ভিড়ের ভিতর সহসা এক জন নারীকে

ভিড়ের ভিতর সহসা এক জন নারীকে দেখে তার হৃদয় অনুভব করল
যদিও এই সেই জিনিস নয়- তবুও সেই জিনিসের বিচ্ছুরণ ছাড়া
কিছু নয়। কিন্তু তবুও সেই মূল প্রদীপ কোথায়
যাকে সে কিছু আগে জিনিস ব’লে নিজের হৃদয়কে জানিয়েছে।

কখনও-কখনও শরতের পরিষ্কার রাতে
শূন্যে- অনেক দূরে- এক-আধটি বিষয় দেখা যায়
কেউ যেন তাকে টানছে
সে কাউকে খুঁজে বার করবার জন্য সময়ের হেঁয়ালির ভিতর দিয়ে চলেছে।
অনেক দিন থেকে এই লোকটি অনুভব করেছে- তাকে কেউ দেখতে চাচ্ছে
তার পর স্পর্শ করতে
তার পর হ্রদের ভিতরে নির্জন জলের মতো তার হৃদয়ের সঙ্গে মিশে
একাকী হয়ে থাকতে চাচ্ছে সেই ব্যয়কুণ্ঠ জিনিস
ঘড়ির বিভিন্ন কাঁটার মতো বিচিত্র সময়বুদ্ধি দেওয়া গেল সমস্ত প্রক্রিয়াকে
তবুও এগুলো এক মুহূর্তের
এক অণুকণা জলের ভিতরে অনন্ত সময়ের মতো।
কিন্তু তবুও সেই মূল সলিল কোথায়?
ভেবে সে করোমণ্ডলের সমুদ্রের দিকে গেল
অন্ধকার রাতে ভিজে পরগাছার ঘ্রাণে সে অনুভব করল
মাইলের-পর-মাইল জল।
বালির উপরে লঘু গর্তের আঁচড় কেটে গেছে সমুদ্রের কাঁকড়া
হাতির ও ম্যামথের পাঁজরের মতো রেখা কেটে গেছে জল
এই সব করেছে
এই সব অসামান্য সাধারণ কাজ বটে
কিন্তু তবুও সেই জিনিসের থেকে
সর্বদাই তিলেকের মতন দূরে।
যত দূর চোখের মাইল চ’লে যায়, ততোধিক জলের শূন্যতা
প্রতিভাত হল তার হৃদয়ের কাছে
হৃদয়ের নির্দোষ পেরিমিটারের কাছে তার
কিন্তু এই জল সেই অপর জল নয়।

