সোনার ধনুক

All the time I am working at
various heads and hands.
Letter to theo, Vincent Van Gogh.
January, 1885

সেই গল্প জানো, অন্ধকার?

জন্মের পিছনে জন্ম মুখে হাড় নিয়ে ছুটে গিয়ে
গাছের গুঁড়িতে ঠিকরে, স্বজাতির মুখে ভুক্ত হয়ে
মরণ কামড়ে দংশে জ্ঞাতিশত্রুভাইভগিনিকে
নিজের থাবার দাগ উদগ্রীব নাসায় চিনে চিনে
শেষ অবধি খুঁজে পেয়ে গুহা আর গুহার ভিতরে
নিজেরই মতন অন্য প্রাণী বা শ্বাপদ, ভক্ষ্য থেকে
শোণিতাক্ত মুখ তুলে যে বলে তোমারই মতো: আমার ক্ষুধার চেয়ে
মূল্যবান আর কিছু নয়।

প্রান্তরে চিৎকার করে ভয়
চাঁদ অর্ধচক্ষু আর তারাগুচ্ছ ভাঙা ভাঙা দাঁত
গৃহের সূচনা হয় নি, সমতলে উঁচুনিচু খণ্ড খণ্ড শিলা
জন্তুর বিলীয়মান শব
অধিকার করে আছে দীর্ঘকায় শীত
কে ওই অর্ধেক পশু অর্ধেক মানুষ পার হয় তৃণভূমি?
কী তার গন্তব্য? লক্ষ্য? প্রান্তরের পরে
মহাঅরণ্যের দেশ, ঘাসে গুল্মে শিকড়ে কণ্টকে
আচ্ছাদিত প্রতি পদক্ষেপে ওৎ পেতে আছে ক্ষুধা- খোঁড়াতে খোঁড়াতে
দৈব ও পুরুষকার জঙ্গলে ঢুকেছে
দুজনে দুদিক থেকে একে অপরের দিকে এগোচ্ছে না জেনে
মধ্যে গাছ, লতাজাল, বনের বিচিত্র শব্দ, পাতার খসখস
শাপদের উগ্র গন্ধ, নিশিপক্ষিণীর আর্তডাক
একে অপরের দিকে, একে অপরের দিকে, খুঁড়িয়ে, না জেনে…
ওদের কখন দেখা হবে? সেই গল্প জানো অন্ধকার?

মহাবালুকার দেশ, মরুভূমি রাত্তিরে হাঁপায়
কে ওই উটের মতো হাঁটুভেঙে ঘাড় গুঁজে আছে
ঝড়ে চােখ অন্ধ, দেহ চাপা পড়ে গেছে
অদূরে খেজুর গাছ উপড়ে পড়ল জলে
বালুকাপর্বত ভেঙে সে মাথা তুলেছে, কালো,
নিকষ প্রস্তরবৎ ছায়া
রোমশ পিঠের মধ্যে রাত্রি ধাক্কা খায়
সে মাথা ঝাঁকায় আর চিকিচিকি তারা খ’সে পড়ে
সে হাত বাড়িয়ে দেয় চাঁদে- চাঁদ দ্রুত সরে যায়
এই মেঘ থেকে ওই মেঘে
সে চলে পশ্চাতে, ছুটে, হুমড়ি খেয়ে, মরিয়ার প্রায়
মেদিনীর হৃৎপিণ্ড দু পায়ে মাড়ায়
মুহূর্তে বালুর দেশ পার হয়ে হাঁটুজল সমুদ্রে ছপছপ
চলে সে বৃহদাকার বামন- জগৎপ্রান্তে এসে
অতি আকাশের দিকে ঝুঁকে পড়ে-
চাঁদ
তার হাত পিছলে সরে যায়
এই সৌরলোক থেকে ওই সৌরলোকে…
ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কামসমাপন
কখনো ঘটে না তার- আক্রোশের তাপে
দুচোখের মণি গলে যায়
একদল তারা সূর্য নিভে গিয়ে অন্য সূর্যতারা
আকাশে গড়ায়
দুই অন্ধ চক্ষুর কোটরে
চাঁদের বদলে দুটি অসম্পূর্ণ চাঁদ
জ্বলে ওঠে কত কত কল্পান্তের পরে
কবিদৃষ্টি দেখতে পায় জগৎ আবার
সেই গল্প জানো, অন্ধকার?

