‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে’

বৃষ্টি, ১০ই শ্রাবণ, ভোর
আমি বৃষ্টিকে বলি
এক দুই তিন লেখো তো মেঘের গায়ে
আগুনের মেঘে ফেটে গেলে ফুলগুলি
বলি, ছন্দকে রাখো মৃত্যুর পায়ে!

আমি বৃষ্টিকে বিশ্বাস ক’রে বলি
আঁকো তো সরল লাবণ্যরেখা আঁকো!
পাড়ার ছেলেকে ভুলে গেছো? দেশ গাঁয়ে
যে ছিল তোমার সঙ্গী ও সহপাঠী?
রাখো, মৃত্যুকে ছন্দের পায়ে রাখো-
আমি বৃষ্টির কাছে গিয়ে তাকে বলি
যাও,বন্ধুকে ডাকো!

কেনো তোমার বন্ধুর চোখে ছিল
লাবণ্য, আর তলে আমলকী-
বৃষ্টি, তোমার ঘুমোনোর পথে পথে
নতুন নতুন ভাইবোন, সখাসখী

কাকলি তুলেছে, কলরব ক’রে ক’রে
মিলে গেছে আর মিশে গেছে দেশগাঁয়ে…
মনে নেই বুঝি, আমি সে-গাঁয়ের সাঁকো?

দলবেধে আজ পার হয়ে যেতে যেতে
বৃষ্টি, তোমার বন্ধুকে মনে রাখো!

বৃষ্টি, ১ই শ্রাবণ, সন্ধ্যা
চুম্বনের স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙেছে-
ঠোঁটের ছোঁয়ায় কপাল ভেজা।
একটি পথিক নিজের তরী খুঁজতে গেছে-
নদীর পথে, বনের পথে অনেক বিপদ
ওরে পথিক, সাবধানে যা।

ভেবেছিলাম সেদিন বাড়ি ফিরবো না আর-
সমস্ত রাত পথেই থাকবো।
খোয়াই থেকে কোপাই সেদিন চাঁদের আলো
ছড়িয়ে গেছে নীল আকাশে অসীম ছেয়ে-
হঠাৎ এসে পথের মধ্যে পথ আটকালো
নাম না জানা কে এক মেয়ে।

ওকে বলবো আকাশদীপ? ওকে বলবো
বনের মধ্যে অসময়ের বৃষ্টিধারা?
এই বনে ওর বন্ধু থাকে।
বৃষ্টি এলেই বাতাস কেমন ছন্নছাড়া-
কেবল ডানা ঝাপটে বেড়ায়, কেবল বলে:
‘দীপ ডেকেছে অঞ্জনাকে।’

দীপ কি ডাকে?- আমার কিন্তু
সন্দেহ হয়।
তার কি এমন ডাক পাঠাবার
দিন আছে আর?

কার নামে কী বলছো তুমি?
দীপ তো সে নয়।
সে তো পথিক। অন্ধকারে খুঁজতে গেছে
নিজের তরী- ওগো বাতাস,
অসাবধানী,
আমি তাকে তোমার থেকে অনেক অনেক
বেশি জানি।

সে দেখেছে, বৃষ্টি এসে থমকে দাঁড়ায়
কেমনভাবে বনের শাখে
সে বলেছে, কবিই কেবল মিলিয়ে দেবেন
দীপের পাশে অঞ্জনাকে।

আমি জানি, সেই পথিকের চোখের তলায়
যে-অন্ধকার, সে-অন্ধকার
মুছবে না আর-
সেই কারণে
স্বপ্নে পথিক মিথ্যে মেশায় নিজের মনে

তার কপালের অকালরেখা, মুখের কোণের
ভাঙ্গা আগুন- এক মুহুর্তে ঘুচতে পারে
যে-চুম্বনে,
মিথ্যে মিথ্যে সে-চুম্বনের স্বপ্ন দেখে
ঘুম ভাঙ্গে তার-
হে অন্ধকার, হা অন্ধকার!

অন্ধকারকে নদীর পথে বনের পথে
খুঁজতে গেলে অনেক বিপদ।
বিপদ আমি বরণ করি:
বিপদ থেকেই বন্ধু এলো,
নাম না জানা।
একটি তরী!

