ধরণী দিয়াছে তার
গাঢ় বেদনার
রাঙা মাটি-রাঙা ম্লান ধূসর আঁচলখানি
দিগন্তের কোলে কোলে টানি।
পাখি উড়ে যায় যেন কোন মেঘ-লোক হতে
সন্ধ্যা-দীপ-জ্বালা গৃহ-পানে ঘর-ডাকা পথে।
আকাশের অস্ত-বাতায়নে
অনন্ত দিনের কোন্ বিরহিণী কনে
জ্বালাইয়া কনক-প্রদীপখানি
উদয়-পথের পানে যায় তার অশ্রু-চোখ হানি?
‘আসি’-বলে চলে যাওয়া বুঝি তার প্রিয়তম আশে,
অস্ত-দেশ হয়ে ওঠে মেঘ-বাষ্প-ভারাতুর তারি দীর্ঘশ্বাসে।
আদিম কালের ঐ বিষাদিনী বালিকার পথ-চাওয়া চোখে-
পথ-পানে-চাওয়া-ছলে দ্বারে-আনা সন্ধ্যা-দীপালোকে
মাতা বসুধার মমতার ছায়া পড়ে।
করুণার কাঁদন ঘনায় নত-আঁখি স্তব্ধ দিগন্তরে।
কাঙালিনী ধরা-মা’র অনাদি কালের কত অনন্ত বেদনা
হেমন্তের এমনি সন্ধ্যায় যুগ যুগ ধরি বুঝি হারায় চেতনা।
উপুড় হইয়া সেই স্তূপীকৃত বেদনার ভার
মুখ গুঁজে পড়ে থাকে; ব্যথা-গন্ধ তার
গুমরিয়া গুমরিয়া কেঁদে কেঁদে যায়
এমনি নীরবে শান্ত এমনি সন্ধ্যায়।…
ক্রমে নিশীথিনী আসে ছড়াইয়া ধূলায়-মলিন এলোচুল,
সন্ধ্যা-তারা নিবে যায়, হারা হয় দিবসের কূল।…
তারি মাঝে কেন যেন অকারণে হায়
আমার দুচোখ পুরে বেদনার ম্লানিমা ঘনায়।
বুকে বাজে হাহাকার-করতালি,
কে বিরহী কেঁদে যায় ‘খালি, সব খালি!
ঐ নভ, এই ধরা, এই সন্ধ্যালোক,
নিখিলের করুণা যা-কিছু, তোর তরে তাহাদের অশ্রুহীন চোখ!’
মনে পড়ে- তাই শুনে মনে পড়ে মম
কত না মন্দিরে গিয়া পথের সে লাথি-খাওয়া ভিখারির সম
প্রসাদ মাগিনু আমি-
‘দ্বার খোলো, পূজারী দুয়ারে তব আগত যে স্বামী!’
খুলিল দুয়ার, দেউলের বুকে দেখিনু দেবতা,
পূজা দিনু রক্ত-অশ্রু, দেবতার মুখে নাই কথা।
হায় হায় এ যে সেই অশ্রুহীন-চোখ,
কেঁদে ফিরি, ওগো এ কি প্রেমহীন অনাদর-হানস দেবলোক!
ওরে মূঢ়! দেবতা কোথায়?
পাষাণ-প্রতিমা এরা, অশ্রু দেখে নিষ্পলক অকরুণ মায়াহীন
চোখে শুধু চায়।
এরাই দেবতা, যাচি প্রেম ইহাদেরই কাছে,
অগ্নি-গিরি এসে যেন মরুভূর কাছে হায় জল-ধারা যাচে।
আমার সে চারি পাশে ঘরে ঘরে কত পূজা কত আয়োজন,
তাই দেখে কাঁদে আর ফিরে ফিরে চায় মোর ভালোবাসা-ক্ষুধাতুর মন,
অপমানে পুন ফিরে আসে,
ভয় হয়, ব্যাকুলতা দেখি মোর কি জানি কখন কে হাসে।
দেবতার হাসি আছে, অশ্রু নাই;
ওরে মোর যুগ-যুগ-অনাদৃত হিয়া, আয় ফিরে যাই।…
এই সাঁঝে মনে হয়, শূন্য চেয়ে আরো এক মহাশূন্য রাজে
দেবতার-পায়ে-ঠেলা এই শূন্য মম হিয়া-মাঝে।
আমার এ ক্লিষ্ট ভালোবাসা,
তাই বুঝি হেন সর্বনাশা।
প্রেয়সীর কণ্ঠে কভু এই ভুজ এই বাহু জড়াবে না আর,
উপেক্ষিত আমার এ ভালোবাসা মালা নয়, খর তরবার।