মানবজন্ম


কেন আসিলাম এই সংসার ভবনে?
-দুর্লভ মানব জন্ম করিয়া গ্রহণ
কি করিনু সংসারের?- বৃথা এ জীবন!
তুলি কেবলি পঙ্ক ঠেলিয়া রতনে!


ছিল আশা কত শুভ সাধিব যতনে,
কিন্তু পাপে পরিপূর্ণ হইল জীবন!
ধরি রতন লোভে ভুজঙ্গ ভীষণ,
এখন জীবন যায় গভীর দংশনে!


আশার কুহকে ভুলে ছলে বলে হায়
সংসারে কত শুভ দলিয়া চরণে,
আপনার স্বার্থগুলি সেধেছি যতনে!
জীবনের গূঢ় তত্ত্ব ভুলিয়া মায়ায়!


যার প্রেম-ডোরে বাঁধা এবিশ্ব মণ্ডল,
বেঁচে আছি যার বলে জীবন-সংগ্রামে,
মুহূৰ্ত্তেক তাঁর স্নেহ ভাবিনু কি প্রাণে?-
তুচ্ছ রমণীর প্রেমে হৃদয় পাগল!


তৃষ্ণাতুর পান্থ যথা নীর অন্বেষণে
ভীষণ মরুভু মাঝে ছুটিয়া বেড়ায়,
তেমতি সংসার ক্ষেত্রে সুখের আশায়
ভ্ৰমিলাম নিশি দিন অতৃপ্ত মরমে!


কি লভিনু?-ভাগ্য-দোষে সকলি নিস্ফল
পাইলাম এক মাত্র চির “হা হতাশ”!
নাহি শান্তি, হুহু করে হৃদয় আবাস,
প্রাণের ভিতরে শুধু নিরাশা কেবল!


রমণীর প্রেম-মন্ত্রে ভুলিয়া সকল,
ভাই ভগ্নী পরিজনে এসেছি ত্যজিয়া!
জীবনের সার ব্ৰত দিয়াছি ছাড়িয়া,
চলেছি পুতুল প্রায় নাহি আত্মবল!


যে তুচ্ছ জীবন লয়ে ধরণী উপরে
চলিয়াছি গর্ব্বভরে বুক ফুলাইয়া,
আজি কিম্বা কালি তাহা কালের সাগরে
এ জন্মের মত হায় যাইবে ডুবিয়া!

১০
সংসারের এই দশা তুমি আমি ছার!
কে লভেছে বিশ্ববামে অমর জীবন?
এ সুখ সম্পদ যত নিশার স্বপন!
রবে না নিশ্চয়, হায় রহিয়াছে কার?

১০
অনুপম শোভাময়ী সে দিল্লী নগরী,
ঝলসিত নেত্র যার রূপের ছটায়!
ছিল যে আনন্দে মুগ্না দিবস শর্ব্বরী,
আজি, কেন তার এই ভগ্ন দশা হায়?

১১
কোথা সেই দিগ্বিজয়ী নরপতিগণ?-
যাহাদের পদভরে কাঁপিত ধরণী,
লুণ্ঠিত চরণ তলে সহস্র রমণী,
কোথা তারা? সেই দম্ভ আছে কি এখন?

১২
আজিও তো তাহাদের শক্তি-নিদর্শন,
র’য়েছে অঙ্কিত, অই বক্ষে বসুধার!
কিন্তু তারা এ জনমে ফিরিবে কি আর
নিরখিতে সেই সব কীর্ত্তি বিমোহন?

১৩
অই দেখ নভস্পর্শী কুতুব মিনার,
বিঘোষিছে যার কীৰ্ত্তি সে আজি কোথায়?
কোথা সে সাজাহাঁ, চিহ্ন আছে কি ধরায়?
আছে কি, সে জাহাঙ্গির, দিল্লী-দরবার?

১৪
নোহর হর্ম্ম্যগুলি কাল ঝঞ্চা বায়
ভগ্নচূড়, শোভাহীন কে করে যতন?
কোথা সেই নারী-রত্ন নুরজাহাঁ বেগম,
শোভিত যে অন্তঃপুরে শতদল প্রায়!

১৫
কোথা সে মমতাজ? হায় সমাধি যাহার
নীরবে ভারত-বুকে আছে দাঁড়াইয়া?
পার্থিব জীবনে করি সহস্র ধিক্কার
কত যে ঘুমন্ত স্মৃতি দেয় জাগাইয়া!

১৬
যেই স্থানে একদিন দাস দাসী সনে
শোভিত অতুল সাজে সম্রাট বেগম!
কালের কুটিল গতি হায় সেই স্থানে
শৃগাল পেঁচক আজি পেতেছে আসন!

১৭
সঙ্গীতের পরিবর্ত্তে পেঁচক চিৎকার,
নহবত আজি তথা শৃগালের রব!
নিয়তির ঘূর্ণচক্র এত দুর্নিবার,
জেনেও জানেনা তাহা ভ্ৰমান্ধ মানব।

১৮
আজি তুমি কালি আমি কে রহিবে ভবে?
এই আছি, এই নাই!- ছায়া বাজী প্রায়
মুহূর্ত্তে জীবন বায়ু অনন্তে মিশায়;
দারুণ কালের গ্রাসে সব ধ্বংশ হবে!

১৯
চিহ্ন মাত্র এ জগতে রহিবে না আর,
“আমার আমার” ব’লে বৃথা আস্ফালন!
স্বার্থ আশে প্রাণীদলে বৃথা নিস্পীড়ন,
আমিতো আমার নহি,- কে তবে আমার?

২০
মানব জন্মের কিরে এই পরিণাম?
ভূলিয়া সে গূঢ় তত্ত্ব উন্মাদের প্রায়
কতযে অশুভ আমি সাধিলাম হায়,
বৃথা এ পাপের বোঝা কেন কিনিলাম?

২১
কেন আসিলাম এই সংসার ভবনে?
একটি প্রাণীর দুঃখ করিতে মোচন,
একটি মঙ্গল তার করিতে সাধন
পারিনু কি হায় এই মানব জনমে!