(আবহমান বাংলার বাউল-ফকিরদের প্রতি নিবেদিত)
সুর তো ফকির, চলে ধুলো পায়ে গ্রাম থেকে গ্রামে
সুরের মাথায় চূড়া, পরওয়ারদিগারের নামে
সুর তো গাছের পাতা, উড়ে পড়ে জলে সহজিয়া
বাউলে বীরভূম মাতে, দাওয়া ঘেরে কীর্তনে নদীয়া
গুবগুবি কোথায় বাজল, কোথা খোল, কোথায় দোতারা
দু’ঘর চারঘর, তবু বাংলা ভ’রে বাউলের পাড়া
খাড়া তালগাছ, শুকনো পুষ্করিণী, মাটি খানখান
পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো, দাওয়ায় জিরোতে বসল গান
তাপ্পি দেওয়া আলখাল্লা, ঝুলিটি ভিক্ষের চালে ধনী
কেউ সখীভাবুকী, কেউ রাধাশ্যামী, কিশোরীভজনী
কে ঢালে মনের দুঃখ জলে ঢেলে ভাবে ভালোবাসি
কে আসে তোমার কাছে গান শিখতে, ও খুশিবিশ্বাসী
ধুলোতে কুড়োয় ধূলি, ধূলি দেহতত্ত্বের দুপুর
গান বলতে পারি আজ্ঞে, কার্য নয়, নিষেধ গুরুর
পারি তো মাটির কাজ, পারি তো নালের কাজ, পারি
প্রতিবিন্দু ধ’রে রাখতে দেহের ভিতরে বিন্দুধারী
খাঁজকাটা খেজুর গাছ, গলার দড়িতে ঝুলছে হাঁড়ি
কুবিরে আরম্ভ কারো, কারো শুরু বলরাম হাড়ি
এত উপধর্ম এত ধারণ নির্ধন সম্প্রদায়
অজয়ের তীরে তাঁবু, কুপি জ্বলে আখড়ায় আখড়ায়
কুপি হাতে তুলে নিয়ে অচেনা কে নারী ডাকল, ‘চল্’
আমার একপায়ে ভয়, অন্য পদক্ষেপে কৌতূহল
তোমাকে চিনি না, কোন্ জেলের ঘরের মেয়ে তুমি
সাধনে সাহায্য করছ, না দেখব না, মাপ করো বোষ্টুমী
পালায় শহুরে লোক, না বুঝে একতিল গুহ্যকথা
কাপড়েচোপড়ে হল, ব্যাগে কাঁদছো ও খোকা ভদ্রতা
বাবুদের জন্য নও ওগো আল্লাতালা ব্ৰহ্মসাঁই
চরণ পালের বস্তু সুরে বলে কুবির গোঁসাই
সুর তো ফকির মাত্র, বটগাছের তলায় আস্তানা
তাকে পাখি পড়াবে কে? উঁহু, অত সহজ রাস্তা না
ও পাখি, পড়াতে গেলে যুগে যুগে শত শত ক্রোশ
পড়ুয়া পালিয়ে যায়, ধরে শুধু ছলছুতো দোষ।
আন্ধার করেছে বাইরে, নারীতে দৌড়িয়ে মরে মন
খোদার এমন সৃষ্টি, খোদা নিজে দেখবেন কখন
আকাশ খোদার চক্ষু, বাতাস খোদার করাঙ্গুলি
মাটি তো খোদার জানু, পাঁজাকোলা রমণীকে তুলি
মাতা ও সঙ্গিনী সে-ই, তার জন্যে সব ভোগরাগ
আল্লাধনি, রাইধনি, ললাট-তিলকে জন্মদাগ
গানের মানুষ আমরা, সব গোত্র-হারানো কাশ্যপ
নিকিরি, কৈবর্ত, বাগদী, কলু, জোলা, নমঃশূদ্র সব
আমাদের উপবীত ছিঁড়ে উড়ছে রামধনু আকাশে
আমরা দ্বিজোত্তম, আমরা গাইতে উঠি বোলপুরের বাসে
সুর, দোয়া করো, সুর, আজ্ঞা দাও ট্রেনের কামরায়
আমার ঘরের গানে যেন সব ঘর ভ’রে যায়
তিনটে কলেজের মেয়ে, জানালার ধারে মরীচিকা
কে চোখে তাকালো? আমি তার চোখে দেখেছি রাধিকা
আমার ঘুঙুর বোল, আমার আকাশছোঁয়া গলা
তাই শুনে শহর থেকে ছুটে এল, খসালো মেখলা
আমার নাচের ছন্দ তুমি বইতে পারো বা না পারো
মোমের পুত্তলী, আমি আগুন ফেলব না একবারও
ঝাঁপিয়ে লাফিয়ে কামড়ে উন্মাদিনী আকুলি বিকুলি
আকাশ কৃষ্ণের চক্ষু, বাতাস কৃষ্ণের করাঙ্গুলি
এ মাটি কৃষ্ণের জানু, পাঁজাকোলা শোয়াই মেয়েকে
বাপদাদা শহর থেকে ছুটে এল পুলিশকে ডেকে
যতবার নিয়ে যায় ততবার ফেরে ছুটে ছুটে
বর্ধমান থেকে আমি গান গাইছি রেলগাড়িতে উঠে
পাশে পাশে ও-ও যাচ্ছে আধময়লা শালোয়ার কামিজে
এত গরমের দিন, ঘাম মুছে-মুছে ওড়না ভিজে
