নীরব রোদন


কেনরে এ মরুময় হৃদয়-প্রান্তরে,
বহিছে সতত হায় ঝটিকা ভীষণ!
কারে কব সেই দুঃখ অবনী ভিতরে,
কে বুঝিবে আমার সে নীরব রোদন?
এ বিপুল বিশ্ব মাঝে ক্ষুদ্রকীট প্রায়
আমি হতভাগা, ভাসি নয়নের জলে!
কে চাহে আমার পানে? হায় এ ধরায়
দরিদ্রের অশ্রুজলে কার প্রাণ গলে?


জানিনা সুখের লেশ এভব জীবনে!
অদৃষ্ট আমার সদা প্রতিকূল হায়!
পিতা মাতা শৈশবেই শমন-সদনে
গিয়াছেন, চির তরে কাঁদায়ে আমায়!
হেরিনা অনেক দিন মায়ের বদন,
নিদ্ৰাবেশে কভু তারে হেরিলে স্বপনে,
বর্ষার প্লাবন প্রায় ঝরে দুনয়ন,
কত কথা জেগে উঠে এ আকুল মনে!


ডাকিনা অনেক দিন বাবা ব’লে আমি,
ধূধু মনে পড়ে আজি মুরতি তাঁহার!
যে কষ্ট সহিয়া আছি জানে অন্তর্যামী,
কোথা সেই স্নেহময় জনক আমার!
নৃশংসের প্রায় প্রাণ বাঁধিয়া পাষাণে
স্মরিতে সে কথা আজি বুক ফেটে যায়।
ভুলিয়া মমতা, যারে ভীষণ শ্মশানে
এ জন্মের তরে হায় দিয়াছি বিদায়!


হতভাগা আমি, হায় দারিদ্রের দায়,
অবস্থার স্রোতে পড়ে চলেছি ভাসিয়া!
কে জানে এ খর ধারে যাইব কোথায়,
শান্ত আছি এ দারুণ অদৃষ্ট স্মরিয়া!
কত ধনাঢ্যের কাছে সজল নয়নে
অনুগ্রহ ভিক্ষা হায় চেয়েছি কাতরে!
কি লভেছি?- দীর্ঘশ্বাস অশ্রুজল বিনে?-
সে কথা ভাবিতে আজি হৃদয় বিদরে!


কে বুঝেছে আমার সে নীরব রোদন?
দরিদ্রের মর্ম্ম ব্যথা কে বুঝে সংসারে?
স্বার্থের মোহন মন্ত্রে মুগ্ধ যেই জন,
কেমনে এ কান্না তার পশিবে অন্তরে!
সুখময় বাল্যকালে পড়িতাম যবে,
কত অকৃত্রিম বন্ধু তুষিত আমায়!
অদৃষ্ট সহায় যার সেই সুখী ভবে,
নহিলে সকলি মিথ্যা। কোথা আজি হায়,


সেই সব সহৃদয় বন্ধু প্রিয়তর
আজিতে মুহূৰ্ত্ততরে হেরিনা নয়নে!
কেন তারা চিরতরে হয়েছে অন্তর,
নাই কি মমতা এবে তাহাদের মনে?
কত সুখময় আশা হৃদয় প্রান্তরে
কুসুমের মত হয় নীরবে ফুটিয়া,
অদৃষ্টের ঝঞ্চাবাতে নিরাশা-সাগরে
এজন্মের মত হায় গিয়াছে ডুবিয়া!


ছিল আশা একদিন সৌভাগ্য-আসনে,
বিরাজিব মন-সুখে,- বিধি বিধাতার!
অনাহারে আজি হায় লুষ্ঠিত ভূসনে,
দোষী এ অদৃষ্ট মম, দোষ দিব কার?
যৌবন-সীমায় যবে পশিনু প্রথম,
সকলি সুখের হয় দেখিনু সংসারে!
দারিদ্ৰভানুর করে ফাটিবে মরম
কে জানিত? কে জানিত হৃদয়-কন্দরে


উঠিবে জ্বলিয়া এই নিরাশা-অনল
বিনাশিতে অভাগার শান্তি-তরুবরে!
কে জানিত হেন ভাবে উঠিবে গরল
অমৃতের পরিবর্ত্তে অদৃষ্ট-সাগরে!
প্রেমময়ী ভাৰ্য্যা মম নিত্য উপবাসে
ক্ষীণকায়, স্বর্ণকান্তি ঘোর বিমলিন!
বিষাদের ছায়া রাশি সামুখে ভাসে
নিরাশায় অপূর্ণ নয়ন নলিন!


যন্ত্রণার গুরুভারে হতাশ অন্তরে
ঢলে পড়ে যবে,- হায় না বলে কাহায়!
নীরবে লুকিয়া কাঁদে শয্যার উপরে,
অবিরল অশ্রুধারে গণ্ড ভেসে হায়!
মুহূর্ত্তেক সেই দৃশ্য হেরিলে নয়নে,
পাষাণ গলিয়া যায় শোকের উচ্ছ্বাসে!
অভাগা কোমল প্রাণে সহিবে কেমনে?
মিশায় মনের দুঃখ সুদীর্ঘ নিশ্বাসে!

১০
আজি মহাপর্ব্ব, হায় প্রতি ঘরে ঘরে
আনন্দের কোলাহল, বাদ্যের নিক্কণ!
ভাসিতেছে বঙ্গ আজি সুখের সাগরে,
নব বন্ত্রে সুসজ্জিত নরনারীগণ!
অভাগা শিশুটী মোর বসি একধারে
অই যে রে কাঁদিতেছে, মলিন বদন;
কোথা পাব নববস্ত্র তুষিতে তাহারে
অন্নাভাবে ক্লিষ্ট আমি সারাটী জীবন!

১১
কি করিব, দরিদ্রের কি আছে উপায়
এক কণা অশ্রু তার মর্ম্ম ভেদ করে!
অদৃষ্ট বিমুখ যদি, কেন তবে হায়
এমন সোনারপুষ্প দরিদ্রের ঘরে!
ক্ষুধায় কাতর হ’য়ে মলিন বদনে
কাদে যবে, এ হৃদয়ে বহে শোক-ঝড়!
স্পর্শিয়া ভুজঙ্গ, কিম্বা গরল ভক্ষণে
ইচ্ছা করে তেয়াগিতে জীবন নশ্বর!

১২
কত দিন সেই দুঃখে বিষণ্ণ হৃদয়ে
গিয়াছি ত্যজিতে প্রাণ তটিনীর জলে!
ফিরিয়া এসেছি পূনঃ পাতকের ভয়ে
কাঁদিয়াছি কত দিন বসিয়া বিরলে!
যুঝিয়া অদৃষ্ট সনে জীবন-প্রান্তরে
ক্ষত এ হৃদয় বক্ষ, মুমূর্ষ জীবন!
বুঝিয়াছি সব বৃথা, বিপদের ক্রোড়ে
একমাত্র শান্তি মম অশ্রু বরিষণ!