ওগো ও চক্রবাকী

-ওগো ও চক্রবাকী,
তোমারে খুঁজিয়া অন্ধ হলো যে চক্ৰবাকের আঁখি!
কোথা কোন্ লোকে কোন্ নদীপারে রহিলে গো তারে ভুলে?
হেথা সাথী তব ডেকে ডেকে ফেরে ধরণীর কূলে কূলে।
দিবসে ঘুমালে সব ভুলে যার পাখায় বাঁধিয়া পাখা,
চক্ষুতে যার আজিও তোমার চঞ্চুর চুমা আঁকা,
‘রোদ লাগে’ বলে যার ডানাতলে লুকাইতে নানা ছলে,
থাকিয়া থাকিয়া উঠিতে কাঁপিয়া তবু কেন পলে পলে;
ভাদরের পারা আদরের ধারা যাচিয়া যাহার কাছে
কাহার পিছনে ছায়াটির মতো ফিরিয়াছ পাছে পাছে,-
আজ সে যে হায় কাঁদিয়া তোমায় দিকে দিকে খুঁজে মরে,
ভীরু মোর পাখি! আঁধারে একাকী কোথা কোন্ বালুচরে?

সাড়া দেয় বন, শন্ শন্ শন্-ঐ শোনো মোর ডাকে,
তটিনীর জল আঁখি ছলছল ফিরে চায় বাঁকে বাঁকে,
ফিরায়ে আমার প্রতিধ্বনিরে সান্ত্বনা দেয় গিরি,
ওপারের তীরে জিরিজিরি পাতা ঝরিতেছে ঝিরি ঝিরি।
বিহগীর হায় ঘুম ভেঙে যায় বিহগ-পক্ষ-পুটে,
বলে, ‘বিরহী রে, মোর সুখ-নীড়ে আয় আয় আয় ছুটে!
জুড়াই ব্যথা, কাঁটা বিঁধে যথা সেথা দিব বুক পেতে,
ঐ কাঁটা লয়ে বিবাগিনী হয়ে উড়ে যাব আকাশেতে!
ঠোঁট-ভরা মধু আসে কুলবধূ, বলে, ‘আঁধারের পাখি,
নিশীথ নিঝুম চোখে নাই ঘুম, কারে এত ডাকাডাকি?

চলো তরুতলে, এই অঞ্চলে দিব সুখ-শেজ পাতি,
ভুলের কাননে ফুল তুলে মোরা কাটাই সারা রাতি!’
অসীম আকাশ আসে মোর পাশ তারার দীপালি জ্বালি,
বলে, ‘পরবাসী! কোথা কাঁদো আসি? হেথা শুধু চোরাবালি!
তোমার কাঁদনে আমার আঙনে নিভে যায় তারা বাতি,
তুমিও শূন্য আমিও শূন্য, এস মোরা হব সাথী!’…
মানে না পরান, গেয়ে গেয়ে গান কূলে কূলে ফিরি ডাকি,
কোথা কোন্ কূলে রহিলে গো ভুলে আমার চক্রবাকী!
চাহি ও-পারের তীরে,
কভু না পোহায় বিরহের রাতি এতই দীরঘ কি রে?
মিটিতে সাধ বিধি সাধে বাদ, বিরহের যবনিকা
পড়ে যায় মাঝে, নিভে যায় সাঁঝে মিলনের মরু-শিখা।
মিলনের কূল ভেঙে ভেঙে যায় বিরহের স্রোত বেগে,
অধরের হাসি বাসি হয়ে ওঠে নিশীথ-প্রভাতে জেগে!

একা নদীতীরে গহন তিমিরে আমি কাঁদি মনোদুখে,
হয়তো কোথায় বাঁধিয়া কুলায় তুমি ঘুম যাও সুখে।
আমাদের মাঝে বহিছে যে নদী এ-জীবনে শুকাবে না,
কাটিবে এ নিশি, আসিবে প্রভাত, যতেক অচেনা চেনা
আসিবে সবাই; আসিবে না তুমি তব চির-চেনা নীড়ে,
এ-পারের ডাক ওপার ঘুরিয়া এ-পারে আসিবে ফিরে!
হয়তো জাগিয়া দেখিব প্রভাতে, আমারি আঁখির আগে
তুমি যাচিতেছ নবীন সাথীর প্রেম নব অনুরাগে।
জানি গো আমার কাটিবে না আর এই বিরহের নিশি,
খুঁজিবে বৃথাই আঁধারে তোমায় দশদিকে দশ দিশি।

যখন প্রভাতে থাকিব না আমি এই সে নদীর ধারে,
ক্লান্ত পাখায় উড়ে যাব দূর বিস্মরণীর পারে,
খুঁজিতে আমায় এই কিনারায় আসিবে তখন তুমি-
খুঁজিবে সাগর-মরু-প্রান্তর গিরিদরী বনভূমি।
তাহারি আশায় রেখে যাই প্রিয়, ঝরা পালকের স্মৃতি-
এই বালুচরে ব্যথিতের স্বরে আমার বিরহ-গীতি!

যদি পথ ভুলে আস এই কূলে কোনো দিন রাতে রানি,
প্রিয় ওগো প্রিয়, নিও তুলে নিও ঝরা এ পালকখানি।