পুনরায় সে নগরীর ভিতরে গিয়ে দাঁড়াল
(অথবা যেখানে তেমন ভিড় নেই সেই পথ ধ’রে চ’লে
মহাকালের এক-আধটা চুল আরও পাকিয়ে দিয়ে গেল সে)
প্রথম গ্যাস-ল্যাম্পের থেকে শেষ গ্যাস-ল্যাম্পের অনুস্মরণীয় রাত্রির ভিতর দিয়ে
সেই নারীকে দেখবার জন্য যাকে জিনিসের বিচ্ছুরণ ব’লে মনে হয়েছিল
তবু সেই নারীকে
অথবা তার হুবহু প্রতিলিপিকে
প্রায়শই বাতাস রেখার ভিতরে নারীর শরীর ধারণ ক’রে চলেছে
দেখতে পাওয়া যায় বটে
কিন্তু রক্তের যৌন আকর্ষণ হিসেবেও করোমণ্ডলের অন্ধকার জলের মাইলকে
ততোধিক নারী ব’লে মনে হয়েছিল
তবুও চুমো, চুমকুড়ি, আলিঙ্গন তার হৃদয়ের বিচিত্র কথা নয়
নারীকেও পুরুষের পরিপূরক হিসেবে বা
নারীকে নিজের সময়ঘড়ির সুরের মতন
ক’রে সে চায় না।
এরা সকলেই বিচ্ছুরণ।
কিন্তু জিনিস নয়।
নদীর পাশে এক প্রান্তরের কিনারে গিয়ে দাঁড়াল সে
একটা পাহাড় উঠে গেছে-
যাস্ক থেকে ইয়ুং, সিক, মুহাম্মদ, ইয়াকুব প্রত্যেকেরই মুখ বিভিন্ন পাথরের ভিতর
প্রতীয়মান ক’রে যায় নিজেকে-নিজেকে
পাথরের সংখ্যা এত সহৃদয় ভাবে অধিক।
একটি পাথরের কোণ শেয়ালের মুখের মতন হয়ে পুনরায়
গাধার মুখের মতো হয়ে যায়
অল্প পরিমাণের ভিতরে এমন সমীচীন
সর্বজনীন
পাহাড়ের শরীরের এক কিনারে এক-দিন সরাইখানা ছিল
পাহাড়ের শিঙের উপর আজ ডাইনির ঘর
একটি সামান্য গোল জানালার থেকে
অপর একটি সাধারণ গোল জানালার ভিতর
অন্য দিকের
হু-হু ক’রে বাতাস উড়ে যায়
তবুও সেখানে কেউ নেই- না কি নাস্তিলোক একটি ডাইনির-
ভেবে নিয়ে শিঙের উপরে
উঠল গিয়ে সে
হয়তো সেই নিবিড় সামগ্রী এইখানে দু’ জনের জন্য মাঝ-পথ সৃষ্টি করেছে
কোথাও- কোনও দিকে কেউ নেই
কিছু নেই তবুও
অনেক দূরে দেখা গেল বিকেলের রোদে ধূসর মাটির আয়ুর রেখা
নদীর তরঙ্গরেখার মতো সর্বদাই চ’লে যাচ্ছে
তবুও সর্বদাই স্থির।
সেই জিনিস পানিনি কী প্যারাডিম- নদী কী পাহাড়?
অথবা নারীর ভিতরে নিজেকে সব-চেয়ে বেশি ক’রে ফলাবার সম্ভাবনা তার?
অথবা সে পৃথিবীতেই রয়ে গেছে কি না?
শীতের দিনে মারিপাহাড়ের মাইলের-পর-মাইল বরফের গায়ে
যে-মানুষ একাকী স্কি করে
একটি দেবদারুর থেকে অপর একটি দেবদারুর নীরবতার কাছে গিয়ে
মানুষের শরীরের থেকে দুইটি ছায়া বার ক’রে ছুটে যায়
ছায়া দু’টোকে এক ক’রে কুড়িয়ে আনে পুনরায়
অসম্ভব দ্রুততায়
সেই গতির ভিতরে তবুও সেই জিনিস পেল না সে
এক জন মানুষ দুই জন হয়ে যায়- দু’ জন এক হয়ে যায়- তবু
তোমার নিজের ইন্দ্রজাল এ-রকম- সেই জিনিস এই রকম নয়
এই মানুষ একটি জিনিস খুঁজে হুবহু বিচ্ছুরণ পেয়ে গেল
(পেয়ে যায়
অসম্ভব দ্রুততায়, অসম্ভব স্থিরতায়)
কখনও অনুকূল মুখে চ’লে- কখনও স্বাভাবিকতার মুখোমুখি-
(তবুও সে-ই শেষ অনুকূল, স্বাভাবিক জিনিস)
মনে হয় এই পৃথিবীতেই বা অপর কোনও নক্ষত্রে রয়ে গেছে কি না
কে যেন বলছে
“আমি জানি- শুক জানে- সঞ্জয় জানে কি না, জানি না”
কে সে?
যদিও এই পৃথিবীর ভিড়, জল, নারীর দিকে তাকিয়ে মনে হয়
এখানেও সে থাকতে পারত। এই পৃথিবীও তো অপ্রামাণিক নয়
তার পর নিজের হৃদয়ের কথা ভেবে ভয় হয় তার
যদিও সে অনেক পথ ঘুরেছে- তবুও সেই অন্বেষিত জিনিস
হয়তো-বা নারী নয়- হয়তো আর-এক রকম
নারী-প্রেমিক সে- সেই অন্য রকম নিবিড় জিনিস দেখে নিজেই
বিবর্ণ হয়ে ম’রে গিয়েছে কি না
অবিকল অন্ধকারের থেকে অন্ধকারের ভিতরে মহান রগড়ে
ততোধিক মহৎ গাধার পিঠে চ’ড়ে সে ফুরিয়ে যেতেছে কি না
“আমি জানি- শুক জানে- সঞ্জয় জানে কি না, জানি না”
সেই গভীর জিনিস এক দিন এসে বলেছিল হয়তো সময়ের ফুঁয়ের হাওয়ায়
কিংবা বলেছিল কি না
“সঞ্জয় জানে, শুক জানে”, সেই মানুষ বললে, “আমি জানি কি না, জানি না।”