মা নিষাদ

স্তব্ধতা ফাটে, পাকিয়ে উঠেছে ধুলো
ধূলিস্তম্ভে মেঘযুথ মিশে যায়
ভূগোল ঘুরছে, ধক ধক করে চুলো
সূর্য লুপ্ত প্রায়

সূর্য তো নয়, কালরাত্রির চাঁদ
চাঁদ মুখে নিয়ে উড়ে যায় কালোপাখি
সেই চাঁদকেই বাণে বেঁধে উন্মাদ
ব্যাধ নামে তারে ডাকি

পুরাকালে সে-ই মিথুনাবদ্ধ প্রাণ
হনন করেছে তীরে আর বল্লমে
সেই অভিশাপ আজও তাকে দেয় টান
চাঁদ বাড়ে, চাঁদ কমে

আদিম অস্ত্রযুগ থেকে টানাটানি
মুখের খাবার মুখ থেকে কেড়ে খাওয়া
জিরজিরে গায়ে বল্কল, কাঁথাখানি
মাথার ওপরে সূর্য গরম তাওয়া

বালিতে শুকোয়, সমুদ্রজলে ভাসে
হতাহত দেহ, ভাঙা রথ, মৃত ঘোড়া
অস্ত্র মুঠোয় মুখ গুঁজে আছে ঘাসে
দুজন মানুষ, প্রতিবেশী ছিল ওরা

প্রতিবেশী, তার জমিটি, আমার চাই
প্রতিবেশী গ্রাম আমার অধীনে থাক
প্রতিবেশী রাজা আমাকেই কর দিক
আমার অস্ত্রে প্রতিবেশী ভয় পাক

প্রতিবেশীরা কি এই পৃথিবীতে থাকে?
তাদের বাতাসে, তাদের রৌদ্রজলে
আজ যদি বিষ মেশাতে বলি তোমাকে
মেশাবেই তুমি ছলে বলে কৌশলে

সে-ষড়যন্ত্র কৌশল লোফালুফি
উন্নতি করে প্রহরীবসানো ঘরে
প্রযুক্তি মেধা বিজ্ঞান চুপিচুপি
বুকে হেঁটে গিয়ে মাটিতে গর্ত করে

গর্তে উনুন, ধক-ধক করা চুলো
চুল্লী মাটিতে দাঁড়িয়েছে একবার
ছাতার মতন আকাশে ভস্মগুলো
পথ নেই পালাবার

ঢিলের মতন পাখি পড়ে দলেদলে
তীরে লাফ দিয়ে ওঠে বিষাক্ত জল
হাজার মাইল কণা কণা ছাই জ্বলে
হাজার মাইল পুড়ে যাওয়া জঙ্গল

পোড়া বাড়ি ভাঙা হাড়গোড় ইটকাঠ
স্কুপের পেছনে স্তৃপ ওঠা জনপদে
চুরমার মাটি, দগ্ধশস্য মাঠ
মানুষ মরেছে ঘরে দপ্তরে পথে

মানুষ মরেছে, জন্মেছে আরও আরও
বাঁকা হাত, ঘোর জড়ভরতের দেহ-
মুখে জিভ নেই পায়ে হাড় নেই কারও
জন্তুর মতো হামাগুড়ি দেয় কে ও?

পুরুষের বীজে বিষ এসে মিশে যায়
নারী ও শস্য ক্ষয়ে যায় পিঠোপিঠি
হেলিকপ্টার পাক মেরে গর্জায়:
একতিলও নেই রেডিও অ্যাকটিভিটি

তুমি কত সালে জন্মেছ বিজ্ঞানী?
কত সালে তুমি জন্মেছ হে শাসক?
তোমাদের ঘরে ছেলেপুলে জন্মেছে?
ঠিক-ঠিক আছে নাক মুখ হাত চোখ?

