আমরা পথিক

আগুন উড়ছে
স্বপ্নের মধ্যে একটা মাঠ, সেই মাঠের শেষে
আগুন উড়ছে- গাছের আকারে আগুন

স্বপ্নের এ প্রান্তে আমরা। আমরা পথিক
সারা জীবৎকাল ধুলোপায়ে হেঁটে আসার পর
দিনান্তে থেমেছি এখানে
তারপর আমাদের তন্দ্রা এসেছিল
অর্ধেক রাত্রে তন্দ্রার ভিতরে হাওয়া ঢুকে পড়তেই
আমরা চমকে তাকিয়ে দেখলাম
আগুন উড়ছে
স্বপ্নের শেষপ্রান্ত দিয়ে তোমার আগুনের গাছগুলি
উড়ে যাচ্ছে দয়াল
জানি ওইভাবে তুমি আমাদেরও ফুৎকারে
উড়িয়ে নিয়ে ফেলবে
তোমার দয়ার মধ্যে চুবিয়ে মারতে
তার আগে একবার, শুধু একবারের জন্যে ওই মাঠে তুমি
নামাও তোমার অপ্সরাদের
ঘুমে ঢুলে পড়া ক্রীতদাস যেমন
প্রভুর এক চাবুকে জেগে ওঠে
তেমনি আমাদের বন্ধ হয়ে আসা চোখের পাতা
শেষবারের মতো তড়িৎস্পর্শে খুলে যাক

আমরা পথিক
গাছের পর গাছ থেকে পাতা যেমন খুলে আসে রাস্তায়
উলটে পালটে উড়ে চলে
আমরাও তেমনই খসে পড়েছি
ভিন্ন ভিন্ন সংসার থেকে সম্পর্ক থেকে বৃত্তি থেকে
ভিন্ন ভিন্ন জনপদ থেকে রাজদ্বার থেকে
শ্মশানবন্ধুর দল থেকে
খসে এসেছি উড়তে উড়তে চলেছি ঘাসের মাঠ বালুর মাঠ
জলামাঠের উপর দিয়ে
নুনের খাদ ডিঙিয়ে
পরিত্যক্ত বধ্যভূমি, মরচেপড়া কামান আর দুশো বছরের
ঘুমিয়েপড়া গোলাবারুদ মাড়িয়ে
পায়ের চাপে সব অভিশাপ মাটির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে
এসেছি, আমরা পথিক
আমাদের পায়ে কাঁচ পেরেক লোভ লিপ্সা ঈর্ষা আতঙ্ক ফুটেছিল

তুমি আমাদের পায়ের ক্ষত সারিয়ে তোলো, তৃণ

পথিককে সঙ্গে কিছু রাখতে নেই
তাই খুলে খুলে আমরা রাস্তায় ফেলতে ফেলতে এসেছি
রাগ অভিযোগ দংশনের ইচ্ছা
আমাদের এত দাও তত দাও এর দাবি
আমাদের পিঠে লাগানো বড় বড় বিজ্ঞাপন
ঝনঝন করে আমরা ফেলে দিয়েছি সড়কের উপর
আর আমাদের বন্ধুরা
রইরই ক’রে সেগুলোই তুলে নিয়ে গিয়ে ঘর সাজিয়েছে
শহর সাজিয়েছে
আমাদের সেসব নিয়ে কথা বলতে নেই
আমরা পথিক
আমাদের পথ এখন পায়ের তলা থেকে শুরু হয়ে
ওই মাঠের শেষ পর্যন্ত গিয়ে বাঁকা একটি রেখার মতো
শূন্যে উঠে গেছে

তোমার হাতের পাতায় একটি গ্রাম, ও দয়াল
তোমার অন্য হাতের পাতায় একটি আস্ত পর্বত
আমরা পথিক
কত কষ্টে পাহাড় ডিঙোই, ডিঙিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে
কত কষ্টে গ্রামে আসি
সে তো কেউ দাওয়ায় বসতে দেবে বলে
একঘটি জল দুটো বাতাসা দেবে বলে
আর সেদিন এমনই কপাল গৃহস্থের বাড়িতে আর লোক নেই
ওই ছদ্মবেশী রাজকুমারী ছাড়া
একটা হাতপাখা এগিয়ে দেবার সময় ফিক ক’রে
হেসেও ফেলবে যে
জলের ঘটি নেবার সময় হাত ঠেকে যাবে যার হাতে
জলের হাতের সঙ্গে ঠেকে যাবে তেষ্টার হাত
কাঠফাটা গ্রীষ্মের মধ্যে বুক ভরানো সেই তেষ্টা
যে জিজ্ঞেস করবে আমার বাড়ি কোথায়
আমার কোন দেশ
ও দয়াল তোমার এক হাতের পাতায় গ্রাম এক হাতের পাতায়
পর্বত
এক হাতের পাতায় নদীর পর নদীর রেখা এক হাতের পাতায়
মহাদেশ
এর মধ্যে কোথায় আমার বাড়ি কোনটুকুনি আমার গ্রাম
আমরা পথিক আমাদের উত্তর দিতে নেই

