উৎসর্গ: জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯-১৯৫৪
এক
১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯
সতেরোই ফেব্রুয়ারি কতই ফাল্গুন?
তারিখ পিছিয়ে যাচ্ছ পায়ে পায়ে, ডানায় ডানায়
সম্মুখে চলেছ দাঁড়
ছপছপ জল, তীরে,
দুই মাল্লা হাঁইয়ো-হাই গুণ
টেনে যাচ্ছ- টেনে যাও, জলধানসিঁড়িধারা
দুধারে মাঠের শেষে ধোঁয়া, পাতা-পোড়ানো আগুন…
এ তবে শীতের শেষ? ক’তারিখ? ক’তারিখ?
ঠিক দিন পেতে হলে যেতে হবে আরও কতগুণ
পথ?
জানি না, যতই যাবে দুপায়ে ততই জল,
তত বীজ,
ততই ফাল্গুন!
দুই
‘অন্ধকার থেকে এসে নব সূর্যে জাগার মতন’
একটি পাখি ডাকছে তার কাকলি মাধবীলতা যতটা বাগান…
আকাশে চক্কর মেরে মাথায় দু’-চারটি তারা ডুবে গেলে পর
এককোণে আড়ামোড়া ভেঙে উঠে সর্বনিম্ন ডালের উপর
হাফ হাতা গেঞ্জিপরা কনুই লাগিয়ে সোজা দাঁড়ান মালকোঁচা টানটান
কে উনি? কে উনি? ব্যক্তি? মহাশয়? বাগানের মালি বা দেখাশোনার লোক?
দুটি পাখি ডাকছে, তিনটি, কাকলি মাধবীলতা কতটা বাগান
পার হল? দোর খোলো, সারা মাথা তারা ডুবে সবাই যখন ঘুমচোখ
চারজন, পাঁচজন, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম পাখি জড়ো হচ্ছে ভুলে যাচ্ছে কাকলি বা গান
মাথায় চক্কর মেরে ভোর-অন্ধকার দেখছে, দুরে, হাওড়া ব্রিজের মাথায়
কুয়াশা সরিয়ে দিয়ে আবার অনেকদিন পর
শ্রীদাশ, জীবনানন্দ, কীরকম সূর্যটিকে তুলে দিয়ে যান!
তিন
কবিতার কথা এসো আমাদের পাতে ‘আহার’ শব্দটি রাখো আগে,
এসো আমাদের ঘরে রাখো আগে ‘বসত’ শব্দটি
একচুমুক জল দাও ‘ক্ষুধা’ শব্দ গিলে খাই রাগে
‘পূর্ণ’ শব্দটির সামনে জড়ো করো খালি কলসি ঘটি
সূর্য আর চাঁদ রাখো ‘শূন্য’ শব্দটির দুই দিকে
মধ্যে মধ্যে ভ’রে দাও বুটি তারা উল্কা ধুমকেতু
‘নদী’ শব্দটির পাশে পাড়াগাঁ-টি রাখো, আঁকো চালাঘরটিকে
‘পারাপার’ শব্দে রাখো খেয়ানৌকা, মাঝি আর সেতু
সেতুটি দিলেই দেখবে সেতু দিয়ে পৌঁছবে পাঠক
না-ই বা মীমাংসা হল ছন্দ অলঙ্কার দাঁড়ি কমা
কে কবি কে কবি নয় সে-তর্কে কুসুম আর কীট
এ ওকে মোক্ষণ করবে? ছিঁড়বে নাড়ি? কুঁড়ে দেবে পিঠ?
কোন তত্ত্ব সর্বজয়ী? কার পায়ে বিশ্বপরিক্রমা?
তত্ত্বের উপরে তত্ত্ব টেবিলে হাতুড়ি মারে: ঠক্!
হাতের ধাক্কায় ভাঙে কফিপাত্র, সমাপ্ত পাঁইট
একটি তিল খুলে নিলে ঝুরঝুর গড়ায় তিলোত্তমা
ধুলোয়- সে-ধূলাতল ফুৎকারে ওড়ায় ঘূর্ণিঝড়…
অসমাপ্ত লেখাদের শরীরে জন্মায় মাটি,
বুকে পিঠে পাখির আঁচড়!
চার
‘তার ভালবাসা পেয়ে ভয়াবহভাবে সৎ হয়ে আছি- ভাবি’
ঘরে ঠিক বনিবনা ছিল না? অবৈধ প্রেমে যেতে
সাহস ছিল না? তবে ভাড়াঘরে নতুন ভাড়াটে
বসাতে সাহস তো ছিল, সাশ্রয়ের কথা ভেবে? রাতে
বাতাসের রঙ দেখতে ভ্রমণ তত ছিল পূর্ণ একা!