শিকার ভ্রমণ করে বনমধ্যে, নিস্পাপ শিকার
শিকার পিপাসাতপ্ত ক্লান্তমুখ রাখে সরোবরে
শিকার শান্তির নিদ্রা বৃক্ষছায়াতলে ঢেলে দেয়
তুমিও তৎপর হয়ে শিবারূপ, ব্যাঘ্ররূপ, মাংসাশী পিশাচরূপ ছেড়ে
তার সামনে দেখা দাও মনোমুগ্ধকর কবিরূপে
ঋষিপুরুষের বেশ, দুচোখে সুদূর কোনো মায়া
প্রশস্ত ললাটে যশটিকা
শিকার তোমাকে দেখে চমকিত- পালাতে যেতেই
তুমি তার পথরোধ ক’রে
বসেছ ভূমিতে রেখে জানু
বলেছ হে অপরূপা, তুমি কি বৃক্ষের কন্যা? জলের ভগিনি?
তুমি মাটির সহোদরা?
শিকার হতচকিত! সে বলে না আমি…না, না…আমি…
-হ্যাঁ তুমি হ্যাঁ বলো সুলক্ষণা
তুমি কে? তুমি কি বনের জন্মদিন?
তুমি সূর্যের কোনো ছদ্মবেশী রঙ?
শিকার দুহাতে মুখ ঢেকে বলে আমি কেউ নই, আমি
যে হই সে হই না গো…না কেহই না…
তুমি উঠে দাঁড়িয়েছ, কাঁধ থেকে অঙ্গবস্ত্র ঝুঁকে
ভূমি স্পর্শ করে
শিকার মাটিতে ছোঁয়া শ্বেত উত্তরীয় ধ’রে ধ’রে
দৃষ্টি উত্তোলন করে তার। বলে, কিন্তু…
কিন্তু আপনি কে মহাত্মন?
-আমি কবি, আমি এই বনে
কেবল তোমার জন্যে এতকাল দেহ ধ’রে আছি
কেবল তোমাকে দেখতে পাবো এই অস্পষ্ট আশায়
এতদিন…এতদিন…আছি
-আমাকে? আমার জন্যে?
-হ্যাঁ আমি জানতাম, জানতাম
-কী জানতেন?
-জানতাম এমন কেউ আছেই কোথাও
আমার চিন্তারা যাকে জানে
জানতাম একদিন কেউ আসবেই আসবে যে আমার
সাষ্টাঙ্গ কল্পনা
-আমি?…আমি তাই?
শিকারের ঘোর কাটছে না
কিন্তু আপনি কী চান আমার কাছে, কবি?
-তোমার মাধ্যমে আমি শুধু
কয়েকটি শ্লোক উৎপাদন ক’রে নিতে চাই
-শ্লোক? আমার মাধ্যমে? আমার কি সে যোগ্যতা আছে?
-নিজেকে জানো না তুমি। তুমি শ্লোকসম্ভবা নীরব
আমি তোমাতে লেখনী দিতে চাই।
শিকার বৃক্ষের তলে বসে আছে। যেন মর্মে তার
প্রবেশ করছে না কিছু। তুমি বলো
ওঠো, চলো আমার কুটিরে।
-কুটির? কুটিরে কেন?
-শ্লোক আনয়ন কালে একত্রেই রচনাক্রিয়াটি
সম্পাদন করতে হয়। এই নাও আমার লেখনী, ধ’রে দ্যাখো
তুমি ভিন্ন এর তেজ আর কেউ ধারণযোগ্য নেই
শিকার বিস্ময়ে, লোভে, পাপবোধে, তীব্র পিপাসায়
নীল হ’য়ে যায়! বিস্ফারিত চোখে বলে
না প্রভু, এ শরীর আমার
প্রাচীন কালের শত্রু! এই চোখ, এই বাহু, গাত্রবর্ণ ত্বক
এই ওষ্ঠাধর, এই জিহ্বা, এই হাতের আঙুল, জানুদ্বয় আর…আর…
আর যা আপনার সামনে বলা যায় না সেইসব আশ্চর্যসম্পদ
সমস্ত, সমস্ত শত্রু- আমি শুধু এদের ভয়েই
লোকালয় ত্যাগ ক’রে বন থেকে বনান্তরে পালিয়ে চলেছি, আপনি
আমাকে ক্ষমা করুন, অনুগ্রহ ক’রে যাত্রাপথ
ছেড়ে দিন, যাই, আমি যাই
তুমি স্তব্ধ হয়ে রইলে। সে চ’লে যাবার উপক্রম
করতেই তোমার চোখ থেকে
উচ্ছ্বসিত হল অশ্রু, নিঃশ্বাস আওয়াজ করল, শরীরের ভার
দেহ বইতে পারল না, তুমি দুমড়ে ব’সে পড়লে ঘাসের ওপরে
হাত রেখে…বৃক্ষকূল
হঠাৎ চঞ্চল হল, পাখি ডেকে উঠল চারিধারে
শিকার তাকাল ঘুরে, এ কী? আপনি কাঁদছেন দেব?
আমি…আমি অন্যায় করলাম?
ব’লে সে পাগলপারা দৌড়ে এসে দুটি হাত পেতে
অঞ্জলিতে ধরে নিল তোমার সকল অশ্রু আর সেই জলে
তার হস্ত দগ্ধ হল, তার ওষ্ঠাধর
তার ত্বক, গাত্রবর্ণ, জানুদ্বয় আর যা যা তোমার সামনে বলা যায় না, সব
দগ্ধ, দগ্ধ হল- জ্বলতে জ্বলতে একাকী শিকার
নিঃশব্দে মিলিয়ে গেল আরো দূর বন অন্তরালে
স্বর্ণরঙ এক ধূম্ররেখা
জেগে রইল কিছুক্ষণ। লতাগুল্মে মিশে গেল তাও
আজও রাত্রে মাঝে মাঝে তার
জ্বলন্ত শরীর আসে জল খেতে ওই সরোবরে
তুমি কি আড়াল থেকে তাকে লক্ষ্য করোঅন্ধকার?