ছদ্মবেশী রাজকুমারী দাঁড়িয়ে থাকল বেড়ার ধারে
বিকেল শেষ হয়ে এল, পিছনে পড়ে রইল গ্রামের
শেষ গাছটাও
আমাদের পিছন ফিরে তাকাতে নেই

প্রেমিকারা অঞ্জলি ভরে আমাদের জীবনে ঢেলে দিয়েছে
বিদ্বেষ
অন্য প্রেমিক নিযুক্ত থেকেও তারা কখনও কখনও ঘাড় ঘুরিয়েছে

আমাদের ফিরে যাওয়া দেখে
অন্তত একটা হাত ছড়িয়ে ডেকেছে, এসো
ও হো হো করতে করতে দল বেঁধে ছুটে এসে আমরা
ধাক্কা খেয়েছি নিজেদের সঙ্গেই
আমার ঘিলুর সঙ্গে ওর ঘিলু আমার রক্তের সঙ্গে তার রক্ত
আমার কলজের সঙ্গে ভাঙাফাটা আগ্নেয়গিরির
দোমড়ানো হৃৎপিণ্ড মিশে গেছে
সেইসব হৃৎপিণ্ড খুঁজতে খুঁজতেই আমরা স্বপ্নের এই প্রান্তে এসে পৌঁছেছি
জ্বলন্ত ঘাসফুলের মতো দপদপ করে
মাটি থেকে তারা চিনিয়ে দিচ্ছে নিজেদের
তারা আমাদের পূর্ব পূর্বজন্মের হৃদয়
আজও তাদের গরল কিছু নামেনি
জ্বালা নরম হয়নি
কেন অমন করেছিলে সেদিন কেন অমন কেন অমন
বলতে বলতে তারা যুগ যুগ ধরে এই মাঠের মধ্যে আগুনের
বলের মতো ছুটে বেরিয়েছে
আমরা আজ তাদের জড়ো করলাম আমাদের অঞ্জলিতে
আজ আমরা তাকে ঢেলে দেব তোমার পায়ে
শত শত বছর ধরে যে বাসনা মেটেনি
তার ছোঁয়ায়, ও দয়াল,
দেখি তোমার পায়ের পাতা পোড়ে কিনা
দেখি কাম জাগে কিনা তোমারও

দয়াল, তোমার হাতের পাতার নাম স্রোত
তোমার স্রোতের নাম গানের ভেলা
তোমার গানের নাম জলের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ
যে গাছের নীচে সে এসে দাঁড়াত
সে তোমার কেউ নয়, দয়াল, সে আমার বন্ধুর প্রেমিকা
যদিও এক দুর্যোগের মধ্যে তার উপর ভেঙে পড়েছিল
আমার শরীর
সে অবাক হয়নি আমাকে চেপে রেখেছিল তার কোটরে
যতক্ষণ না আমার কাঁপুনি শান্ত হয়
পরে আমি তার দায়িত্ব নিলাম না, বন্ধুও ছেড়ে গেল তাকে
এরপর সে যদি কখনও ভুলক্রমেও আসে জলের ধারে
জল যেন আমায় আছড়ে ফেলে যেন
ঠুকে ঠুকে ভাঙে আমায় তার পায়ের পাথরে
চুরমার মস্তক তার পায়ের ঠেলায়
যেন তট থেকে গড়িয়ে পড়ে স্রোতে
স্রোত- তোমার হাতের পাতায় রক্তমুণ্ড
সমস্ত দিগন্ত লাল
এমন সূর্যাস্ত, দয়াল, তুমিও কখনও দেখোনি।

গাছেদের নাম গাছ
ধুলোদের নাম ধুলো
নদীদের নাম বলতে পারবে গ্রামবাসীরা
কিন্তু ঘরের নাম ঘর দাওয়ার নাম দাওয়া
দাওয়ার ধারে মেয়েটির নাম কী?
তা জানতে হলে তোমাকে নৌকো বাইতে হবে
গুন টানতে হবে
কাঠ কাঠতে যেতে হবে বনে
ডাকাতের হাতে পড়তে হবে
বেড়া ডিঙিয়ে পৌঁছতে হবে দাওয়ায়
দাওয়া ডিঙিয়ে ঘরে
ঘরের মধ্যে সে যখন আঁকড়ে নেবে তোমায়
তার ঘূর্ণির মধ্যে তলিয়ে যাওয়ার সেই সময়টায়
গাছের উপর আছড়ে পড়বে গাছ
ধুলোর ভেতর থেকে পাকিয়ে উঠবে ধুলিস্তম্ভ
গ্রামের উপর আছড়ে পড়বে নদী
তোমার মনে থাকবে না তোমার নাম ছিল পথিক
সেই নারীর বুকভাঙা দমক দমক আনন্দচিৎকারের নীচে
হুড়মুড় করে চাপা পড়ে যাবে তুমি