পদচারণা তো ছিল জলের উপরে, মধ্যে? তলে তলে দেখা
জলের সমস্ত তারা, তারার সমস্ত নদী, নদীর সকল
লুকোছাপা অগ্নি স্বতঃশ্চল।
ছিল সব অভিজ্ঞতা। খানখান দাম্পত্য হাত পেতে
নিলে ও বহন করলে। আমার সন্দিগ্ধ মন বলে
নতুন সম্পর্ক এলে তুমি কি এগিয়ে যেতে,
জল কি ফিরিয়ে দিতে, শ্রীচরণকমলেষু, জলে?
পাঁচ
বেশি ঠেকে পড়েছি..এখুনি চার পাঁচশো টাকার দরকার। দয়া করে
ব্যবস্থা করুন। এই সঙ্গে পাঁচটি কবিতা পাঠাচ্ছি।
[পূর্বাশা সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে লেখা চিঠি]
বাড়িতে গঞ্জনা আর শনিবার নিন্দায় ভরানো।
চাকরিতে স্থায়ী নয়- আজ এখানে, তো কাল ওখানে
লেখায় রোজগার কত? হা কপাল, টাকা দিয়ে
বই ছেপে আনে
রাত্রে সেই পথ হাঁটা, তারা-মনুমেন্ট-কলকাতা
কুষ্ঠ, নারী, লোল নিগ্রো শহরের নিম্প্রদীপ মাথা
দাঙ্গা ও লঙ্গরখানা, লিবিয়ার জঙ্গলের দানো…
বাড়িতে ফিরলেই ঝগড়া? বাড়িওয়ালা? ভাড়াটে ওঠানো?
কী করে সংসার চলবে? স্ত্রী বলেন ভগবানই জানে
কিন্তু তোমরা ভগবান মানো বা না-মানো
লোকটা যে কী করে লিখতো এর পরেও- সত্যি কেউ জানো?
ছয়
‘বরং নিজেই তুমি লেখো না কো একটি কবিতা’
দোষ, দোষ, দোষী…কেউ সমস্ত তোমার মন ভেঙে
ছড়িয়েছে টুকরো টুকরো এই ক্ষেতে-মাঠে
কোনোটি জোনাকপোকা হল তার, কোনোটি ফড়িং
উড়ে উড়ে দিনরাত্রি কাটে।
কেউ লিখতে ডাকল না। খাতা খাতা উপন্যাস লিখে
শুয়ে পড়লে ট্রামের তলায়
বুক থেকে চাকা ঠেলে উঠে পড়ল লেখা সব-
লাইনের পাশে
কাটা সমালোচক গড়ায়।
আমরা তার রক্তমাখা মুখ থেকে শেষ হাসি পান করলাম
আমাদেরও গ্লাস রক্ত ভরা
ঠোঁট তুলে থমকে আছি দু-এক সেকেন্ড-
এক্ষুনি আরম্ভ হবে পানোৎসব, হুল্লোড়, মশকরা।
তার আগে জোনাকপাখি, কোন ফাঁকে তার আগে ফড়িং
ঢুকে এল? ধর, ধর, একযোগে হুমড়ি খেয়ে ধরে দেখি,
মরা!
দোষ, দোষ, দোষী..কেউ কবির সমস্ত মন
দলে পিষে ভেঙে
একটু একটু ক’রে গড়ছে, প্রতিদিন এই বসুন্ধরা।
সাত
‘তবু এই ভালবাসা ধুলো আর কাদা’
তুমি কাকে ভালবাসতে? তেমন কেউ এসেছে জীবনে?
এই মাত্র মেঘ ছিল, এইমাত্র বাইরে এল চাঁদ
এই মাত্র শীত ছিল, এই মাত্র তীব্র দাবদাহ
এই চলল সুস্থ পথ, এক্ষুনি পায়ের নীচে খাদ
পিছলে পড়ে যেতে যেতে, নিমেষে ঝুলন্ত ডাল ধরে
বেঁচেছ?
পা রেখেছ তো? দেয়াল বেয়ে উঠেছ তো ঠিক?
জানতাম পারবে তুমি, পারা স্বাভাবিক।
তোমার পায়ের কাছে বন্ধ হবে হাঙর চোয়াল
কিন্তু ধরতে পারবে না। তোমাকে ডুবিয়ে মারতে চেয়ে
আজীবন আছড়ে পড়ে, ঝাপটে ঝাপটে মরে যাবে ঢেউ…
কে তোমাকে ভালবাসতোর লুকিয়ে কি চিঠি লিখত কেউ?
