অগ্রপথিক হে সেনাদল

অগ্রপথিক হে সেনাদল, জোর কদম্ চল্ রে চল্।
রৌদ্রদগ্ধ মাটিমাখা শোন্ ভাইরা মোর,
বাসি বসুধায় নব অভিযান আজিকে তোর!
রাখ্ তৈয়ার হাথেলিতে হাতিয়ার জোয়ান,
হান্ রে নিশিত পাশুপতাস্ত্র অগ্নিবাণ।
কোথায় হাতুড়ি কোথা শাবল?
অগ্র-পথিক রে সেনাদল, জোর্ কদম্ চল্ রে চল্।।

কোথায় মানিক ভাইরা আমার, সাজ্ রে সাজ্!
আর বিলম্ব সাজে না চালাও কুচ্কাওয়াজ!
আমরা নবীন তেজ-প্রদীপ্ত বীর তরুণ
বিপদ বাধার কণ্ঠ ছিঁড়িয়া শুষিব খুন!
আমরা ফলাব ফুল-ফসল।
অগ্রপথিক রে যুবাদল, জোর কদম্ চল্ রে চল্।

প্রাণ-চঞ্চল প্রাচী-র তরুণ, কর্মবীর,
হে মানবতার প্রতীক গর্ব উচ্চশির!
দিব্যচক্ষে দেখিতেছি, তোরা দৃপ্তপদ
সকলের আগে চলিবি পারায়ে গিরি ও নদ,
মরু-সঞ্চর গতি চপল।
অগ্র-পথিক রে পাঁওদল, জোর্ কদম্ চল্ রে চল্।।

স্থবির শ্রান্ত প্রাচী-র প্রাচীন জাতিরা সব
হারায়েছে আজ দীক্ষা দানের সে গৌরব।
অবনত-শির গতিহীন তারা, মোরা তরুণ
বহিব সে ভার, লব শাশ্বত ব্রত দারুণ,
শিখাব নতুন মন্ত্রবল।
রে নব পথিক যাত্রীদল, জোর্ কদম্ চল্ রে চল্।।

আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি’ পচা অতীত,
গিরি-গুহা ছাড়ি’ খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত।
সৃজিব জগৎ বিচিত্রতর, বীর্যবান্,
তাজা জীবন্ত সে নব সৃষ্টি শ্রম-মহান্
চলমান-বেগে প্রাণ-উছল।
রে নব যুগের স্রষ্টাদল, জোর্ কদম্ চল্ রে চল্।।

অভিযান-সেনা আমরা ছুটিব দলে দলে
বনে নদীতটে গিরি-সংকটে জলে-থলে।
লঙ্ঘিব খাড়া পর্বত-চূড়া অনিমেষে,
জয় করি’ সব তস্নস্ করি’ পায়ে পিষে-
অসীম সাহসে ভাঙি’ আগল!
না-জানা পথের নকিব-দল, জোর্ কদম্ চল্ রে চল্।।

পাতিত করিয়া শুষ্ক বৃদ্ধ অটবিরে
বাঁধ বাঁধি’ চলি দুস্তর খর স্রোত-নীরে।
রসাতল চিরি’ হীরকের খনি করি’ খনন,
কুমারী ধরার গর্ভে করি গো ফুল সৃজন,
পায়ে হেঁটে মাপি ধরণীতল!
অগ্র-পথিক রে চঞ্চল, জোর্ কদম্ চল্ রে চল্।।

আমরা এসেছি নবীন প্রাচী-র নবস্রোতে
ভীম পর্বত ক্রকচ-গিরির চূড়া হ’তে,
উচ্চ অধিত্যকা প্রণালিকা হইয়া পার
আহত বাঘের পদ-চিন ধরি হয়েছি বা’র;
পাতাল ফুঁড়িয়া, পথ পাগল।
অগ্র-বাহিনী পথিক দল, জোর্ কদম্ চল্ রে চল্।।

অভয়-চিত্ত ভাবনা-মুক্ত যুবারা শুন্!
মোদের পিছনে চিৎকার করে পশু, শকুন।
ভ্রূকুটি হানিছে পুরাতন পচা গলিত শব,
রক্ষণশীল বুড়োরা, করিছে তাহারই স্তব,
শিবারা চেঁচাক, শিব অটল!
নির্ভীক বীর পথিক-দল, জোর্ কদম্ চল্ রে চল্।।

আগে- আরো আগে সেনা-মুখ যথা করিছে রণ,
পলকে হতেছে পূর্ণ মৃতের শূন্যাসন,
আছে ঠাঁই আছে, কে থামে পিছনে? হ’ আগুয়ান,
যুদ্ধের মাঝে পরাজয় মাঝে চলো জোয়ান্!
জ্বাল্ রে মশাল জ্বাল্ অনল!
অগ্র-যাত্রী রে সেনাদল, জোর্ কদম্ চল্ রে চল্।।

ওগো ও প্রাচী-র দুলালি দুহিতা তরুণীরা,
ওগো জায়া ওগো ভগিনীরা! ডাকে সঙ্গীরা!
তোমরা নাই গো, লাঞ্ছিত মোরা তাই আজি,
উঠুক তোমার মণি-মঞ্জীর ঘন বাজি’
আমাদের পথে চল-চপল।
অগ্র-পথিক তরুণ-দল, জোর্ কদম্ চল্ রে চল্।।

নেমেছে কি রাতি, ফুরায় না পথ সুদুর্গম?
কে থামিস্ পথে ভগ্নোৎসাহ নিরুদ্যম?
ব’সে নে খানিক পথ-মঞ্জিলে, ভয় কী ভাই,
থামিলে দু’দিন ভোলে যদি লোকে- ভুলুক তাই!
মোদের লক্ষ্য চির-অটল!
অগ্র-পথিক ব্রতীর দল, বাঁধ্ রে বুক্, চল্ রে চল্।।

শুনিতেছি আমি, শোন্ ওই দূরে তূর্য-নাদ
ঘোষিছে নবীন ঊষার উদয়-সুসংবাদ!
ওরে ত্বরা কর্! ছুটে চল আগে- আরো আগে;
গান গেয়ে চলে অগ্রবাহিনী, ছুটে চল্ তারো পুরোভাগে!
তোর অধিকার কর দখল!
অগ্র-নায়ক রে পাঁওদল! জোর্ কদম্ চল্ রে চল্।।

[মার্চের সুর]


‘অগ্রপথিক হে সেনাদল’ কবিতাটি নজরুলের ‘জিঞ্জীর’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে ১০ নং কবিতা হিসেবে ‘অগ্র-পথিক হে সেনাদল’ শিরোনামে রয়েছে। তবে নজরুল গীতিকা’য় সংকলিত কবিতার সাথে অনেক লাইনে অমিল রয়েছে এবং স্তবক-বিন্যাস ও অনেক ক্ষেত্রে ভিন্নতর।