আলো

[উৎসর্গ: রবীন্দ্রনাথ]

এক

সমাধি আজ জলের মতো

সমাধি নয়। হাওয়ায় ওড়া ধুলোয় মোড়া
সমাধিপৃষ্ঠারা
গাদ্যে নীচে ঘুমোতে এল।
সমাধি বয় জলের মতো।
অস্তে যাওয়া আলো
পড়েছে ওই গাছের শিরে।
পাতার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা
ছাড়া পাখির কোনো কাজও তো নেই।
ওই তোমার বৃক্ষবেদি
ওই তোমার পড়াশোনার পাড়া

পাকুড় গাছে ঠেস দিয়ে এক সাইকেল দাঁড়ালো
কে মেয়েটি? লম্বা রোগা, একহারা শালগাছের মতো
চাঁদপানা টিপ
কালোর বেশি কালো?

তুমি কি ওকে চিনতে তুমি
ওকেও চেনো নাকি!

সমাধি যায় জলের মতো…
‘যারা
জলের চেয়ে গভীর জল, পাখির চেয়ে অনেক বেশি পাখি
যারা কেবল প্রেম লুকোয়
সারাটা রাত গাছের সঙ্গে জাগে
ভোর হবার আগে
আমি তাদের ডাকি,
এই দেড়শো বছর পরেও
নতুন লেখা শোনাব, তাই ডাকি।’

দুই

হ্যাঁ, আমি দোষ করেছি, বৌঠান
দু-দশখানা কবিতা-অপরাধ

ঝড়ে উড়িয়ে দিইনি, বৌঠান
আমার যত কবিতা-অপরাধ

তোমার কাছে যা কিছু প্রশ্রয়
সবই আমার কবিতা-অপরাধ

আমাকে ভুল বুঝো না, বৌঠান
ফিরিয়ে নেবো তর্ক প্রতিবাদ

আমার কথা ভাবোনি, বৌঠান
ছাদের ঘরে ভেঙে পড়ল চাঁদ

সেদিন থেকে জীবন খানখান
ছাদের ঘরে ঝুলছে কালো চাঁদ

তিন

কিশোর।…ওদের মারের মুখের উপর দিয়ে রোজ তোমাকে ফুল এনে দেব।

কোথায় আমায় দেখলে প্রথম?
কাঁধের ওপর কুড়ল নিয়ে
খনির মধ্যে যখন ঘুরি?

পায়ের রক্ত মাথায় ওঠায়
মগজ-খাওয়া যক্ষপুরী

কবে আমায় চিনতে পারলে?
লক্ষ্য করলে কবে প্রথম?
স্তুপ করা সব কাগজ-পাহাড়
তার ভিতরে তাকিয়ে আছে
রাস্তা খোঁজা অচেনা চোখ

তোমার দৃষ্টি পোড়ায়নি তো
যক্ষপুরীর কাঁচের ঝলক?

কবে কবে? কোথায় কোথায়?
এ-সব কথায় কী প্রয়োজন?

সামলে চলো সামলে চলো
বার্তা দিচ্ছে প্রহরীজন

সামলে চলার প্রশ্নই নেই
প্রেমের কাছে শাসন তুচ্ছ
এনে দিচ্ছি প্রহরীদের
মারের মুখের ওপর দিয়ে
তোমাকে এই ফুলের গুচ্ছ!

চার

…আমার মধ্যে যে-দুটি প্রাণী আছে, আমি এবং আমার সেই অন্তঃপুরবাসী আত্মা, এই দুটিতে মিলে সমস্ত ঘরটি দখল করে বসে থাকি- এই দৃশ্যের মধ্যগত সমস্ত পশু পক্ষী প্রাণী আমাদের দুজনের অন্তর্গত হয়ে যায়

সে বসে সামনে

এক জন্মের দূরত্ব কিছু নয়

ঘাটে ঘাটে, গাছে,
চালাঘরে ঘরে
পদ্মবোটের নীচে
সময় ঠেলছে…
গোপনে গোপনে মাটি নড়ে
মাটি ক্ষয়
পাড় ধ্ব’সে গেল
পতনশব্দ হয়
এক জন্মের দূরত্ব কিছু নয়

