধ তারা শুধু
হরিণের- ঘোটকের- রূপ নিয়ে-
জীবনের সহজ জলজ সচ্ছলতা- সুস্থতাকে প্রতিরোধ করে
কিল্লমের প্রচণ্ড চুম্বক-গিরি দুই বাহু প্রসারিয়া
যেন এক গর্ভিণীর মতো ঘুরাতেছে ভ্রূণদের
আকাশের জ্যোতিষ গণিত অবিক্ষত যোনি জানে তারা
অমায়িক দরজির মতো মাথা নেড়ে
জীবনের কল ঘুরাতেছে সবে মিলে
যেন নামহীন লক্ষ গাভী হু হু ক’রে হাসিতেছে;
তোমার প্রাণের প্রিয় গাভীটিরে
কোথাও পাবে না খুঁজে জেনে;- খুঁজিবার
কোনও ন্যূনতম আরাধনা
ইহাদের সমীচীন দৃঢ় শিঙে
আজ আর কোনও অর্ধচন্দ্রাকৃতি অবয়ব পায় না ক’

নিশির ডাকের মতো প্রীত স্তব্ধতায় তারা
কোনও এক ক্রৌঞ্চপাহাড়ের দিকে চলিতেছে
প্রচুর যবের ঘ্রাণ চারি-দিকে- বিষণ্নতা নাই
খেদ নাই- যদিও হেমন্তরাত্রি তাহাদের মাথার উপরে
ছুঁড়ে ফেলি মোরা- তবু তাহা বুমারেঙ হয়ে ফিরে আসে
আমাদের ইন্দ্রলুপ্তি ঘিরে রজনীর অন্ধকারে
খটখট ক’রে গুবরেপোকার মতো- বেজে ওঠে

এত শুনে শমন হঠাৎ যেন নিজেরে ফেলিল ধ’রে
ডান হাত বাম মণিবন্ধের উপরে সাঁটায়ে
মৌসুমির রাতে উপসাগরের মতো
অর্ধক্ষুব্ধ গর্জনের রোলে
কপাট কাঁপায়ে দিল আকাশের
একটি স্বর্গীয় মশা ভয় পেয়ে
উড়ে গেল কল্মাষের দিকে
চিত্রগুপ্ত তার কলমের দীর্ঘ ছায়া
মনের বিবর থেকে টেনে নিল
হাতের তেলোয়- নক্ষত্রেরা গোগ্রাসের মতো
শমনের কাঁধের উপরে যেন দেয়ালা করিতেছিল

এক পাল আধােপোষা রুপালি গাধার মতো তারা
কোনও এক দুর্বার কাসুন্দি হাস্যের তাড়া খেয়ে
ক্ষমাহীন হাঁচির হিক্কায় গাবিন সিন্ধুর মতো ফেটে প’ড়ে
প্রান্তরের কুয়াশায় ডুবে গেল।