চৈতী হাওয়া


হারিয়ে গেছ অন্ধকারে-পাইনি খুঁজে আর,
আজকে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার!
আজকে তোমার জন্মদিন-
স্মরণ-বেলায় নিদ্রাহীন
হাতড়ে ফিরি হারিয়ে-যাওয়ার অকূল অন্ধকার!
এই-সে-হেথাই হারিয়ে গেছে কুড়িয়ে-পাওয়া হার!


শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কালো জল,
কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথার নীলোৎপল?
আঁধার দীঘির রাঙলে মুখ,
নিটোল ঢেউ-এর ভাঙলে বুক,-
কোন পূজারী নিল ছিঁড়ে? ছিন্ন তোমার দল
ঢেকেছে আজ কোন্ দেবতার কোন সে পাষাণ-তল?


অস্ত-খেয়ার হারামাণিক-বোঝাই-করা না’
আসছে নিতুই ফিরিয়ে দেওয়ার উদয়-পারের গাঁ
ঘাটে আমি রি বসে
আমার মাণিক কই গো সে?
পারাবারের ঢেউ-দোলানি হানছে বুকে ঘা!
আমি খুঁজি ভিড়ের মাঝে চেনা কমল-পা!


বইছে আবার চৈতী হাওয়া, গুমরে ওঠে মন,
পেয়েছিলাম এমনি হাওয়ায় তোমার পরশন।
তেমনি আবার মহুয়া-মউ
মৌমাছিদের কৃষ্ণ-বউ
পান করে ঐ ঢুলছে নেশায় দুলছে মহুল বন!
ফুল-শৌখিন দখিন-হাওয়ায় কানন উচাটন!


পড়ছে মনে টগর চাঁপা বেল চামেলি জুঁই,
মধুপ দেখে যাদের শাখা আপ্নি যেত নুই।
হাস্তে তুমি দুলিয়ে ডাল,
গোলাপ হয়ে ফুটতো গাল!
থলকমলি আঁউরে যেত তপ্ত ও-গাল ছুঁই!
বকুল-শাখা ব্যাকুল হতো টলমলাত ভুঁই!


চৈতী রাতের গাইত গজল বুলবুলিয়ার রব,
দুপুর বেলায় চবুতরায় কাঁদত কবুতর!
ভুঁই-তারকা সুন্দরী
সজনে ফুলের দল ঝরি
থোপা থোপা লাজ ছড়াত দোলন-খোঁপার ‘পর,
ঝাঁজাল্‌ হাওয়ায় বাজত উদাস মাছ্‌রাঙার স্বর!


পিয়াল-বনায় পলাশ ফুলের গেলাস-ভরা মউ
খেতো বঁধুর জড়িয়ে গলা সাঁওতালিয়া বউ!
লুকিয়ে তুমি দেখতে তাই,
বলতে, ‘আমি অমনি চাই!’
খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে, ঠোঁটে দিতাম মউ!
হিজল শাখায় ডাকত পাখি ‘বউ গো কথা কউ’


ডাকত ডাহুক জল-পায়রা নাচত ভরা বিল,
জোড়া ভুরু ওড়া যেন আসমানে গাঙ-চিল
হঠাৎ জলে রাখতে পা,
কাজ্‌লা দীঘির শিউরে গা-
কাঁটা দিয়ে উঠত মৃণাল ফুটত কমল-ঝিল।
ডাগর চোখে লাগত তোমার সাগর-দীঘির নীল!


উদাস দুপুর কখন গেছে, এখন বিকেল যায়,
ঘুম জড়ানো ঘুমতি নদীর ঘুমুর-পরা পায়।
শঙ্খ বাজে মন্দিরে,
সন্ধ্যা আসে বন ঘিরে,
ঝাউএর শাখায় ভেজা আঁধার কে পিঁজেছে হায়।
মাঠের বাঁশী বন-উদাসী ভীম্পলাশী গায়।

১০
বাউল আজি বাউল হলো আমরা তফাতে।
আম-মুকুলের গুঁজি-কাঠি দাও কি খোঁপাতে?
ডাবের শীতল জল দিয়ে
মুখ মাজোকি আর প্রিয়ে?
প্রজাপতির ডাক-ঝরা সোনার টোপাতে
ভাঙা ভুরু দাও কি জোড়া রাতুল শোভাতে?

১১
বউল ঝরে ফলেছে আজ থোলো থোলো আম,
রসের-পীড়ায়-টসটসে-বুক ঝুরছে গোলাবজাম।
কামরাঙারা রাঙল ফের
পীড়ন পেতে ঐ মুখের
স্মরণ করে চিবুক তোমার, বুকের তোমার ঠাম-
জামরুলে রস ফেটে পড়ে, হায়, কে দেবে দাম!

১২
করেছিলাম চাউনি চয়ন নয়ন হতে তোর,
ভেবেছিলুম গাঁথব মালা পাইনে খুঁজে ডোর!
সেই চাহনি নীল-কমল
ভরল আমার মানস-জল,
কমল-কাঁটার ঘা লেগেছে মর্ম-মূলে মোর
বক্ষে আমার দুলে আঁখির সাতনরী-হার লোর!

১৩
তরী আমার কোন্ কিনারায় পাইনে খুঁজে কূল,
স্মরণ-পারের গন্ধ পাঠায় কমলা নেবুর ফুল!
পাহাড়তলীর শালবনায়
বিষের মত নীল ঘনায়!
সাঁঝ পরেছে ঐ দ্বিতীয়ার-চাঁদ-ইহুদি-দুল!
হায় গো, আমার ভিন্ গাঁয়ে আজ পথ হয়েছে ভুল!

১৪
কোথায় তুমি কোথায় আমি চৈতে দেখা সেই,
কেঁদে ফিরে যায় যে চৈত- তোমার দেখা নেই!
কণ্ঠে কাঁদে একটি স্বর-
কোথায় তুমি বাঁধলে ঘর?
তেমনি করে জাগছ কি রাত আমার আশাতেই?
কুড়িয়ে-পাওয়া-বেলায় খুঁজি হারিয়ে-যাওয়া খেই।

১৫
পারাপারের ঘাটে প্রিয় রিনু বেঁধে না’,
এই তরীতে হয়ত তোমার পড়বে রাঙা পা।
আবার তোমার সুখ-ছোঁওয়ায়
আকুল দোলা লাগবে নায়,
এক তরীতে যাব মোরা আর-না-হারা গাঁ,
পারাপারের ঘাটে প্রিয় রিনু বেঁধে না’।।

[হুগলি
চৈত্র ১৩৩১]