আট
কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সব সময়ই শিল্প সৃষ্টি করবার আগ্রহ, তৃষ্ণা…কারুকর্মীর এই জন্মগত অভিশাপ আমার সমস্ত সামাজিক সফলতা নষ্ট করে দিয়েছে।
[কারুবাসনা। উপন্যাস।]
জানলা দিয়ে আলো আসছে, একটি টেবিল মাত্র জেগে…
কে ঝুঁকে খসখস লিখছে? পেনসিল এক পৃষ্ঠা শেষ ক’রে
অপর পাতায় উঠে দম নিল: কমা ড্যাস সেমিকোলোনের
দম, স্বাস, বাঁক ফেরা…ধাক্কা খাওয়া প্রত্যেক পাথরে
প্রতি মুহূর্তের শ্রম। এক বিন্দু শিল্প উপার্জন।
এর জন্য শব্দ কাটা, অর্থ ভাঙা, লাইন বদলানো।
এ জন্য সে রাত্রি জাগে। বালতিতে গলানো লোহা ঢালে
দু হাতে দু বালতি নিয়ে উঠে ওই পাহাড়ে দাঁড়ালে
দেখা যায় ধোঁয়া উঠছে, না, হাতের বালতি থেকে নয়
ঢাকনা খোলা করোটির বাষ্প ধোঁয়া ছাই শেষ ক’রে
আকাশে লকলক উঠে হাঁপ ছাড়ছে স্বয়ং আগুন
এসবই কথার কথা। রুজিরোজগার খুঁজতে তার
সারাদিন হয়রানি। তাকে ঘিরে হতশ্রী সংসার
তাও রোজ রাত্রিবেলা বালতি করে গলে যাওয়া লোহা তুলতে গিয়ে
হাতপোড়া বুকপোেড়া ওই মানুষটা পাহাড়ের ঢালে
জ্ঞান হারিয়েছে। পাশে বউ ছেলে মেয়ে কেউ নেই
কারোকে সন্তুষ্টি দিতে, শান্তি দিতে, পারেনি যেন সে-
অথচ এক মাইল শান্তিকল্যাণ করে রেখেছিল পৃথিবীকে
দু’চার পৃষ্ঠায়
শিল্পের পিছনে ছুটে, শিল্পের সম্মুখে ছুটে শেষে
হাতের ওই একমুষ্টি অগ্নিরজ্জু জড়িয়ে পেঁচিয়ে নিংড়ে তাকে
ঘষটাতে ঘষটাতে চলল রাসবিহারী অ্যাভেনিউতে
দু দশ পঞ্চাশ একশ গজ…
মানুষটা পড়েই থাকবে? না কি সে ধড়মড় উঠে
গা থেকে জড়ানো ওই লৌহসর্প খুলে
বাঁকিয়ে আবার গড়বে রূপ, মূর্তি, ছন্দ, বাঁক?
ধরবে সে অদৃষ্টপূর্ব গতি আর পথ?
কী হবে জানি না, শুধু আমরা দূর থেকে দেখছি
জানলা দিয়ে আলো আসছে,
খসখস পেনসিল চলছে, আর
জানলার বাইরে রাত জেগে
লেখা নিতে এসে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাবীকাল!
উপসংহার
‘গ্রাম পতনের শব্দ হয়’
রক্ত আগুনের পারে গুঁড়ো গুঁড়ো উড়ছে জলকণা
ভাঙা দেবালয়, মজা পুষ্করিণী নোয়া বাঁশবন
উঠোনে শুকোনো রক্ত, দগ্ধ চালা, সমস্ত পুরুষ পলাতক
পাশের গ্রামের শত্রু আগুন দিয়েছে পড়শিঘরে
রাত শেষ হয়ে এল, মেঘলা ভোরে বৃষ্টি দেখা দেয়
ভাঙা আটচালায় বসে একটি রমণী, চুলে জট
বাঁশের খুঁটিতে মাথা এলানো রয়েছে, শুন্য চোখ
খুনের পিছনে খুন, পালানোর পিছনে পালানো
গ্রামের পিছনে গ্রাম, হ্যাজাক দুলিয়ে ফিরছে লোক
মাটিতে চাটাই পাতা ভি.ডি.ও.-র হল থেকে লোক
জেনারেটরের শব্দ, নিশিডাক ডেকে ফিরছে লোক
ধান কেটে নিচ্ছে লোক, নারীকে দখল করছে লোক
গ্রামপতনের শব্দে উঠে আরও একজন লোক
দাঁড়াল মাঠের পারে। মাথায় পাখির বাসা, ঘাস
অন্ধকারে এতদিন সে ছিল ঘাসের মধ্যে ঘাস
চুলে ঘাস, চোখে ঘাস, কাঁধে পিঠে ঘাস, শুধু ঘাস
কেউ লক্ষ করছে না, কেউ চিনতে পারছে না এবারও
রক্ত আগুনের পারে আবার মাঠের আল ধ’রে
ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে, আনমনে, মাথা নিচু ক’রে
একশো বছরের দিকে হাঁটছেন জীবনানন্দ দাশ!