সে ব’সে সামনে, মুখে তার কালো ঢাকা

এক-মৃত্যুর দূরত্বে বসে থাকা

পাঁচ

দেহ মোর ভেসে যায় কালো কালিন্দীর স্রোত বাহি…

পাড়ে দাঁড়িয়েছি, আর, ও চলেছে ভেসে
সময়ের অন্ধকার কেশে
জড়িয়েছে মস্ত মাথা,
অন্ধ চোখ,
কাছি
গাছে রাখা ছিল, জলে সড়সড় সড়সড়
নেমেছে
চলেছে
গাছ
উপড়ে নিয়ে, পাশ্ববর্তী গ্রাম উপড়ে নিয়ে, টিলাখণ্ড,
প্রাণী, পশু, পাহাড়ের চূড়া
সব উপড়ে নিয়ে ওই কাছি ভেসে যায় ওই মাথা
ওই কেশের লহরী
হু হু ভেসে যেতে যেতে ডুবতে আসা সূর্যকেও
বেঁধে নিয়ে চলল আমি
পাড়ে দাঁড়িয়েছি, পাড়
নেই…

ছয়

এসো আমার অগ্রন্থিত
পৃষ্ঠা-সংখ্যা সীমানা দেয়
মলাটে পিঠ রেখে দাঁড়াও
আমি বইয়ের বাইরে এসে
তোমায় জোরে আঁকড়ে ধরি

জানাও কত শাস্তি জানো
ছন্দেশব্দে
কুদ্ধ পরী!

গ্রন্থে তোমার জায়গা হয়নি
গ্রন্থ থেকে বেরিয়ে এসে
তোমার সঙ্গে ধুলোয় লুটোই
রোদ বৃষ্টি ঝড়ের কাছে
পাঠ বুঝে নিই

এসো পরস্পরকে পড়ি

সাত

…সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়

শিরে বাজ পড়ে যদি, এ আশায় দাঁড়িয়েছি মাঠে
আমার কপালে ঝড় ফাটে

দাঁড়িয়েছ উল্টোদিকে, ঘুরে, বৃক্ষ ধ’রে-
সব যোগাযোগ বন্ধ ক’রে
থেকে থেকে বিদ্যুৎ ঝলকে
দেখতে পাই মানে-অপমানে ক্রুদ্ধ ও কে?
আমার মিনতি যায় অক্ষরে অক্ষরে
শিলাবৃষ্টিঝড়দগ্ধ অক্ষরে অক্ষরে

যদি ফেরো, ঝাটা মারো, সহিংস প্রণয়ে যদি ঘটাও হঠাৎ
শিরে অপরূপ বজ্রপাত

আট

ভাঙিলে দ্বার কোন্ সে ক্ষণ অপরাজিত ওহে।।
এসেছ প্রেম, এসেছ আজ কী মহা সমারোহে।।

ঝড়ের মতো এসে পড়ল আর একটা প্রেম!
এখন একে কোথায় বসাই
একটা ঘরে ঘরপরিজন, অন্যটাতে
লেখার কাগজ বইপত্তর
বারান্দাভর
অতিথ্‌-স্বজন!
কোথায় বসাই?
শক্ত হাতে সরিয়ে দেব?
এক আঘাতে
ছিন্ন করব
মন থেকে মুখ?
আমি কি আর তেমন কসাই!

বয়স যখন অল্প ছিল কেউ আসেনি
ঝর্না ঝোরা বনশ্রেণী
কেউ আসেনি

এখন এসে ঝড়ের মতো ধাক্কা দিয়ে
আমায় ফেলে
ব’সে পড়ল মাথা কাছে,
আঙুল দিয়ে
চুল নেড়ে দেয়
মাথার থেকে ছন্দ নিয়ে ছড়িয়ে ফ্যালে মাঠের ওপর
যেন আমি চল্লিশোর্ধ সংসারী নই
সতেরো পার কিশোর ছেলে
ছন্দেরা সব নিজের মতো উড়তে
উড়তে কেউ পাখি কেউ বৃক্ষ হল
কেউ চালাঘর
কেউ-বা তালশিখর হয়ে চুল ঝাঁকাচ্ছে ঝড়ের সঙ্গে
চুল ঝাঁকাচ্ছে, শিখর ভাঙছে, উড়ে পড়ছে বুকের ওপর…
জ্ঞান হারালাম…

সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি
সমস্ত মাঠ বৃষ্টিধোয়া
মাঠের ওপর দাঁড়িয়ে আছে
আধভাঙা গাছ, আধভাঙা ঘর
সবভাঙা প্রেম
অপরাজিত!

