স্বপ্নে পাওয়া বাদল হাওয়া

[‘ভালোবাসা এসেছিল একদিন তরুণ বয়সে’
রবীন্দ্রনাথ, আরোগ্য ১৩ সংখ্যক কবিতা]

কখন আলো আমায় ঘুমের কালো ডালে ডালে বেঁধে দিয়েছে
তমাল
ময়ুর কখন রাত্রির সব পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে গৃহদ্বারে ফেরি
করেছে গান
আপনভোলা ও আপনভোলা, পথচারিণীর হাত এবার ভিক্ষা
দান করুক
প্রেমিকজনকে তোমার সকল শুভেচ্ছা
তোমার মতো নিঃস্বজনকে মন খুশি ক’রে দান করুক
একমুষ্টি তৃণ কেবল ধু ধু
একচাপড়া বালি কেবল উৎসর্গ করুক নদীবক্ষে, তাতেই হবে,
দরিদ্র ও দরিদ্র
এখন আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে
সাহায্য আসছে ওই সাহায্য আসছে ব’লে অপেক্ষা কোরো না
কালক্ষেপ কোরো না আর
কে ডাক দিয়ে গেছে লোকালয়ে লোকালয়ে আমার
চিন্তার ওপারে যত অরণ্য বনানী বীথিকা সব হাওয়ায় হাওয়ায়
হয়ে উঠেছে
একেবারে যাকে বলে ক্ষ্যাপা,
ক্ষ্যাপাটে মেয়ের মতো রাস্তা দিয়ে গান গাইতে গাইতে
চলে যাচ্ছে কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই গো পায়ে জুতো অব্দি
নেই তাই দেখে
দূরের সব দিক দিগঞ্চল আজ ঢেউ তুলে তুলে উড়ে আসছে
এদিকপানে আর
‘শ্রাবণ এসে গেছে শ্রাবণ এসে গেছে’ বলে এই
চৈত্র মাসেও কী অবাক কাণ্ড
ঘন গভীর মেঘে মেঘে একেবারে আকুল হয়ে উঠেছে আকাশ
প্রচণ্ড কী এক
হাওয়া ছুটছে সকাল থেকে তার পাগলামোর কোনো ঠিকঠিকানা
নেই
গাছগুলোও সব মাথা ঝাঁকাচ্ছিল এতক্ষণ মাতাল হয়ে ওই ওই
উড়তে শুরু করলো আর
উড়ন্ত সেই অরণ্যের মাথায় মাথায়
বেজে উঠলো ডম্বরু, ঘন ঘন গুরু গুরু, কাজলকালো বাদল
আমার বাদল

এই বাদল কালো স্বপ্নে স্বপ্নে সারারাত ঘুমের তলায় তলায়
কেবল
হেঁটে বেড়ানো আমার
সারারাত সেই এক মন ভোলানো সপার্ঘাত আমার শিরে যা আর
ভুলতে পারা যায় না বাকী জীবন

সাতসাগর ও সাতসাগর, আমি কোন্ উপায়ে তোমার অতরকম
তরঙ্গের
উচ্চাবচ চুড়ায় চূড়ায় ঢেউ খেলতে লাগলাম সেদিন দিকহারানো
জেলে নৌকো
কে যেন এক প্রবালদ্বীপ মাঝপথে থামিয়ে দিল আমায়, ঘর
বাঁধালো আমাকে দিয়ে
সেই কয়েকদিনের সামান্য আশ্রয়-
তাও ছেড়ে এলাম এক ভোরবেলায় স্বপ্নের মধ্যে সেই আদেশ
শুনলাম যখন
ছেড়ে এলাম স্বজনবন্ধু ছেড়ে এলাম মাথা রাখার কোল কাউকে
কিছু না জানিয়ে ছেড়ে এলাম
শৈলে শৈলে ধাক্কা লেগে আমার জেলে নৌকো, সেই তরী
আমার
হঠাৎ ডুবে গিয়েও
ভেসে উঠলো আবার, তারপর আর আমার কোনো বারণ
শুনলো না
আমার কোনো আপত্তি রাখলো না, আমায় নিলো,
বালির চড়ায়, জেলে ডিঙ্গির উপর
আমায় নিলো অজানা সেই মেয়ে…