জগতে ক্ষুধার চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই
দৈব ও পুরুষকার সেই হেতু দুই দিক থেকে
জগতে ঢুকেছে, অস্ত্র পিঠে নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে
একে অপরের দিকে এগিয়ে চলেছে
বগবগ শব্দ শুনে একই পশুর দিকে বাণ
নিক্ষেপ করেছে দুজনেই
একই পাথর ঠুকে দুই প্রান্তে দুজনেই আবিষ্কার করেছে আগুন
একই গুহায় ঢুকে পথ হারিয়ে আত্তিলিও গাত্তির কঙ্কাল
পেয়েছে ডায়েরিশুদ্বু, ভূগর্ভে বিলীন স্নানাগার
হরপ্পা নগর খুঁড়ে উদ্ধার করেছে, একই
চাঁদের পাহাড়
খুঁজে বার করে ওরা গুহার দেওয়ালে
দুই দিক থেকে দুই ক্রুদ্ধ বৃষ ছুটিয়ে দিয়েছে
পাথরের ছুরি দিয়ে…অল দ্য টাইম
আই অ্যাম ওয়ার্কিং অ্যাট ভেরিয়াস হেড্‌স্‌ অ্যান্ড হ্যান্ড্‌স্‌
আই অ্যাম ওয়ার্কিং অ্যাট ভেরিয়াস হেড্‌স্ অ্যান্ড হ্যান্ড্‌স্‌
খনি শ্রমিকের স্কেচ, কয়লাবহনকারী পিঠ- মুখহারা-
আলুভোজীদের হাত, ঝোলানো নিষ্প্রভ লম্ফ, শক্ত আর বাঁকানো
আঙুল, ভাই থিও,
কেবল থালায় নয়, হাতগুলো থালার বদলে
মাটিকে খনন করে ঢুকেছে ক্ষুধায়
কারণ ক্ষুধার চেয়ে, কারণ ক্ষুধার চেয়ে মূল্যবান
আর কিছু…আর কিছু…আর…
সাইপ্রেস অ্যান্ড স্টারস্‌…মূল্যবান…মেয়েটির সঙ্গে থাকা…মূল্যবান
স্কেচ করা…হোক না সে গর্ভবতী, হোক না সে দেহোপজীবিনী
তার নগ্ন একা মুখ ঢেকে
বসে থাকবার নাম ‘দুঃখ’ ছাড়া আর কিছু হয়
দৈব না পুরুষকার কে এই মেয়ের ছবি আঁকতে পারে
শুধু আমি ছাড়া?
কাকেরা গমের ক্ষেতে নেমে আসছে, আমাকে আবার আসতে হল
সেন্ট রেমি স্যানাটোরিয়ামে-
সূর্যপুষ্প, হলুদ উজ্জ্বল সূর্যাধার,
কোন মাঠে জ্বলে উঠছে আজ?
দড়ির ল্যাসোর মতো সর্পিল গ্যালাক্সি নীহারিকা
ঘুরন্ত গোলার ন্যায় তারা আর তারা আর তারা
তলায় বসতি রেখে ঢেউমেঘ, মিনারচূড়া, বৃক্ষের পালকগুচ্ছ রেখে
আলোজ্বলা ছোট ছোট ঘননীল ঘরগুলি রেখে
ও স্টারি নাইট
আমার ক্যানভাস থেকে বয়ে যাচ্ছ আকাশে আবার
জগতে কোথাও কেউ জেগে ব’সে নেই
আমি ছাড়া আর
কেউ নেই
আছে এই উন্মাদ আগার
আমি আর উন্মাদ
আগার