ও হো হো হো উল্লাস
আ হা হা হা উন্মাদনা
ই হি হি হি বদমায়েশী
এটা চোরেদের আড্ডা এটা গাঁটকাটাদের মেহফিল
এটা চুকলিবাজদের খাসমহল এটা নিমকহারামদের সরাইখানা
এখানে খাও পিয়ো জিয়ো ও হো হো আমায় প্রাণে মেরো না বাবা
এখানে ফেলো কড়ি মাখো তেল হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ তাহলে ওই
কথাই রইল
এখানে ফুর্তি শেষ ফুর্তি শুরু কথা পাক্কা ঠিক ঠিক শর্ত দিলে রাজি
এখানে হা-উস্‌-হুউ হাউই আতশ ফুটছে
তারা জ্বলছে তারা নিবছে রাতভর্তি বাজি
হা হা হা উন্মাদনা হো হো হো উল্লাস উঠছে
আকাশে আকাশে ঘুরে ঘুরে
নাচো বন্ধু, শত্রু নাচো, নাচো গো নারীরা জ্বলেপুড়ে…

লকলক করছে তোমার স্বপ্ন
পশুর মতো মুখ তোমার
মদে ডুবিয়ে রাখা তাকানোর নীচে ঠাণ্ডা অভিসন্ধি
ঘোর লাগানো হাসির পিছনে শাপদের দাঁত
তুমি রাত্রিবেলার মাঠ থেকে ভারী শরীর নিয়ে এসেছে আমার
ঘাড় কামড়ে টেনে নিয়ে
যেতে দাঁড়াও, সঙ্গীরা জেগে উঠবে, আমি নিজেই যাচ্ছি তোমার সঙ্গে
দাঁড়াও, ওদের টপকে আমার কাছে আসবার চেষ্টা কোরো না
এই তৃণের শয্যা ভেঙে যাবে তোমার থাবার চাপে
আমি নিজেই যাচ্ছি চিনিয়ে দিচ্ছি আমার
প্রধান রক্তবহা ধমনীকে
চলো ওই পাশটায়, এখানে না, হ্যাঁ দাঁত বসাও
কিন্তু রক্তের চাপে যে শ্বাসরোধ হল তোমার
চোখের তারা স্থির হয়ে গেল
তোমার জিভ বেরিয়ে গেল হে মোহিনীমায়া
আমি মাটি থেকে তুলে নিলাম আমার উত্তরীয়
অঙ্গবস্ত্র থেকে ঝেড়ে ফেললাম কাঁটা
ললাট বক্ষদেশ এবং ঊরু থেকে তোমার দাঁতনখের দাগ
ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে ফিরে এলাম সঙ্গীদের মাঝখানে
ওরা তখনও ঘুমিয়ে
একটু পরেই ওদের ডেকে তুলতে হবে
কারণ, আমরা পথিক
আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে ভোরের আগেই

১০

আমরা পেছনে ফেলে এলাম রাজসড়ক
সড়কে প্রতিদিন গতি আর রক্ত
আমরা পেছনে ফেলে এলাম ঘর
ঘরে প্রত্যেকদিন ক্ষুধা আর গ্রাস
পিছনে ফেলে এলাম বিছানা
বিছানায় প্রত্যেকদিন অতৃপ্তি
ফেলে এলাম সব স্থাবর অস্থাবর
সব অধিকার ও মালিকানা
হানাহানি আর প্রতিযোগিতা
চক্রান্ত আর মন্ত্রণা
আমরা ত্যাগ করে এলাম সব শর্ত
আমাদের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে কেবল
ঘাড়ের পেছনে বিধে থাকা একটি লোহার শলাকা
সে আমাদেরই কৃতকর্ম
এইবার সেই শলাকা আমরা উপড়ে ফেলব
ক্ষতগহ্বরের উপর চাপা দেব একমুঠো ঘাস

স্বপ্নের এ প্রান্তে আমরা রাত কাটিয়েছি
স্বপ্নের ওই প্রান্ত আর দেখা যাচ্ছে না
সেখানে ধোঁয়া উঠছে
উঠে পড় সঙ্গীদল
সার বেঁধে দাঁড়াই আমরা
দয়াল এবার হাঁ করবেন
তাঁর অন্ধকার গলার ভেতর থেকে উঠে আসবে একদলা সূর্য
এসো সূর্য, পুড়ে মরবার জন্য আমরা তৈরি