দিনগুলির মৃত্যু। এই ধুলোর মধ্যে লুটিয়ে পড়া সন্ধে
তুমি যদি আমাকে চিনতে পেরে থাকো,
তবে দাও, আমাকে এবার বাড়ি পৌঁছে দাও
হাত ধ’রে ধ’রে ঘরে ফিরিয়ে দাও আমাকে!
আমি এক গীতিকবিতাকে অনুসরণ করতে করতে
এই এতদূর এসে পড়েছি এখন আর কিছু চিনতে পারছি না
সেই গীতিকবিতার ভিজে পায়ের ছাপ নজর করতে করতে
খুইয়ে বসেছি পরিণাম দেখার ক্ষমতা
আজ আমার চোখ পথ দেখতে দেখতে প্রায় অন্ধ
এ কথা বললে আজ নিজেরই কেমন লাগে, বিশ্বাসই হয় না
কিন্তু একদিন অন্ধকারে
পা এসে পায়ের পাতা চেপে ধরেছিল, ঠোঁট এসে
একদম মরীয়া হয়ে খুঁজে নিয়ে ছিল এই ঠোঁট
মাথাকে, বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে জোর ক’রে ডুবিয়ে মেরেছিল
সামান্য, সামান্য দুটি ঢেউ…

আর আমার সদ্য জেগে উঠতে পারা স্পন্দমান তরুণ অক্ষরের
উপর
নেশাগ্রস্তের মতো মুখ ঘষতে ঘষতে কেউ বলেছিল:
‘শান্তি দিচ্ছে না শান্তি দিচ্ছে না আমাকে কিছুতেই
এক মুহূর্ত স্থির থাকতে দিচ্ছে না এই লোকটা!’

দিনগুলির মৃত্যু হলো।
ও ধুলোর মধ্যে লুটিয়ে পড়া সন্ধে
ও গাছের পিছনে লুকিয়ে পড়া সন্ধে
তোমার দুটি হাত ধ’রে বলছি-একবার, আমাকে আর
একবারের
জন্যও কি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারো না কবেকার সেই শেষ
হয়ে যাওয়া
চুম্বনে?

কথা দিচ্ছি, তা হলে, একদম প্রথম থেকে
একদম নতুন একটা ভাষায়
আবার আমি লিখতে শুরু করব তোমাকে…

[আবাহন]
চলো সরল মৃত্যুভাষা
বাতাসপথের ঘুমন্ত এক জল
জলে সরল মৃত্যুভাষা
দৈব এসে ভর দিয়েছে শাখায়
নিশার পরে উষার পরে
ভোরে সরল মৃত্যুভাষা চল্‌
কাঁধের উপর চড়ুইপাখি
দৈব ভুলে কোন ফুলে যে তাকায়
ঘাসের পরে একটি শিশির
আর এক ফোঁটা জল হয়ে তার চোখে
পুস্পশাখা, পুস্পশাখা,
স্পর্শ দিয়ে যাও ঘুমন্তকে!

বলো সরল মৃত্যুভাষা
আগুনে যার আরম্ভ সেই ভূমি
ভূমিতে সেই বপন বলো
মৃত্যুকাল পেরিয়ে যাবে গান
পায়ের তলায় কী নদী তোর
কোথায় কোথায় বাঁক নিয়েছো তুমি
ভেজাও ভাষা জলঝারিতে
সকালবেলা মালিনীদের প্রাণ
যার কখনো প্রেম হয়নি
সে শুতে যাক রাঙানদীর কাছে
জ্বলো সরল ভাষা আমার
পাতায় পাতায় আগুন নেওয়া গাছে
পথের উপর ঘুমিয়ে পড়লো
হারানো কোন্‌ ভিখারিণীর ছেলে
স্পর্শ করো, পুষ্পশাখা,
স্পর্শ করো সমস্ত কাজ ফেলে।।