[জেহানাবাদে জমিদারগুণ্ডাদের গণহত্যার বলি ৬১। নিহতদের ৩৫ জন মহিলা আর শিশু। নকশালপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি হবার কারণেই এই লছমনপুর বাথে গ্রামটিকে বেছে নিয়েছিল ভূমিহারদের নিজস্ব বাহিনী রণবীর সেনা।-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ ডিসেম্বর, ১৯৯৭]
সেই যে সেই অন্ধকার মাঠের পরে মাঠ
সেই যে সেই ভোরবেলার ক্ষেতের পরে ক্ষেত
ক্ষেত পেরিয়ে ঝোপের পাশে হাঁটা পায়ের নদী
নদীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রেত
এপারে আর ওপারে গ্রাম, কুপি জ্বালার ঘর
ঘর না চালা? খাটিয়া বেড়া উঠোন চারপাই
মুর্গি ঘোরে- বালতি, জল, না-মাজা বর্তন
উনুনে পোড় ছাই
দাওয়ার পরে আলো-আঁধার ঘরের চৌকাঠ
চৌকাঠের পিছনে দুটো পা বেরিয়ে আছে
মুর্গি ওঠে দাওয়ায়, পায়ে ঠোকর মেরে যায়
প্রেত বসল গাছে
আকাশে ঠিক তেমনই এক ময়লা রঙ আকাশ
উঠোনে এলো আগের মতো শীত ভোরের রোদ
গাদি খেলার কোর্টের ওপর রক্ত শুকিয়েছে
শান্ত, কালো, ক্রোধ
হিংসা, রণ হিংসা, ঘন হিংসা-গোলা জল
পায়ের কাছে পুকুর, আর থেঁতলে যাওয়া ঘাস
হাতের কাছে পুকুর, তাতে সটান শুয়ে প’ড়ে
জল খাচ্ছে লাশ
কার বাড়ির মরদ? আজ খেতির কাম ছিল?
কার বাড়ির মরদ মেয়ে মজুর কার বাড়ির?
দেউড়ি-দ্বার-ফটক-জিপ-মালিক মহাজন-
সোনার তরবারি
কী নাম ওর? ওমপ্রকাশ? জটুয়া? ভিখু? রামা?
ক্ষেতের পরে ক্ষেতে কেবল নামবিহীন নাম
চরপোখরি, নগরকোঠি, চাঁদি, হায়াসপুর-
গঞ্জ, থানা, গ্রাম
খড়বিছানো মাটির মেঝে, জানলা ছাড়া ঘর
ছেলের মাথা মায়ের পিঠে- বোনের গায়ে দাদা
কোপের পরে কোপ পড়েছে, জলের কুজো ভাঙা-
রক্ত কাদা-কাদা
কোন জাতের রক্ত এটা? যাদব, না দুসাদ?
কাদের দিকে জল চলে না? চামার? ধোবি? কাহার?
নোটার থেকে হাতের কোষে এগিয়ে যায় জল-
মধ্যে ওঠে পাহাড়
তেষ্টা নিয়ে দুপুররোদে হাঁটতে থাকে মাঠ
আনন্দ তে হাত পেতেছে, চণ্ডালিনী কই?
কূপের ধারে ওরা দুজন পাতা উল্টে পড়ে
জাতপাতের বই
বই-এর ওপর শোন নদীর জলের ধারা বয়
ধুলো ওড়ার পুলিশ জিপ, ঠাণ্ডা ভোজপুর
চণ্ডালিনী খাটতে যায় দেউড়ির ভিতরে-
আনন্দ মজুর
বুদ্ধও তো এই জীবনে দলিত হরিজন
ন্যাড়া মাথায় ঝুলছে টিকি- খড়ের বোঝা ওঠায়
খাস পড়েছে পরিশ্রমের সহস্রটি শ্বাস
ধুলোর ঘোড়া ছোটায়
লু-এর ঘোড়া দৌড়ে যায়: ফসল আমার, আমার!
জমি আমার নেই বলে কি খিদেও থাকবে না?
মুঠোয় ধরি খাবার আর দৌড়ে আসে কারা?
