মাধবী-প্রলাপ

আজ লালসা-আলস-মদে বিবশা রতি
শুয়ে অপরাজিতায় ধনি স্মরিছে পতি।
তার নিধুবন-উন্মন
ঠোঁটে কাঁপে চুম্বন,
বুকে পীন যৌবন
উঠিছে ফুঁড়ি,
মুখে কাম-কণ্টক ব্রণ মহুয়া-কুঁড়ি!

করে বসন্ত বনভূমি সুরত-কেলি,
পাশে কাম-যাতনায় কাঁপে মালতী বেলি!
ঝুরে আলু-থালু কামিনী
জেগে সারা যামিনী,
মল্লিকা ভামিনী
অভিমানে ভার,
কলি না ছুঁতেই ফেটে পড়ে কাঁটালি চাঁপার!

ছি ছি বেহায়া কী সাঁওতালি মহুয়া ছুঁড়ি,
লাজে আঁখি নিচু করে থাকে সোঁদাল-কুঁড়ি!
পাশে লাজ-বাস বিসরি
জামরুলি কিশোরী
শাখা-দোলে কি করি
খায় হিন্দোল!
হলো ঘাম-ভাঙা লাজে কাম-রাঙার কপোল!

বাঁকা পলাশ-মুকুলে কার আনত আঁখি?
ওগো রাঙা-বৌ বনবধূ রাগিল না কি?
তার আঁখে হানি কুঙ্কুম
ভাঙিল কি কাঁচা ঘুম?
চুমু খেয়ে বেমালুম
পালাল কি চোর?
রাগে অনুরাগে রাঙা হল আঁখি বন-বৌর!

ওগো নার্গিসফুলি বনবালা-নয়নায়
ও কে সুরমা মাখায় নীল ভোম্‌রা পাখায়!
কালো কোয়েলার রূপে ওকি
উড়িয়া বেড়ায় সখি
কামিনী-কাজল আঁখি
কেঁদে বিষাদে?
কার শীর্ণ কপোল কাঁদে অস্ত-চাঁদে!

সখী মদনের বাণ-হানা শব্দ শুনিস
ঐ বিষ-মাখা মিশকালো দোয়েলের শিস!
দেখ্‌ দুই আঁখি ঝাঁপিয়া
কেঁদে ওঠে পাপিয়া-
‘চোখ গেল হা প্রিয়া’
চোখে খেয়ে শর।
কাঁদে ঘুঘুর পাখায় বন বিরহ-কাতর!

ঝরে ঝরঝর মরমর বিদায়-পাতা,
ওকি বিরহিণী বনানীর ছিন্ন খাতা?
ওকি বসন্তে স্মরি স্মরি
সারাটি বছর ধরি
শত অনুযোগ করি
লিখিয়া কত
আজ লজ্জায় ছিঁড়ে ফেলে লিপি সে যত!

আসে ঋতুরাজ, ওড়ে পাতা জয়ধ্বজা;
হল অশোক শিমুলে বন-পুষ্প রজা।
তার পাংশু চীনাংশুক
হল রাঙা কিংশুক,
উৎসুক উন্মুখ
যৌবন তার
যাচে লুণ্ঠন-নির্মম দস্যু তাতার!

ওড়ে পিয়াল-কুসুম-ঝরা পরাগ কোমল
ওকি বসন্ত বনভূমি-রতি-পরিমল?
ওকি কপোলে কপোল ঘষা
ওড়ে চন্দন খসা?
বনানী কি করে গোঁসা
ছোঁড়ে ফুল-ধুল?
ওকি এলায়েছে এলো-খোঁপা সোঁদা-মাখা চুল?

নাচে দুলে দুলে তরুতলে ছায়া-শবরী,
দোলে নিতম্ব-তটে লটপট কবরী!
দেয় করতালি তালীবন,
গাহে বায়ু শন্‌ শন্‌,
বনবধূ উচাটন
মদন-পীড়ায়,
তার কামনার হরষণে ডালিম ডাঁশায়!

নভ অলিন্দে বালেন্দু উদিল কি সই?
ও যে পলাশ-মুকুল, নব শশিকলা কই?
ও যে চির-বালা-ত্রয়োদশী
বিবস্ত্রা উর্বশী,
নখ-ক্ষত ওই শশী
নভ-উরসে।
ওকি তারকা না চুমো-চিন্‌ আছে মু’রছে?

দূরে সাদা মেঘ ভেসে যায়- শ্বেত সারসী,
ওকি পরিদের তরি অপ্সরী-আরশি
ওকি পাইয়া পীড়ন-জ্বালা
তপ্ত উরসে বালা
শ্বেতচন্দন লালা
করিছে লেপন?
ওকি পবন খসায় কার নীবি-বন্ধন?

হেথা পুষ্প-ধনু লেখে লিপি রতিরে
হলো লেখনি তাহার লিচু-মুকুল চিরে!
লেখে চম্পা কলির পাতে,
ভোম্‌রা আখর তাতে,
দখিনা হাওয়ার হাতে
দিল সে লেখা।
হেথা ‘ইউসোফ্‌’ কাঁদে, হোথা কাঁদে ‘জুলেখা’!