তুমি উন্মাদের বন্ধু নও অন্ধকার?
জন্মের পিছনে জন্ম, ক্ষুধা চেপে, কাম সহ্য ক’রে
জগতে জগতে ফিরছ সেই হেতু দণ্ডকাষ্ঠ হাতে
সুর তোমার ভিতরে ঢুকে তোমাকে বিদীর্ণ ক’রে যায়
তোমার ওষ্ঠের শ্লোক তোমাকেই বলে: শান্তি
পাবে না কখনো
তোমারই হাতের তুলি, প্যাস্টেল, স্প্যাচুলা
তোমারই শোণিত, স্বপ্ন, সম্পর্ক, আকাঙ্ক্ষা ছিঁড়ে কুটে
ক্যানভাস জ্যান্ত করে দেওয়ালে দেওয়ালে
শুক্র ও শশাণিতযুক্ত হয়ে তুমি জননীজাতির গর্ভাশয়ে
যখন সমুদ্রে ছিলে- পারাপারহীন ঘোর নিশা
তোমার কপালে এক স্থির বজ্র বসিয়ে দিয়েছে
সেই অভিশাপে
আজীবন বিদ্যুৎ তোমার
পা থেকে মাথায় বইছে…তুমি শান্তি পাবে না কখনো
দৈব ও পুরুষকার তোমারই সন্ধানে এতকাল
মহাঅরণ্যের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে, এতকাল
মহামরু পার করে মহাগিরি কন্দরে কন্দরে
দুজনে দুদিক থেকে তাড়া ক’রে গেছে তোমাকেই
আজ তারা অস্ত্র ত্যাগ ক’রে
খোঁড়াতে খোঁড়াতে ক্লান্ত হ’য়ে
জগতের বাইরে এসে
দেখল সমুদ্রতীরে তুমি বসে আছো
তোমার মুখ থেকে একটি শ্বেতবর্ণ সহস্র শীর্ষের
রক্তবর্ণ মহানাগ
ক্রমশ নির্গত হয়ে সাগরে প্রবেশ করছেন,
তোমার নিস্পন্দ দেহ সৈকতে আসীন
পাশে পড়ে বিরাট লাঙল
দিগন্তে ছড়ানো হলচিহ্নিত পৃথিবী
ভূমিতে উদ্‌গত শস্যমুখ
দৈব না পুরুষকার এই শস্যে কার অধিকার?
অক্ষর আগুন ধাতু ঢালাই পাথর মাটি জল
বহুবিধ মাথা আর হাতে
তোমাকে গ্রহণ করছে
সাগর প্রান্তর বৃক্ষ বায়ু প্রাণ প্রাণের অতীত
সূর্যোদয় সূর্যাস্তসকল
তোমাকে বহন করছে স্বর্গ ও নরক ভেদ ক’রে
তলায় জনতালোক: এই দৃশ্য দেখে সকলের
শোক শান্ত হয়, সন্তাপ জুড়িয়ে যায় জলে
হে প্রেত, পিশাচ, দৈত্য, দেবতা হে কবি চিত্রকর
তুমি অন্ধকার নও- রাত্রির আকাশে
তোমার অশান্তি জ্বলছে দীর্ঘ এক সোনার ধনুক
ক্ষুধামূল্য তৃষ্ণামূল্যহারা
জন্মের পিছনে জন্ম এইমতো সে এক ভাবে জ্বলে-
আর প্রতি জন্ম থেকে সেই এক বন অন্তরালে লুপ্ত নারী
উঠে আসে
জ্বলন্ত শরীর নিয়ে বলে:
কই শ্লোক? শ্লোক ফিরে দাও!
আমার ওষ্ঠের থেকে যত বাক শোষণ করেছ
যত গান লুটিয়েছ এই জলে স্থলে
আমার জিহ্বায় জিহ্বস্পর্শ দিয়ে যত সরস্বতী
লুণ্ঠন করেছ একদিন- ফিরে দাও আজ
মরণকামড়ে দংশে, স্বজাতির মুখে ভুক্ত হ’য়ে
মাথা ঠুকে হাতের শৃঙ্খলে
শিকড়ে কণ্টকে বিদ্ধ আমি তো এসেছিলাম
আমি তো এসেছিলাম তবু-

শুধু কবি ডেকেছেন বলে!