বেসরকারী সেনা
কখনো শীত রাত, কখনো হোলির সাঁঝ বেলা
মাটিতে পড়ে দুখন, হীরা, লছমি পাসোয়ান
মরণপণ খাটার পরে ওদের ভাগে ছিল
দেড়-দু কিলো ধান
কুয়োর পাশে মদের ভাঁড়, রক্ত, ঘেঁড়া চটি
খৈনি ভরা ডিব্বা, মরা আঙুলে শুখা চুন
খাটা নিয়ম- নিয়ম ছেড়ে এক পা নড়লেই
খুন, কেবল খুন
ওই তো ধনরাজিয়া, ওর বাচ্চা ছিল পেটে
ঝাঁকিয়া, মোতি- ওদেরও ছিল গর্ভে ধরা প্রাণ
কজন মরে খুন করলে গর্ভবতী মা-কে
বলতে পারো, হে পরিসংখ্যান?
ঘাতকদল ঘুরে বেড়ায় দিন দুপুরবেলা
হাসে, গড়ায়, গল্প করে জুয়োখেলার ঠেকে
খুনির পাশে বন্ধু খুনি, হাতের পাশে জামিন-
পেয়েছে প্রত্যেকে
গ্রামে ঘুরছে পার্টির লোক, দু দল তিন দল
হতাহতের তালিকা বলে রিলিফ নিয়ে যাও
বিশ পঁচিশ তিরিশ কিলো শস্য মাথা পিছু-
হবিষ্যি বানাও
কড়াই তাওয়া ছত্রখান, দুমড়ে যাওয়া থালা
উঠোনে ঢুকে রিলিফপার্টি ডাকছে- ডাকছেই
ক্ষতিপূরণ নেবার মতো ওদের পরিবারে
মানুষ বেঁচে নেই
মানুষ নেই, প্রেত রয়েছে, প্রেত বসেছে গাছে
স্নানের পর নদীর থেকে উঠে এসেছে প্রেত
শীতের ঝিম দুপুরে তাকে অসাড় হয়ে দ্যাখে
রবিশস্যক্ষেত
ক্ষেতের পাশে শকুন খোঁটে কোন জাতের শব?
শস্যে কোন জাতের ছোঁয়া? লাঙল কোন জাত?
অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে পাহারা, তুমি যাও
গুঁড়িয়ে দাও হাত
পুলিশ এসে দাঁড়াবে, পাশে মালিক ভট্ভটি
পুলিশ, সাদা পুলিশ, খাঁকি পুলিশে ছয়লাপ
যতক্ষণ শেষ না হয় দাঁড়িয়ে থেকে ওরা
মারবে কালসাপ
চিতার পর চিতা পড়বে শোন নদীর চরে
আধপোড়ানো শরীরগুলো ক্রমশ কঙ্কাল
আবার লোক খাটতে যাবে, খাটার পরে এসে
চাইবে ফের রুটির পাশে ডাল
দেবে না কেউ দেবে না এই মাঠের পর মাঠ
ক্ষেতের পরে এই যে ক্ষেত, নদীর পাশে নদী
তোমায় দেবে ফসল, জল, কুটির, জনপদ
সাহস করে ছিনিয়ে নাও যদি
আক্রমণ করো নয়ত আক্রান্ত হবে
জোট বানাও, বন্ধু করো, ফিরো না এক পা-ও
লুকিয়ে থাকো পাহাড়ে জলে খনির গহ্বরে
উঠে আবার আগুনে হাত দাও
লুকিয়ে আছে গর্ভে শিশু, রক্তবীজ নাম
মাঠে যেভাবে তৃণাঙ্কুর দাঁড়ায়, সেইভাবে
গরিব হয়ে জন্ম নেবে ঝাঁকের পরে ঝাঁক
ঘুরে রক্ত খাবে
মারের মুখে মার দাঁড়াবে? শোকের মুখে শোেক
এই তাহলে উপায়? পথ? পদ্ধতি? সহায়?
ফিরে যাবার রাস্তা শুধু একদিকেই যাবে?
হত্যা থেকে পাল্টা হত্যায়?
তোমার মুখ কী ক’রে আমি হাতে ধরব তবে?
তোমার মাথা কী করে বুকে আঁকড়ে নেবো আর
তোমার ঠোঁট খুঁজতে গিয়ে মাটিতে ঠোঁট ঘ’ষে
কী পাবো আমি? মরা শ্রমিক নিহত ভূমিহার?
তোমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলে রক্ত উঠে আসে
তোমার মুখে পুরোনো সব হাড়গোড়ের ঘ্রাণ
মাটিতে নয়, তোমার দেহে কবর দিয়ে গেছে
ওরা আমার ঘরণী, ঘর, আমার সন্তান
এখনো বেঁচে রয়েছি কেন? শরীর ধ’রে আছি?
মাটিতে পিষে দিয়েছে এত ভয়ের পর ভয়
মাটিতে পিষে গিয়েছি তবু মাটি ধরেই ফের
উঠেছি কেন? তুমি বলেছো, এখনও হয়, হয়
বাজারে এসে পড়েছি, আর বাজার এসে পড়ে
আমার ওপর, নিজেকে তাই বিক্রি করি আজো
নিজের হাতে নিজেকে শেষ করে দেবার আগে
মনে পড়েছে তোমার মুখ: তুমি তাকিয়ে আছে।
তোমার হাতে কাটার দাগ, সে দাগে মুখ রাখি
প্রেত বসলো গাছের ওপর, ডেকেছে তক্ষক
যুগের পর যুগ পেরোল- আমার মনে আছে
এক পলক চোখের দিকে এক পলক চোখ
এখন তুমি কোথায়? কোন জলের নীচে আছো?
আমাকে তুমি শরীরে তুলে নাওনি কতদিন
ওঠানামার নৌকো যেত, সময় ছিড়ে গিয়ে
আকাশভরা গহ্বরের স্বর্ণরেখা…ক্ষীণ…
নীচে পৃথিবী ফিরে আসছে আবছা কথা কারও
জানলা খুলে গেলো হাওয়ায় চড়ুই ঢুকে আসে
হারিয়ে যাওয়া চোখের তারা, ছড়িয়ে যাওয়া হাত
শান্ত হল শতবছর এই হাতের পাশে
হঠাৎ কেন ধুলোর ঝড় ঢেকে দিয়েছে তোমায়?
হঠাৎ কেন শবের পাশে শব শুইয়ে রাখা
যেভাবে তোক এক খাটেই, এক ছাদের নীচে
কাটায়, বলে, সেটাই হল একসঙ্গে থাকা
বাড়ির পর বাড়িতে সেই একই খাটের শব
অফিসে ঘাটে বাজারে ঘোরে সেই শবের জোড়া
শোন নদীর চড়ায় জ্বলে শরীর সার সার-
কাগজ পড়ে, ভুলেও যায় মধ্যবিত্তরা
আমি কিন্তু ভুলিনি, এক মুহূর্তও নয়
আমাকে তুমি চেয়েছো সব বাধাবিপদ সহ
আমিও ছুটে গিয়েছি যত নিষেধ পার ক’রে
ভাবিনি এই পথশ্রম কঠিন, দুর্বহ
আসলে এই লড়াই সেও গেরিলা কায়দায়
আমাকে তুমি চেয়েছো আর আমি তোমাকে চাই
তোমাকে ভাল বাসতে গেলে যে জোরটুকু লাগে
আগুন মাটি জলের কাছে ঋণ করেছি তা-ই
এবার সেই ঋণের শোধ মাঠের পর মাঠে
নদীর পর নদীতে সেই ঋণ রাখার পণ
খেতি খামার খাটিয়া বেড়া উঠোন চারপাই
গ্রামের পর গ্রামে সমান ভূমির বণ্টন
তুমি আমার প্রেমের দিন, তোমাকে হাতে নিয়ে
দাঁড়াব আমি সভায়, পথে, আঘাতে, সম্মানে
তোমায় আমি ছুঁইয়ে দেব মরা দিনের গায়ে
খরায় আর অজন্মায়, জড়বধির প্রাণে
প্রেতের মুখ একপলকে ভস্ম হয়ে যাবে
শীতের ভোরে ঘিরে আসবে ডালপালার রোধ
মেয়েরা যাবে মেলার দিকে শিশুর হাত ধরে
জলের নীচে ঘুমিয়ে যাবে গতদিনের ক্রোধ
সূর্যে হাত রাখবে তুমি মাটি জলের মেয়ে
সূর্য জ্ঞান হারাবে; তুমি পারো? এমন পারো?
উচ্ছ্বসিত শরীর দুটি আগুন বীজধারা
আমাদের হত্যা করা যাবে না একবারও
আকাশ এসে দাঁড়াবে এই মাটিতে সেইদিন
তুমি তখন ফসল, আমি সকল গ্রামবাসী
তুমি তখন ঢোলক, নাচ, পরব, হোলিখেলা-
তুমি তখন আমার, আমি তোমাকে ভালবাসি