অথচ সেই অন্ধকারে পাড় ভেঙ্গে যায় কী বিচ্ছেদে
পাড় ভেঙ্গে যায় পাড় ভেঙ্গে যায় বন্ধু শত্রু বন্ধু ভেদে
আমি ওসব ভাবি না আর, নদীর মধ্যে দাঁড়িয়ে উঠে
জীবনমরণ আকর্ষণে দুইহাতে দুই পাড়কে বাঁধি
প্রাণপণে দুই পাড়কে বাঁধি
ঠিক তখনই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি আসে অঝোরধারায়
তোলপাড় সেই বৃষ্টি নদীর ভিতর দিয়ে টলতে টলতে
তখনো সেই দীপ ভেসে যায়…
আকাশরেখায়…।
দীপ ভেসে যায়…

দীপকে ডাকো, অঞ্জনাদি!

বৃষ্টি, ১৫ই শ্রাবণ, দুপুর
এই তো আমার ঝমঝম করতাল
এই তো আমার কর্কশ সুরধুনী
এই তো আমার দু চার মুষ্টি পথে ঘুরে ঘুরে পাওয়া
এই তো আমার ভেজা ভিক্ষের চাল
ভাতে বাড়ো এক্ষুনি!

এই তো আমার বৈরাগী-ভেক ধরা
এই তো আমার তরুণ কমণ্ডলু
এই তো আমার কাঁড়া-আকাঁড়ায় ভেদাভেদ নাহি করা
এই তো এই তো গুরুগৃহে আর চণ্ডালগৃহে আমি
পেতেছি মাটির সরা!

এই তো আমার কাঁধে মিথ্যের ঝুলি
এই তো তোমাকে ঘুমচোখে ডেকে তোলা
এই তো আমার পুবহাওয়া দেয় দোলা
এই তো আমার সরাকে পেতেছি বসুন্ধরার মতো
বাদল দিনের মেঘপড়ুয়ারা ভিড় ক’রে এলো যতো
সকলের ভোর জাগায় আমার ঝম ঝম খুশিগান-
অত ভোর-ভোর তুমি কি উঠতে পারো?

ঘুরে ঘুরে দেখি, রাত থাকতেই, তুমি ভিক্ষের ধান
ঘরে ঘরে আজ অফিসের ভাত বাড়া!

বৃষ্টি, ১০-১৭ই শ্রাবণ, ভোররাত্রি
রজনী, তুমি চেয়ে আছো
আমার দিকে- আমি ভুল।
বনের পথে এসে দেখি
দীঘিতে ভাসে এলোচুল।

রজনী, তুমি চেয়ে আছো
আমার দিকে- আমি ভোর।
একটি পাখি মনে করে
আমার কথা। আমি ওর?

রজনী, তুমি চেয়ে আছো
আমার দিকে, সেই পাখি
বলে যে আমি নাকি গান
এখনো সুর দেওয়া বাকি

রজনী, তুমি চেয়ে আছো…
আমি তো খুলে রাখা বই
আমার প্রত্যেক পাতা
বলেছে: ‘তাকে জাগাবোই!’

জাগাবো কাকে? তুমি জানো?
যখন ডানা থেকে নামি
রজনী, তুমি শুধু জানো
কী ভাবে ভালোবাসি আমি!

রজনী, তুমি চেয়ে আছো
আমার দিকে তারাভরা
আগুনে স্নান ক’রে এসে
শেখাবে চুম্বন করা

হঠাৎ দুর্যোগ শুরু
বৃষ্টিঝড় নদীতীরে
কী ভাবে বাড়ি যাবো আমি?
ধীরে রজনী, চলো ধীরে…

রজনী, এই দুর্যোগে
আমি কোথায়? আমি কার?
একটি বিদ্যুতে দেখি
আমার জম্মের পার:

তেমনই চেয়ে আছো তুমি
সাঁতরে আমি উঠলাম
পাথর-কাদা-পৃথিবীতে
সাগরে ভেসে আসা প্রাণ

বৃষ্টি থেমে যেতে ঘুম
ভাঙ্গল, সারাদেহ ভিজে
রজনী, ফিরবার পথে
খেয়া চালাবো আমি নিজে

রজনী, তুমি চেয়ে থাকো
আমার দিকে চেয়ে থাকো
বৃষ্টি থেমে যাওয়া মেঘে
আমি যে নিশা অবসান

প্রথম জন্মের থেকে
ভিতরে সঞ্চিত রাখি
ভিতরে বয়ে নিয়ে চলি
একটি মৃত্যুর প্রাণ!