আমাদের আরও জন্মানোর কি বাকি?
আছে তুলে নেওয়া ধানের গুচ্ছ, ঘাস
আছে মাটি থেকে ডালে তুলে দেওয়া পাখি
গান বাঁধবার নানক তুলসীদাস

পোড়াগ্রাম দিয়ে তুলসীজী হেঁটে যান
ঘাটে ব’সে গান ভাসায় কবীর জোলা
শ্রীরামচরিত পথে পথে খানখান্
লালচোখ সাধু হাতে তলোয়ার খোলা

ও কবীর ভাই, কে তোমার গান শোনে
কে পাগল বলে বুঝিয়ে দে বুঝিয়ে দে
ফুটপাথে কারা পড়ে থাকে সারারাত
ও কার বাচ্চা খাবার চাইছে কেঁদে?
কোন বাচ্চাটা চা-দোকানে সারাদিন
খেটে খায়, খায় মালিকের থাপ্পড়
কোন মা নিজের ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে
খদ্দের নেয় রাত্তির থেকে ভোর

ওদের হালত, থাক, এরকমই থাক
ওদের জীবন ঢেলে দাও একখাতে
দুবেলা দুমুঠো খেতে পাক নাই পাক
তবু তো অস্ত্র এসেছে আমার হাতে

অস্ত্র মাটিতে, অস্ত্র আকাশগামী
দিগন্ত রাঙা অস্ত্রের মহিমায় রাঙা
অস্ত্রের কিরণ পড়েছে জলে
গ্রন্থসাহেব নদীজলে ভেসে যায়

সেই জলে ভাসে বেহুলার মান্দাস
মশারির নীচে শোয়ানো লখিন্দর
বিকলাঙ্গ সে, তেজস্ক্রিয়ার বিষে
থামে মান্দাস, একঘাট অন্তর

একেকটি ঘাটে থমকে একেক যুগ
নদী সমুদ্রে বিরাট সেতুর ছায়া
পঙ্গু কামড়ে ধরেছে তোমার বুক
স্বামী না শাপদ শিশুসন্তান মায়া

সন্তান আর শস্যের ভার ব’হে
তুমি শুয়ে আছ স্তব্ধ বসুন্ধরা
স্তব্ধতা ফেটে উখিত হয় কাল
মাথায় আকাশ- মুঠোয় দণ্ড ধরা

দণ্ডের মুখে গেঁথে আছে ভাঙা চাঁদ
পায়ের তলায় সমুদ্র আছড়ায়
কাঁধ ছুঁয়ে আছে পাহাড়ের উঁচু কাঁধ
রাত্রি লুপ্ত প্রায়

ভোরবেলা সেই মূর্তিটি নেই আর
সূর্যপূজারি আকাঙক্ষা করে তাপ
জেন্দ-অবেস্তা খুলে ধরে রোদুরে
তারও পৃষ্ঠায় তেজস্ক্রিয়ার ছাপ

ভূগোল ঘুরছে, ঘোরে নদী গিরিশিরা
লছমনপুরে শবমাংসের ঘ্রাণ
মাটির তলায় মাটি হয় ইহুদিরা
গণহত্যার কবরে দুলছে ধান

এই দেশ থেকে ও দেশে সূর্য যায়
নমাজে বসেছে গরিব মুসলমান
তার সাদা টুপি শান্তির পারাবত
তার খাওয়া হলে ঈশ্বর জল খান

কেউ চিনি রাখে পিপড়ের গর্তেও
ভাঙা চারাগাছে কাঠি বেঁধে দেয় কেউ
ধ্বংস, ধ্বংস, ধ্বংসেরা সত্ত্বেও
জাগে উদ্ভিদপ্রাণীপতঙ্গ ঢেউ

কে হিন্দু? এই জিজ্ঞাসে কোন্‌জন?
এই প্রশ্নের সম্মুখে তারা খসে
স্নান করে উঠে কুপিটি জ্বালিয়ে নিয়ে
নিরন্ন সাধু অন্নসমীপে বসে

