আবাহন


এস এনাতুল্লা করি আবাহন
আমরা মোস্লেম ভিখারী নির্ধন,
কি দিয়া করিব প্রীতি সম্ভাষণ
কি আছে এখন মোদের ঘরে!
তুমি কাবুলের রবি জ্যোতিষ্মান
কি দিয়া করিব তোমার সম্মান,
আমরা ভিখারী মোস্লেম সন্তান
ভিক্ষা বুলি আজি মোদের করে!


যাদের প্রতাপে কাঁপিত অবনী,
বিজলীর বেগে নাচিত ধমনী,
ছিল যারা ভবে নৃপকুল মণি,
আজি সে মোস্লেম কি ছার বেশে,
তুচ্ছ এক মুষ্টি অন্নের লাগিয়া,
দ্বারে দ্বারে হের বেড়ায় কঁদিয়া,
গোলামী করিয়া পাদুকা বহিয়া
যাপিছে জীবন দারুণ ক্লেশে!


এ মোম্লেম যেন সে মোস্লেম নয়,
এরা ভীরু, তারা বীরেন্দ্র তনয়,
সে কথা ভাবিলে কাঁদে এ হৃদয়,
ছিল তারা বিশ্বে প্রবল জাতি!
হুঙ্কারে তাদের কাঁপিত ভুবন,
বীরত্বে তাদের ভীত দেবগণ,
কে জানিত হবে তাদের পতন?
নিয়তির খেলা ভীষণ অতি!


মোস্লেমের শিল্প, মোস্লেমের ধন,
মোস্লেম-বীরত্ব বিখ্যাত ভুবন,
ঐশ্বৰ্য্য বৈভব বিজ্ঞান দর্শন,
কি ছিলনা হায় মোস্লেম-ঘরে!
আছে কি সে সব এ নশ্বর ভবে?
অদৃষ্টের দোষে ঘু’চে গেছে কবে,
কি ছিল মোস্লেম কি হ’য়েছে এবে
আরো বা কি হবে দুদিন পরে!


তুমি কাবুলের নৃপতি-নন্দন,
মোস্লেমের দুঃখে বিষাদিত মন,
এসেছ ভারতে করিতে দর্শন
মোস্লেমের সেই-ভৈরব-কীৰ্ত্তি!
কি দেখিবে আর, কি আছে এখন?
যা ছিল সকলি হ’য়েছে স্বপন,
নাই সে ঐশ্বৰ্য, ময়ুর আসন,
আছে শুধু এবে সাধের স্মৃতি!


ভারতের আর কি দেখিবে তুমি,
ভারত এখন ঘোর মরুভূমি,
হৃদয়ে তাহার অনলের খনি,
নাই আর সেই সৌন্দৰ্য রাশি!
ভারত এখন মোস্লেম-শ্মশান!
দেখিলে সে দৃশ্য ফেটে যায় প্রাণ,
ভিক্ষাই তাহার জীবিকা প্রধান,
বিলুপ্ত তাহার মুখের হাসি!


দেখ যেয়ে তুমি আগ্রার সে তাজ,
সেই সেকেন্দরা দেখ যেয়ে আজ,
রয়েছে পড়িয়া হৃদয়ে লইয়া
মোস্লেমের সেই অতীত স্মৃতি!
সেই যে যমুনা- আজিও বহিছে,
সেই শোক-গাথা আজিও গাইছে,
স্বনিয়া স্বনিয়া সমীর বহিছে!
বিহগ গাইছে করুণ গীতি!


দেখ যেয়ে দিল্লী, সে দেওয়ান খাস,
সে শিশ্‌, মহল, সৌন্দর্য-আবাস,
সে জুমা মস্‌জিদ দেখ যেয়ে আজ,
গাইছে তাহারা কি শোক-গাথা!
দেখ যে’য়ে সেই কুতব মিনার,
সে মতি মস্‌জিদ, হেরম শাহার,
সে রঙ্গমহল সৌন্দৰ্য-আধার,
হৃদয়ে পাইবে দারুণ ব্যথা!


আজিও যমুনা “কুলু কুলু” তানে
কহিছে কাঁদিয়া আকুল পরাণে
“এই স্থানে- এই গভীর শ্মশানে,
ডুবেছে মোস্লেম-গৌরব-শশি!
চারিদিকে আজি ঘোর অন্ধকার,
একটিও আলো নাহি জ্বলে আর
গ্রহ তারা গুলি পড়েছে খসি!

১০
দেখ যেয়ে সেই লখ্‌নু নগরী
ভূতলে নন্দন সে কায়সর মরি,
রয়েছে পড়িয়া মরু দৃশ্য ধরি,
সরযু আজিও কাঁদিছে কত!
দেখ যেয়ে আজ সে মুর্শিদাবাদ,
দেখ যেয়ে আজি সে রাজ-প্রসাদ,
স্মরিলে সে কথা প্রাণে অবসাদ
যে সুখ-সৌভাগ্য হ’য়েছে গত!

১১
দেখ যেয়ে সেই শিকরি নগর,
সে পঞ্চ মহল প্রাসাদ সুন্দর,
কিরণ মিনার কত মনোহর
ভগ্নবেশে আজি রয়েছে পড়ে!
দেখ যেয়ে গৌর, সেই সপ্তগ্রাম,
সে চারু পাণ্ডুয়া স্বর্গ সমধাম,
চিহ্ন মাত্র নাই- আছে শুধু নাম,
স্মরিলে ও আজি শোকাশ্রুঝরে!

১২
দেখ যেয়ে ঢাকা সুদৃশ্য নগর,
দেখ যেয়ে তার দুর্গ দৃঢ়তর,
হোসেনি দালান ঈদগাহ্‌ ঘর,
হৃদয়ে লইয়া স্মৃতির গাথা!
শশানের মত রয়েছে পড়িয়া,
কক্ষে কক্ষে আজি দেখ গে ভ্রমিয়া,
প্রতিধ্বনি আজ কহিবে কাঁদিয়া,
মোস্লেম সৌভাগ্য ডুবেছে হেথা

১৩
যাও গিরি চূড়ে হিম্রাদি-শিখরে,
যাও দাক্ষিণাত্যে বঙ্গোপসাগরে,
যাও ভারতের নগরে নগরে,
জলে স্থলে শূন্যে বলিবে সবে!
“মস্লেমের কীৰ্ত্তি কি দেখিবে আর,
মোস্লেমের ভাগ্যে অনন্ত আঁধার,
সে জাতির দুঃখে ফেলে অশ্রুধার
এমন সুহৃদ নাই এ ভবে!”

১৪
আজি তাহাদের দুর্দ্দশা ভীষণ,
ধরম করম তেয়াগি আপন,
বিলাসের স্রোতে হয়ে নিমগণ,
ঘোর পাপাচারে সদাই রত!
হারায়েছ তাই ঐশ্বর্য্য গৌরব,
হারায়েছে তাই বিপুল বৈভব,
এ দুঃখ যাতনা কার কাছে কব
অরণ্যে বসিয়া কাঁদিব কত!

১৫
দয়া করে তুমি এসেছ যখন,
আমাদের হায় করিতে দর্শন,
আর কি দেখিবে, কি আছে এখন,
আমরা এখন পতিত জাতি!
আমাদের আর নাই সে সম্মান,
আমাদের আর নাই সেই প্রাণ,
আমরা এখন ভিখারী সন্তান,
নাই আমাদের গৌরব-ভাতি!

১৬
আমরা এখন পেয়াদা পীয়ন,
আমরা এখন মুটে নরাধম,
আমরা এখন ম্লেচ্ছ যবন,
ইহাই মোদের অদৃষ্টে লেখা!
আমাদের সব ডুবেছে সাগরে,
আমাদের সব গেছে ভেঙ্গে চুরে,
ভাবিতে সে কথা হৃদয় বিদরে,
নাই সে সৌভাগ্য কণকরেখা।

১৭
নিজ রাজ্যে তুমি যাইবে যখন,
কত বীর পুত্র কত মহাজন,
আসিবে তোমারে করিতে দর্শন,
জিজ্ঞাসিবে সবে মোদের কথা!
কি বলিবে তুমি?- বলিও তখন,
জীবিত মোস্লেম নাহি একজন,
কেবলি সমাধি করেছি দর্শন,
ভগ্ন বেশে পড়ে কাঁদিতেছে তথা!

১৮
দেশে দেশে তুমি করিও প্রচার,
ভারতে মোস্লেম নাহি কেহ আর,
সে রাজ্যের যারা ছিল কর্ণধার
বহু দিন তারা গিয়াছে মরে!
ভারত এখন মরুভূ সমান,
কেবলি সমাধি, কেবলি শ্মশান,
হেরিলে সে দৃশ্য ফেটে যায় প্রাণ!
চৌদিকে কঙ্কাল রয়েছে পড়ে!

১৯
ভারতপ্রকৃতি কঁদিছে নীরবে,
বহিছে সমীর হাহাকার রবে,
মোস্লেমের দুঃখে শোকাকুল সবে,
চারিদিকে আজি বিষাদ-স্মৃতি!
সৌভাগ্যের সনে গিয়াছে সকলি,
ঐশ্বর্য্য গৌরব সব গেছে চলি,
নহবত আজি বিহগ কাকলি,
দারুণ বিধির ইহাই নীতি!

২০
তুমি এনাতুল্লা নৃপতি নন্দন,
আমরা মোস্লেম দরিদ্র নির্ধন,
কি দিয়া করিব প্রীতি-সম্ভাষণ,
কি আছে এখন মোদের ঘরে!
নয়নের নীর লও উপহার,
লও হৃদয়ের ভক্তি-পুষ্প-হার,
আমাদের আজি নাই কিছু আর,
ভিক্ষা-ঝুলি আজি মোদের করে!