অফিসবাবুরা দ্যাখে, সকলের বাক্যি হ’রে যায়
মেয়ের মা সাঁঝের বেলা ছুটে এসে ধরে দুটো পা-য়
হাতের বাঁধন পায়ে, হাতের বাঁধন গলা ঘিরে
শেষ রাতে বেরিয়ে পড়ি মা-মেয়ের মালাবেড়ি ছিঁড়ে
আমরা বাঁধনে ঢুকি, আমরা বাঁধন ছিঁড়ে
আসি আমরা মটুকধারী, চামার বৈষ্ণব, রুইদাসী
আমরা জেতের রূপ দেখিনি নজর ক’রে, তাই
যে কোনো ধানের শীষে শিশিরবিন্দুটি দেখতে পাই
মাঠে চলে শ্যালো পাম্প, আই. আর. এইট. দোলে ক্ষেতে
ইস্কুল বাড়ির মাঠে লোক বসে গোল পঞ্চায়েতে
পার্টির লোকেরা ঘোরে, ভোটের পোস্টার ডাইনে বাঁয়ে
ন্যাংটো-মেয়েলোক দেখা ভিডিও আরম্ভ হয় গাঁয়ে
জমিতে জমিতে দাঙ্গা, দিন-দুপুরে খুন হয়ে যায়
সন্ধেয় ঘরের সামনে মা-বহিন ইজ্জত খোয়ায়
কারা ঘোরে গ্রামে গ্রামে কালোচশমা মোটরবাইকে
কাদের ছাতখোলা জিপ অস্ত্র নিয়ে ফেরে দিকে-দিকে
থানার বাবুর সঙ্গে কাদের কাদের মাখামাখি
দু’ঘর তিনঘর আমরা, চোখে পড়লে চুপ করে থাকি
ঝুঁটি কেটে, দাড়ি চেঁছে, কৌপিন ছাড়িয়ে, ঘাড় ধ’রে
গত শতাব্দীতে কারা দিয়েছিল গ্রামছাড়া ক’রে
নায়েব গোমস্তা ছিল, লেঠেল পাইক পুরোহিত
তখনও সবাই বলত, চুপ করে থাকাই উচিত
চুপ করে ছিলাম, শুধু গান গেছে গ্রাম থেকে গ্রামে
গানের চূড়ায় দুঃখ, পরওয়ারদিগারের নামে
দুঃখের চূড়ায় সুর, যে তুলেছে ভোরবেলা আজান
যে ভুলেছে সব দুঃখ, আশ্রমে আশ্রমে বেদগান
আখড়ায় আখড়ায় খ্যাপা বলে, দ্যাখ্ সুরচন্দ্রোদয়!
জলে তার ছায়া পড়ে, আগুনে হল আগুনময়
আগুন শরীরে থাকে, হুতাশন সঙ্গে ওঠাবসা
দাঁড়িয়ে রাত্রির মাঠে সে দ্যাখে দিগন্তে তারাখসা
যখন সবাই ঘুমে, অচেতন গ্রামের ভিতরে
গান পৌঁছে দিয়েছে সে, রাত-টহলিয়া, ঘরে ঘরে
তারা ডোবা দেখেছে সে, মেঘে মুখ বাড়িয়েছে ঊষা
ওঠো যে-পাখির ডাকে, সেই পাখি লালন, দুদু শা’
মড়ক এসেছে, ধান মজুত হয়েছে গোলা ভ’রে
-খেয়ে মরেছে লোক শত বছরের আগে-পরে
বর্ডার পেরিয়ে আসা দলে দলে লোেক ঘড়ছাড়া
কাঁথামুড়ি বস্তামুড়ি- আকাশে আকাশভরা তারা
মারীতে উজাড় গ্রাম, ভেদবমি ডেঙ্গু কালাজ্বর
মরা লোকালয়ে চাঁদ, আস্তে চলো, যেয়ো না সত্বর
ফের গাছে ফুল আসছে, দুধ আসছে ধানের মরমে
ক্ষেতের ওপারে ক্ষেত, সরু নদী, জল বাড়ে কমে
নদীর দু’ধারে কুঁড়ে, মাটির দেওয়াল, খোড়ো চাল
বেড়ায় লাউয়ের লতা, নুয়ে আছে টগরের ডাল
পরের বর্ষায় ভাসবে, পালাবে ও-বাউল সংসার
মরশুম কাটিয়ে ফিরবে, ভাঙা ঘর ওঠাবে আবার
আবার গুবগুবি বাজল, বাজে খোল, বাজো হে দোতারা
দু’ঘর চারঘর, তবু বেঁচে থাকো বাউলের পাড়া
সব মাঠ, সব নদী, আসলে তো বাউলপাড়া-ই
আমরা সে-পাড়া দিয়ে লালন শাহের সঙ্গে যাই
ফকির চলেছে আগে, সুরে কাঁপছে গাছের পাতারা
শতাব্দী পরের কবি, আমি বাঁধছি আমার দোতারা
লোকে ভুল বোঝে, লোকে ভুল ধ’রে হেরে যায় কত
লোকের উত্তর তুমি- ও তোমার জয় লোকায়ত
তোমাকে শোনাবো, তাই মাঠ নদী বৃক্ষকে শোনাই
আড়াইশো বছর পরে আমিও কবিতা বেঁধে যাই
এখনো বসেছে মেলা, তাঁবু ভ’রে সুরকাব্যলোক
কম্বল, শীতের রাত্রি- সম্প্রদায় ভুলে যাচ্ছে লোক
ধন্য ধন্য করে সব- পাখি ডাকে- ভোর হয়ে যায়…
ফকির, তোমার বাংলা জেগে ওঠে আমার বাংলায়!