আমরা সবাই অন্নের কাছে আসি
ঘণ্টা বাজছে গ্রামের গির্জেঘরে
নৌকোতে ফেরে কেরালার মাছচাষী
মা মেরী তোমার জীবন রক্ষা করে

রক্ষা তো নয়, প্রতিরক্ষার খাত
সেখাতে গড়ায় যুদ্ধ-আড়ম্বর
অজন্তা-ঘরে কালো হয়ে যাও একা
হে পদ্মপাণি, অবলোকিতেশ্বর

হাতের পদ্ম মাটিতে আছড়ে পড়ে
সে মাটিতে শুধু গহ্বর, গহ্বর
ফোয়ারার মতো মরুবালু ফুঁসে ওঠে
‘ছোট্ট বুদ্ধ’ হেসে ওঠবার পর

ভূগর্ভবিষ ফসলের দেহে ঢাকে
ও মেয়ে তোদের শরীরে শরীরে যায়
দূরে বসে কেউ বন্ধ্যা করেছে তোকে
তুই ভেবেছিস মাটিরই তো সব দায়

মাটিতে ছড়ানো প্রেমিকের দুটি হাত
সে হাতে ফাটল, ফেটে যাওয়া বাড়ি ঘর
ফাটা পাথরের মূর্তি পার্শ্বনাথ
মাটিতে শয়ান সব তীর্থংকর

ঠোঁটে চাঁদ ধ’রে উড়ে যায় কালো পাখি
ও মারণাস্ত্র, চাঁদ নয় বাস্তবে
পুরাকাল থেকে তীর তুলে আছে ব্যাধ
বোতাম টিপলে পৃথিবী ধ্বংস হবে

এসো কবি, এসো বাধা দাও, মা নিষাদ
বলে ওঠ তুমি, ভেঙে যাক উইটিবি
দিনের দুপাশে দাঁড়াক সূর্যচাঁদ
গুহায় জ্বলুক প্রাচীন চিত্রলিপি

ওই দেখ রাত বইছে গঙ্গাতীরে
ওই দেখ মাঝি দাঁড় টানে পদ্মায়
ওই শোন আমি আমরা যে-কথা বলি
কীভাবে সেসবই ভাটিয়ালি হয়ে যায়

ওই দেখ দূরে থেমে গেছে ধুলোঝড়
জ্যোৎস্না সাঁতরে শান্তির পায়রাটি
চালে ফিরে আসে, উঠোনের গম
খায় গম ভুট্টার জমিনে আমরা খাটি

ওই যে রাত্রি বইছে যমুনাতীরে
ওই যে এসেছে আমাদের শ্যাম-রাই
ওই শুনছ না, ভাঙা মন্দিরে বসে
প্রেম গাইছেন আমাদের মীরাবাঈ!

অতই সহজ আমাদের মেরে ফেলা?
আমাদের পায়ে রাত্রিচক্র ঘোরে
আমরা এসেছি মহাভারতের পর
আমরা এসেছি দেশকাল পার করে

নিষাদ, তোমার অস্ত্রের মুখে এসে
আমাদের গ্রাম হোক ধুলো, হোক ছাই
তৃপাকার ওই ছাইয়ের ভিতর থেকে
ওঠে নিরস্ত্র, আমরা দেখতে পাই

তার পশ্চাতে সমুদ্র ফুলে ওঠে
তার সম্মুখে মেঘে বাজ চমকায়

সে তোমার হাত মুচড়ে ধরেছে জলে
হাতের অস্ত্র মুচড়ে ফেলেছে জলে

দেখ ওই জলে সূর্য অস্ত যায়

অদূরে পাহাড়, স্রোত মাথা ঠুকে চলে

স্রোতের পিছনে সূর্য অস্ত যায়

ঘোরে শতাব্দী- সূর্য অস্ত যায়…