নয়

সুধা তোমাকে ভোলেনি

সুধা ভুলে গেছে। ভুলে যাওয়া তার কাজ।
নইলে একা সে বাঁচবে কেমন করে!

কবে কী বয়সে কার কাছে কোন্‌ ফুল
দিয়েছে কখন, মনে রাখলে কি চলে!

তাও সে নেয়নি, ঘুমিয়েই পড়েছিল
যাকে দিতে যাবে তারা সব ওরকমই

কবে কী চেয়েছে না-ভেবেই চলে যায়
যাকে বলেছিল সে বহু কষ্ট করে
এনে দেখে, নেই! বলেও যায়নি ‘আসি’

কবিও তো ভোলে, ভুলে যাওয়া তার কাজ
নইলে সে রোজ লিখবে কেমন করে!

স্কুল থেকে ফিরে, একলা বারান্দায়
সংসারহীন আপনি যেমন, সাদা চুল ডুরে শাড়ি
প্রতিটি পুরোনো কথা
ফের থেকে রোজ ভুলতে থাকেন
ভুলে যান, সুধামাসি!

দশ

বিশু।…তুমি এসে আমার মুখের দিকে এমন করে চাইলে, আমি বুঝতে পারলুম
আমার মধ্যে এখনো আলো দেখা যাচ্ছে।

সামনে দাঁড়ালে। চোখে চোখ গাঁথা।
বুকে গান লাগে। ঢেউ দেয় মাথা।

সামনে দাঁড়ালে, চোখে চোখ গেঁথে
কিছুতে পারিনি ছুটে চলে যেতে

সামনে দাঁড়ালে। চোখে গাঁথা চোখ।
জেগে ওঠে সেই ঘুমন্ত লোক

যে খেটে চলেছে খনিতে খনিতে
যে দেয় নিজের খুন শুষে নিতে।

তার মধ্যেই হঠাৎ কী আলো!
এ ভালো লাগায় মরে যাওয়া ভালো!

হোক তবে, তোক সেই মৃত্যুটি-
আলো উঁচু করে সুড়ঙ্গে ছুটি..

এগার

শুভেচ্ছা, অপরাজিত আলো
ভোর এসে জানলায় দাঁড়ালো

সারা রাত্রি রেখেছে সম্মান
শিমূলপলাশ ভরা প্রাণ

চুরি ক’রে দেখার কারণে
লুকিয়েছি আগুনের বনে

গায়ে অগ্নিগাছ জন্ম নেয়
লুপ্ত হও, হে ন্যায় অন্যায়

দেহ পেতে রেখেছে খোয়াই
ঘাটে ঘাটে আঙুল ছোঁয়াই

শরীর আনন্দে পুড়ে খাক্‌
কাল ভোরে পঁচিশে বৈশাখ

বার

নন্দিনী। পাগল, যখন তুমি গান কর তখন কেবল আমার মনে হয়, অনেক তোমার পাওনা
ছিল কিন্তু কিছু তোমাকে দিতে পারিনি।
বিশু। তোর সেই কিছু-না-দেওয়া আমি কপালে পরে চলে যাব। অল্প-কিছু-দেওয়ার দামে
আমার গান বিক্রি করব না।

সমস্ত না-পাওয়া আমি নিলাম দু’হাতে।
দ্যাখো, আর জায়গা নেই হাতে।
তুমি এসো অন্যদিন, অন্য কোনো লোক লিখবে সব।
আমি তো জীবিকাবদ্ধ, আমি তো সংসারবদ্ধ শব।

একদিন, কারো হাত ধ’রে, এই সোনার নগরে
এসেছি, এখন আর ফেরার উপায় নেই ঘরে!

আজ যে-খুপরিতে ফিরব, ছেলেমেয়ে মুখ চেয়ে আছে।
আর দেখা হতে নেই- আমাদের আসতে নেই কাছে।

সেই যে রত্নাকর ছিল, দস্যুতা জীবিকা ছিল তার।
আমার জীবিকা শব্দ। ‘প্রেম’ ছাড়া শব্দ আছে আর?

সে-প্রেমে দু-চার পঙ্ক্তি‌…এর বেশি অন্যায় করিনি।
রঞ্জন তোমার, জানি, এ-লেখাও তোমারই, নন্দিনী।