সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে

দেখা দিলে রাঙা মৃত্যুর রূপে এতদিনের কি গো রানি?
মিলন-গোধূলি-লগনে শুনালে চির-বিদায়ের বাণী।
যে ধূলিতে ফুল ঝরায় পবন
রচিলে সেথায় বাসর-শয়ন,
বারেক কপোলে রাখিয়া কপোল, ললাটে কাঁকন হানি,
দিলে মোর পরে সকরুণ করে কৃষ্ণ কাফন টানি।

নিশি না পোহাতে জাগায়ে বলিলে, ‘হলো যে বিদায় বেলা।’
তব ইঙ্গিতে ও-পার হইতে এপারে আসিল ভেলা।
আপনি সাজালে বিদায়ের বেশে
আঁখি-জল মম মুছাইলে হেসে,
বলিলে, ‘অনেক হইয়াছে দেরি, আর জমিবে না খেলা!
সকলের বুকে পেয়েছ আদর, আমি দিনু অবহেলা।’

‘চোখ গেল উহু চোখ গেল’ বলে কাঁদিয়া উঠিল পাখি,
হাসিয়া বলিলে, ‘বন্ধু, সত্যি চোখ গেল ওর না কি?’
অকূল অশ্রু-সাগর-বেলায়
শুধু বালু নিয়ে যে-জন খেলায়,
কী বলিব তারে, বিদায়-ক্ষণেও ভিজিল না যার আঁখি!
শ্বসিয়া উঠিল নিশীথ-সমীর, ‘চোখ গেল’ কাঁদে পাখি!

দেখিনু চাহিয়া ও-মুখের পানে-নিরশ্রু নিষ্ঠুর!
বুকে চেপে কাঁদি, প্রিয় ওগো প্রিয়, কোথা তুমি কত দূর?
এত কাছে তুমি গলা জড়াইয়া
কেন হুহু করে ওঠে তবু হিয়া,
কী যেন কী কীসের অভাব এ বুকে ব্যথা-বিধুর!
চোখ-ভরা জল, বুক-ভরা কথা, কণ্ঠে আসে না সুর।

হেনার মতন বক্ষে পিষিয়া করিনু তোমারে লাল,
ঢলিয়া পড়িলে দলিত কমল জড়ায়ে বাহু-মৃণাল!
কেঁদে বলি, ‘প্রিয়া, চোখে কই জল?
হল না তো ম্লান চোখের কাজল!’
চোখের জল নাই-উঠিল রক্ত-সুন্দর কঙ্কাল!
বলিলে, ‘বন্ধু, চোখেরই তো জল, সে কি রহে চিরকাল?’

ছল ছল ছল কেঁদে চলে জল, ভাঁটি-টানে ছুটে তরী,
সাপিনীর মতো জড়াইয়া ধরে শশীহীন শর্বরী।
কূলে কূলে ডাকে কে যেন, ‘পথিক,
আজও রাঙা হয়ে ওঠেনি তো দিক!
অভিমানী মোর! এখনই ছিঁড়িবে বাঁধন কেমন করি?
চোখে নাই জল-বক্ষের মোর ব্যথা তো যায়নি মরি!’

কেমনে বুঝাই কী যে আমি চাই, চির-জনমের প্রিয়া!
কেমনে বুঝাই-এত হাসি গাই তবু কাঁদে কেন হিয়া!
আছে তব বুকে করুণার ঠাঁই,
স্বর্গের দেবী-চোখে জল নাই!
কত জীবনের অভিশাপ এ যে, কতবার জনমিয়া-
পারিজাত-মালা ছুঁইতে শুকালে-হারাইলে দেখা দিয়া।

ব্যর্থ মোদের গোধূলি-লগন এই সে জনমে নহে,
বাসর-শয়নে হারায়ে তোমায় পেয়েছি চির-বিরহে!
কত সে লোকের কত নদনদী
পারায়ে চলেছি মোরা নিরবধি,
মোদের মাঝারে শত জনমের শত সে জলধি বহে।
বারেবারে ডুবি বারেবারে উঠি জন্ম-মৃত্যু-দহে।

বারে বারে মোরা পাষাণ হইয়া আপনারে থাকি ভুলি,
ক্ষণেকের তরে আসে কবে ঝড়, বন্ধন যায় খুলি।
সহসা সে কোন্‌ সন্ধ্যায়, রানি,
চকিতে হয় গো চির-জানাজানি!
মনে পড়ে যায় অভিশাপ-বাণী, উড়ে যায় বুলবুলি।
কেঁদে কও, ‘প্রিয়, হেথা নয়, হেথা লাগিয়াছে বহু ধূলি?’

মুছি পথধূলি বুকে লবে তুলি মরণের পারে কবে,
সেই আশে, প্রিয়, সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে!
কে জানিত হায় মরমের মাঝে
এমন বিয়ের নহবত বাজে!
নব-জীবনের বাসর-দুয়ারে কবে ‘প্রিয়া’ ‘বধূ’ হবে-
সেই সুখে, প্রিয়া, সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে!