নয় এ মধুর খেলা

আজকের এই লেখাটিকে খেলার ভূমিকা বলা যেতে পারে। এক অর্থে সব লেখাই লেখার ভূমিকা। মওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর ‘India wins freedom’ শুরু করতে গিয়ে বলেছিলেন, আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহটির শুরুর ও শেষের পৃষ্ঠাগুলাে কবেই হারিয়ে গেছে। সব লেখারই বােধহয় তাই, শুরু ও শেষ খুঁজে পাওয়া যায় না। বছর দুই পর লিখতে বসে বুঝতে পারছি কথাটা ঠিকই, অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস পায়। ইত্তেফাকে ‘প্রিয়-অপ্রিয়’ লিখেছি তিরিশ বছর। যদিও জানি, ‘Old order changeth yielding place to the new’, কিন্তু কবি ও ভাবুকেরা মনে করেন ‘Ripeness is all’, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, পুরানাে জানিয়া চেয়াে না আমারে আধেক আঁখির কোণে…’। সেকথা ভেবেই ঠিক করেছি আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি’, সেটুকুই আমার কাজ। এই পথে চলতে গিয়ে দেখলাম ‘দিনগুলি মাের সােনার খাঁচায় রইল না/সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।’ কম তাে হোঁচট খেলাম না, তবু পথ ছাড়িনি। আছি, পথে আছি, এও তাে জানি যে, ‘পথ আমাকে সে-ই দেখাবে যে আমাকে চায়।’ এই ভরসাতেই এত পথ হাঁটা। পথ হারিয়ে ফেলেছি, মাঝে মাঝে মুষড়েও যে না পড়েছি তা নয়, ক্লান্তি, অবসাদও আচ্ছন্ন করেছে কতবার, তারপরও দাঁড়িয়ে আছি, চলেছি, কেননা, ‘মাঝে মাঝে বটে ছিড়ে গেছে তার, / তা-ই নিয়ে কেবা করে হাহাকার’?

আগেও বলেছি এই লেখাটি অনেকটাই আত্মকথা। কথাও তাে কিছু কম জমা হয়নি। সব কথা হয়তাে বলারও নয়। তবে জীবনের এইসব কঠিন সত্য ও বাস্তবের মুখােমুখি দাঁড়িয়ে এ কথাটা বুঝতে শিখেছি যে, সত্য কখনাে বঞ্চনা করে না। তবে আমরা সত্যের মুখখামুখি দাঁড়াতে ভয় পাই। সে কারণেই সমাজে এই দুর্দিন। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার নামে মিথ্যার আশ্রয় নিলে সত্যকেই নির্বাসিত করা হয়। প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবিদের নির্বাসিত করতে চেয়েছিলেন। সে কি এই কারণে যে, কবিরা সত্য বলেন? দেশ থেকে রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে নির্বাসিত করার জন্য কম ছলাকলা তাে দেখলাম না। অনির্বাচিত সরকার নির্বাচিত সরকারের স্থান দখল করে কীভাবে সুকৌশলে রাজনীতি ও গণতন্ত্রকেই নির্বাসনে পাঠিয়ে দিতে চাইল, ভাঙাগড়া, উচ্ছেদ-উৎখাত, দমন-শাসন চলল তাও তো চোখের সামনেই দেখলাম। তথাকথিত সততার ধুয়া তুলে কথায় কথায় দুর্নীতির মিথ্যা অভিযােগ, বস্তি ভাঙা, ঘরবাড়ি ভাঙা, ফুটপাত থেকে দোকান উচ্ছেদ, সেই প্রক্রিয়ায় সপ্তাহের হলিডে মার্কেটে একটু জায়গা পাওয়ার জন্য রাতে এসে রাস্তায় শুয়ে থেকে গুলিস্তানের মােড়ে গাড়ির নিচে জীবন দিল দরিদ্র হকার, এসবই হলাে সংস্কারের নামে। বলা হলাে, গাছের ফল, নদীর জল, জলের মাছ-সবই চলবে রােডম্যাপ অনুযায়ী। এতকিছুর একটাই উদ্দেশ্য নিঃরাজনীতিকরণ। দেশের স্বাভাবিক রাজনৈতিক জীবনের গতি রুদ্ধ করে ব্যবস্থাপত্রের রাজনীতিতে দেশের মঙ্গল করা যায় না। কিন্তু এইসব দুর্দিনে প্রয়ােজনীয় মুহূর্তে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা সৎসাহস দেখাতে ব্যর্থ হই, আমাদের দুর্ভাগ্যের এটাও একটি বড় কারণ। রঁমা রঁল্যা এজন্য বলেছিলেন, ‘Silence is crime’. একটি কাহিনী মনে পড়ছে। ফ্যাসিস্ট জার্মানিতে তখন সাহসের বড় দৈন্য। কারাে সত্য বলার সাহস নেই। নিজের প্রাণ আর মান বাঁচানাের জন্য সেদিন জার্মানিতে সবাই বেছে নিয়েছিল আপসের সহজ রাস্তা। কাহিনীর নায়ক এক জার্মান অধ্যাপক। নাম হেলমুট। হিটলারের ফ্যাসিস্ট জার্মানিতে তিনিও তার নিজের শিশুপুত্রের মুখ চেয়ে নীরবে মেনে নিয়েছিলেন সব অবিচার। কোনাে অন্যায়ের বিরুদ্ধেই সেদিন তিনি প্রতিবাদ করেননি। তারপর একদিন রাইনের তীরে শান্তি ফিরে এসেছে। অধ্যাপকের শিশুপুত্রটি তখন যুবক। একদিন বৃদ্ধ পিতার কাছে যুবক পুত্রটি জানতে চাইল কী করে তার পিতাও সেই অন্যায়-অবিচার মেনে নিয়েছিলেন। বৃদ্ধ অধ্যাপক ধীরে ধীরে বললেন, ‘সে তােমারই জন্য, তােমারই মুখ চেয়ে।’ মুহূর্তে মুখ ফিরিয়ে নিল তার যুবক পুত্র, তখনই বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। আর কখনােই ফিরে আসেনি। যে পুত্রের জীবন রক্ষার জন্য জার্মান অধ্যাপক একদিন নিজের বিবেক বিসর্জন দিয়েছিলেন, সেই পুত্রই তাকে পরিত্যাগ করে চলে গেল। সত্যকে যে পরিত্যাগ করে, সত্যও একদিন তাকে পরিত্যাগ করে চলে যায়।

ভেবেছিলাম নিজের কথা দিয়েই শেষ করব আজকের লেখাটি। কিন্তু এই ক’দিনেই সমাজে এমন কিছু ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে দেখলাম যা উল্লেখ না করে এই লেখা শেষ করলে নিজের মনেই স্বস্তি পাব না। খবরের কাগজের পাতা খুললেই দেখতে পাচ্ছি এমন সব নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার ভয়াবহ ঘটনা যার দিকে চোখ ফেরালে সমাজের brutality-র চিত্রটাই বড় হয়ে চোখে ভেসে ওঠে। সারা বিশ্ব যখন ফুটবল উৎসবে মাতােয়ারা, আমাদের দেশে তখন মানুষের গায়ে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে মানুষ মারার বহ্ন্যুৎসব চলে। সমাজ কতটা নিষ্ঠুর, নির্দয় ও অমানবিক হয়ে উঠলে এমন নৃশংস ঘটনা ঘটাতে পারে তা ভাবতেও বিচলিত বােধ করতে হয়। এই ঘটনা ঘটেছে মানুষের মনে ভীতি ও ব্রাস সঞ্চারের জন্য হরতাল সমর্থকদের তাণ্ডবের ফলে। অস্বীকার করি না হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার কিন্তু সেই অধিকারের নামে যদি আগুনে মানুষ পুড়িয়ে মারার বীভৎসতা চলে, তাহলে গণতান্ত্রিক বিধানেই বােধহয় সেই অধিকার খর্ব করা প্রয়ােজন। গণতান্ত্রিক অধিকার মানে অবাধ নৈরাজ্য নয়, উন্মুক্ত রাজপথে মানুষের গায়ে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে সেই পেট্রোলে জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি নিক্ষেপ করে মানুষ মারার মতাে হিংস্রতা নয়। একে কি হরতালের উদ্দেশ্যে পিকেটিং বলা যায়? কোনাে সভ্য সমাজই এই ধরনের নৃশংসতা মেনে নিতে পারে না। হরতালের আগের দিন আগেও পিকেটিং, পথসভা, মিছিল, মশালমিছিল হতাে, কিন্তু মানুষের গায়ে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে ম্যাচের কাঠি ছুঁড়ে নারকীয় বহ্ন্যুৎসব হতে দেখিনি। হরতাল ডাকলে পিকেটিং, মিছিল হয়, কিন্তু এক মাস আগে হরতালের ডাক দিয়ে মাসব্যাপী এভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি বােধহয় এই প্রথম। এসব দেখলে আরাে আতঙ্কিত বােধ করতে হয়। যারা রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত বা বানচাল করতে চায়, নিঃরাজনীতিকরণের সুযােগ খোঁজে এসব ঘটনা তাদেরই অনুকূলে যায় কী না তা সকলেরই খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখা দরকার। ফ্যানের দোকানের সামান্য কর্মচারী ফারুক, যার স্বল্প আয়ে মা-ভাই-বােনদের ভরণপােষণ চলত, সেই দরিদ্র পরিবারটি এখন কোথায় দাঁড়াবে? মাত্র কিছুদিন আগেই নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনায় এত মানুষের প্রাণ গেল, সেই ক্ষত না শুকাতেই আবার পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে মানুষ মারা, এই নৃশংসতা যেন দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না।

মহাত্মা গান্ধী ঔপনিবেশিক শাসনামলে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রতিবাদের পন্থা হিসেবে হরতাল ও অনশনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু সে কোনাে সহিংস পন্থা নয়, শান্তিপূর্ণ অনশন ও হরতাল। গান্ধীজী চিরকালই অহিংসার নীতি ও আদর্শে বিশ্বাসী। তার সংগ্রাম ও প্রতিবাদের পন্থা ছিল অসহযােগ, পিস অফেনসিভই তাঁর প্রতিবাদের ভাষা। জানি না মহাত্মা গান্ধী বেঁচে থাকলে হরতালের এই হিংস রূপ দেখে কতটা ব্যথিত ও বিচলিত বােধ করতেন? গণতন্ত্র শুধু অর্জন করলেই হয় না, গণতন্ত্র রক্ষাও করতে হয়। তার জন্য কারাে দায়িত্বই কম নয়। গণতান্ত্রিক অধিকারকে স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈরাজ্যে রূপান্তরিত করলে তার ফল কখনােই শুভ হয় না। আমরা তার দৃষ্টান্ত তাে কম দেখলাম না। কিন্তু ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নিতে চায় না, এটাও বােধ হয় ইতিহাসেরই শিক্ষা। না হলে দেশে রাজনীতি উচ্ছেদ ও রাজনীতিকে কলঙ্কিতরূপে প্রতিভাত করার জটিল-কুটিল সব চক্রান্ত দেখেও আমাদের কোনাে চৈতন্যোদয় হলাে না কেন? দেশে বিদ্যমান একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক সরকারকে সংকটে ফেলার জন্য প্রথম থেকেই এমন উগ্রতা ও বিরুদ্ধাচরণের পথ বেছে নেওয়াই কি চলতে থাকবে? এই রাজনৈতিক কালচারের কি পরিবর্তন হওয়া উচিত নয়? এতে লাভ কার, রাজনীতির, গণতন্ত্রের, না অন্য কারাের? সব কাজেরই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া আছে। কোনাে ঘটনাই কারাে দৃষ্টি এড়ায় না। রাজনীতির বিরুদ্ধে যারা কথা বলে, যারা নিঃরাজনীতিকরণ চায়, রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের হেয় করতেই আনন্দবােধ করে এ সব ঘটনা তাদেরই রাজনীতির বিরুদ্ধাচরণের পথ আরাে প্রশস্ত করে দেয় কী না সে প্রশ্নটিও কোনােভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। ফুটবলই এই মুহূর্তে পৃথিবীর প্রধান আকর্ষণ। আত্মকথা দিয়ে শুরু করলেও খেলা দিয়েই এই লেখাটা শেষ করব। অমি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পাের দেশ আর্জেন্টিনার ফুটবলের অনুরাগী। তাদের এমন পরাজয় যা ফুটবলের রূপকথাতেই কেবল সম্ভব, তা দেখে, বিশেষত মেসির অশ্রুসজল চোখের দিকে তাকিয়ে আমি নিজেও বড় কাতর বােধ করেছি। বাংলাদেশের অগণিত আর্জেন্টিনা ফুটবল প্রমিকের সাথে আমিও আছি। দুঃখ করাে না বন্ধুরা, মেসি আবার আসবে। জীবনটাও তাে একটা খেলাই, কিন্তু নয়, নয়, নয়, এ মধুর খেলা।