জীবন-প্রবাহ

(প্রথম তরঙ্গ)

মানব জনম নিয়ে কি ফল লভিনু হায়,
হেলায় জীবন গেল, বিফলে জনম যায়!
পিতার মধুর স্নেহে, মায়ের কোমল বুকে,
যেপেছি শৈশব কাল কতনা বিমল সুখে!
ভাই-ভগ্নী প্রতিবেশী আদর করিত সবে,
ভুঞ্জিতাম স্বর্গ সুখ অভাব কি ছিল ভবে?
প্রভাতে কুসুম বনে, শ্যামল সরসী-তীরে
বেড়াতেম, স্নিগ্ধবায়ু বহিত কি ধীরে ধীরে!
ঝাউ গাছ কি সুন্দর আকুল করিয়া প্রাণ!
গাইত কি সুধা রবে সরল মধুর গান!
তুলিতাম কত ফুল, গাঁথিতাম কত মালা!
সমপাঠীদের সনে যাইতাম পাঠশালা!
মধ্যাহ্নে বাটীর কাছে দীর্ঘ বট বৃক্ষতলে,
জুড়াতেম ক্লিষ্ট প্রাণ আতপে তাপিত হ’লে!
সায়াহ্নে হালটে মাঠে দলে দলে ধেনু গুলি
খেলিত ছুটিত কত উড়াইয়া পদ ধূলি!
আনন্দে রাখাল বৃন্দ লয়ে সেই ধেনু দল
যাইত গ্রামের দিকে করি কত কোলাহল!
সুকণ্ঠ বিহগ গুলি মধুর পুরবী তানে,
বর্ষিত কি শান্তি ধারা প্রকৃতির মুগ্ধ প্রাণে!
কোথা সেই গুরু মোর কোথা সেই পাঠশালা,
কোথা সেই সমপাঠী, কোথা সে ফুলের মালা!
শৈশবের ধূলা খেলা সকলি ত ঘুচে গেছে,
গুরুর বেতের চিহ্ন এখনো যে পিঠে আছে!
শৈশবের কত আশা, যৌবনের কত সাধ,
না মিটিতে কোথা গেল, আজি কেন অবসাদ?
কোথা সেই ভাই ভগ্নী, কোথা সেই পরিজন,
কোথা সেই ধন রত্ন, দাস দাসী অগণন?
ঊষা আগমন-আশে হ’য়ে সুখে আত্মহারা,
আর ত বিহগ বৃন্দ, ঢালে না অমিয় ধারা!
কোথা সে ভকতবৃন্দ, গায় না ত ঈশ-গুণ,
আজানের সুধা স্বরে আর ত ভাঙ্গে না ঘুম!
গভীর নিশীথ কালে তারাবীর সুধা স্বর,
উঠে না গগন কোলে সমীরে করিয়া ভর!
কোথা সেই “ঈদ” পৰ্ব্ব?- আনন্দের মহাধুম!
সবি যেন ছাড়া ছাড়া স্বর্গ যেন মরুভূম!

(দ্বিতীয় তরঙ্গ।)

যৌবন সীমায় যবে করিলাম পদার্পণ,
আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়া গেল, উধাও হইল মন!
আশার কুহকে ভুলে সাজায়ে কনক ডালা,
আকাশ কুসুমে কত গাঁথিলাম ফুল-মালা!
আকাঙ্ক্ষার সুরা দিয়ে, নিরাশার অশ্রুসনে,
প্রেমের প্রতিমা আমি গড়েছিনু সযতনে!
আশা ছিল হৃদি মাঝে সাজাইয়া ফুল-হারে,
স্থাপিব সোহাগ ভরে আমার সে প্রতিমারে!
হৃদয়ের স্তরে স্তরে বহিবে প্রীতির ধারা,
বিশ্বের অস্তিত্ব মাঝে হইব আপন হারা!
অন্তর বাহিরে শুধু দেখিব তাহারি ছবি,
সে যেন হৃদয়-কুঞ্জে বসন্তের ঊষা-রবি!
তাহারি আলোক নিয়ে যৌবনের কুলে কুলে
ভ্রমিব মনের সাধে, সংসার যাইব ভুলে!
স্বর্গীয় আলোক দিয়ে উজলি এ হৃদি গেহ,
সে মোরে সোহাগ ভরে বিলাইবে কত স্নেহ!
না পূরিতে সেই আশা, কি এক ঝটিকা এল,
সাধের সে স্বপ্ন মোর সহসা ভাঙ্গিয়া গেল!
ভাসিয়া গেলাম আমি বহুদূরে একদেশে,
যেথায় মানবগণ পশুত্ব লভয়ে এ’সে!
নাহি সেথা সুখ শান্তি, শুধু স্বার্থ কোলাহল,
কেবলি অসূয়া হিংসা ছলনা চাতুরী ছল!
সতত সবলগণ দুৰ্ব্বলে পাইলে হাতে,
করে সদা নিষ্পেষিত কঠোর পাদুকা ঘাতে!
আমিও তেমনি ভাবে পতনের নিম্নস্তরে
পড়িনু পাপের মোহে না বুঝিয়া চির তরে!

(তৃতীয় তরঙ্গ)

কেবলি অতৃপ্তি লয়ে ঘুরিলাম চারিধার,
না পাই শান্তি কোথা, প্রাণে শুধু হাহাকার!
স্বার্থ লোভে অন্ধ হয়ে আপন কর্ত্তব্য ভুলি,
রত্ন- হায় ভ্রমে ফণী পরিলাম গলে তুলি!
ন্যায় কি অন্যায় কিছু ভাবিনি তখন মনে,
স্বার্থের কুহকে ভুলে দলিয়াছি কত জনে!
আমার আমার বলি করিলাম কত গোল,
দুগধ কিনিতে যেয়ে কিনিলাম শুধু ঘোল!
একটি প্রাণীর হিত নারিনু সাধিতে ভবে,
পশুর জীবন লয়ে কি ফল বাঁচিয়া তবে?
যাদের সুখের লাগি করিয়াছি এতপাপ,
তারা ও তো ঘৃণা করে দেয় কত অভিশাপ!
শৈশব মধুর কাল, যৌবন বিষের ভরা,
না বুঝে মানবগণ স্বর্গ সম ভাবে ধরা!
ধনছিল, জনছিল, ছিলনা কি মোর তবে?
কোথা গেল?- হায় হায় আজি গালি দেয় সবে!

(চতুর্থ তরঙ্গ)

জীবনের পরিণাম আগে ভাবি নাই হায়,
হেলায় জীবন গেল, বিফলে জনম যায়!
কোথা সে সুহৃদগণ? এক সঙ্গে নিশি দিন
থাকিত যাহারা, হায় তারা কেন ভাবে তিন!
পথে ঘাটে দেখা হলে পাশ কেটে চলে যায়,
নিকটে গেলেও আরা কথাটি না বলে হায়!
প্রাণের অধিক ভাল যে জন বাসিত মোরে,
সে ও কেন মোরে দেখি থাকে সদা দুরে দূরে?
কোথা সেই ভালবাসা, উদ্দাম বাসনা তার,
সেও কেন পর ভাবে, মুখখানি ভার ভার!
ছেলে মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত সদা গৃহ কাৰ্য্য করে,
প্রমে ও আমার দিকে চায়না বারেক ফিরে!
মনের কথাটি আর বলেনা ত মন খুলে,
নূতন জগতে যেন আসিয়াছি পথ ভুলে!
এ ধরা সে ধরা নয়- আমি যেন কত চোর,
কিছুই বুঝিতে নারি,- এ কেমন ঘুম ঘোর?