১৬ই ডিসেম্বর ও ভারতীয় সৈন্যের অনুপ্রবেশ

সশস্ত্র যুদ্ধে জাগ্রত বাঙালী জাতিকে ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী প্রথমদিকে স্বাগত জানালেও ধীরে ধীরে তাদের সে উৎসাহে ভাটা পড়ে। বাঙালীর দুর্দমনীয় জাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্ফোরণ তাদের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাহ্যিকভাবে মৈত্রীর বন্ধন রক্ষা করা গেলেও তাদের অন্তরে ছিল ষড়যন্ত্র আর সন্দেহ। পূর্ব বাংলার বাঙালীদের জাগরণে পশ্চিম বাংলার বাঙালীদেরকেও বিদ্রোহী করে তুলতে পারে এই সন্দেহে এবং ভীতির কারণেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দ্রুত মুক্তিযুদ্ধ অবসানের ফর্মুলা সন্ধানে ব্যতিব্যস্ত ছিল। তাদের এই মহান দায়িত্ব পালনে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে যেভাবে গণমানুষের ঢল বর্ডার অতিক্রম করছিল তাতে মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়বে এ আশঙ্কায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এবং ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী উভয়ই সমানভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘস্থায়িত্ব উভয়েরই স্বার্থের বিপক্ষে যেতে পারে বলে তাঁরা অনুমান করেছে।

যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্ষমতালোভী আওয়ামী লীগও মুক্তিযুদ্ধের উপরে তাদের পোদ্দারী হারিয়ে বসবে আশঙ্কা করেছে। মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়লে তাদের মনে আরও যে ভয়টি দানা বেঁধেছিল তা হলো মুক্তিযুদ্ধের উপর যুদ্ধরত বাঙালী সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব এবং নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার ভয়। এক্ষেত্রেও যুদ্ধবিমুখ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে প্রতিনিয়তই ভারতীয় শাসক গোষ্ঠীর কাছে অনুনয়-বিনয় জানাত মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সরাসরি নেতৃত্ব প্রদানের জন্যে। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই যে ভারতীয় সেনাবাহিনী কৌশলের সাথে পেছন থেকে নেতৃত্ব প্রদান করে আসছিল এ সত্য যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোন মুক্তিযোদ্ধার কাছেই গোপন ছিল না। ভারতীয় বর্ডার ফোর্স বি, এস, এফ, কে সামনের সারিতে নিয়োজিত রেখে সেনাবাহিনী পেছন থেকে সবরকম লজিস্টিক সাহায্য প্রদান করা, সবরকম তথ্য সংগ্রহ করা এবং সামগ্রিকভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত ছিল। বস্তুতপক্ষে ‘৭১-এর আগস্ট মাস থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ-ভারত বর্ডারের সকল অঞ্চলে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়েছিল। এই দীর্ঘ চার মাস ধরেই বর্ডার অঞ্চলে ভারতীয় সৈন্যের বিন্যাস, পুনর্বিন্যাস এবং রণকৌশলগত দিক নিয়ে ব্যাপক তৎপরতা অব্যাহত ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপ ঘটেনি বলে যাদের ধারণা, তাঁরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর রণকৌশল এবং যুদ্ধ তৎপরতা সম্পর্কে মোটেও অবগত নয়। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ এক ধরনের ‘রেকী ফোর্স’ হিসেবেই গণ্য করেছে, এর অধিক নয়।

কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা ঘাঁটির সম্প্রসারণ এবং ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলাদের সশস্ত্র তৎপরতা ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষের মনে যেমন ভীতির সঞ্চার করে, ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছেও তা ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশের অভ্যন্তরে ‘গেরিলা ঘাঁটিগুলোতে’ যুদ্ধরত গেরিলা বাহিনীদের আনুগত্য ক্ষমতালোভী আওয়ামী লীগের পক্ষে দীর্ঘ দিন নাও থাকতে পারে সেই সন্দেহ এবং ভয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনতিবিলম্বে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার মসনদে বসানোর জন্যে বেহায়াপনার সাথে ধরনা দিতে থাকে। আওয়ামী লীগের এহেন আচরণ ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের জন্যে সোনায় সোহাগা হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ ভারতীয় চক্র নিজেরাই দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশে এক ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করার পরিকল্পনায় রীতিমত মশগুল ছিল। দুর্বল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অসহায় আত্মসমর্পণই ভারতীয় চক্রকে তাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। অপরদিকে ১৯৭১ সনের ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান কর্তৃক ভারতের পশ্চিম সীমান্তে আকস্মিক যুদ্ধ ঘোষণাও ভারতকে বাংলাদেশ অভিযানে সরাসরিভাবে অনুপ্রাণিত করে। এক তুমুল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভারত নিঃস্বার্থভাবে বাঙালীদের সুখ-শান্তির জন্য স্বাধীনতা এনে দেবে এ ধরনের ধারণা যারা পোষণ করেন, তাঁরা হয় ভারতের কট্টর সমর্থক না হয় তাঁরা ভারতের কৃপা ভিক্ষাকারীদের মধ্যে অন্যতম। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সাধারণ জনগণ বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার বাঙালী জনগণ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাধারণ সদস্য এবং নিম্নপদের অফিসারদের বিস্ময়কর মানবতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ পরিলক্ষিত হয়েছে। তাঁদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাদের সকল কর্মতৎপরতাই যে নিছক হীন স্বার্থভিত্তিক ছিল তা নয়, অসংখ্য ক্ষেত্রেই তাঁর অতুলনীয় মানবতাবোধের প্রমাণ রেখেছেন। যুদ্ধরত অবস্থায় প্রচণ্ডভাবে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও আমার দৃষ্টি তাদের সেই মানবতাবোধের স্বাক্ষর এড়িয়ে যায়নি। একথা স্মরণীয় যে, একটি দেশের সাধারণ জনগণের মানবতাবোধের সাথে সে দেশের শাসক চক্রের মূল্যবোধের কোন সম্পর্ক বা সংগতি নাও থাকতে পারে। ভারত ঠিক তেমনি একটি নমুনা। ভারত আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কই তাঁরা তো সেভাবে ‘নাগাল্যান্ড’, ‘মিজোরাম’, ‘গুর্খাল্যান্ড’ এবং পাঞ্জাবে শিখদের খালিস্তান স্বাধীন করার যুদ্ধে তেমন উদ্যোগ নিচ্ছে না? সে সকল ক্ষেত্রে তো বরং উল্টোটাই সঠিক। নাগা, মিজো, গুর্খা এবং শিখদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সমর্থন নেই কেন? সমর্থনের পরিবর্তে সেখানে ভারতীয় শাসক চক্র শ্বেত-সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে কেন? যে শাসক চক্র নিজের দেশের জনগণের স্বাধীনতা কামনা করে না, তাঁরা কি করে পূর্ব বাংলায় বসবাসরত বাঙালীদের স্বাধীনতা কামনা করতে পারে? এটা কি তাদের উদারতা নাকি তাদের নির্যাতনমূলক প্রতিক্রিয়াশীল শাসন কাঠামো সম্প্রসারণ করারই উদগ্র বাসনা? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ এবং বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর অভিযানকে উপরিউক্ত আঙ্গিকেই বিচার করতে হবে।

১৯৭১ সনের ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৬/১৭ই ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরিভাবে হস্তক্ষেপ করে এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধেও আনুষ্ঠানিকভাবেই যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই দিনগুলোতে মুক্তিযোদ্ধারাই সম্মুখের সারিতে যুদ্ধ করেছেন, অকাতরে শহীদ হয়েছে, পঙ্গু এবং আহত হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী পেছনে পেছনেই অগ্রসর হয়েছে। তবে এই চৌদ্দ দিনের যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীরও আনুমানিক ১২ থেকে ১৪ হাজার সদস্য প্রাণ হারিয়েছে। তাদের এই প্রাণ হারানো সার্থক হয়েছে কি? কার স্বার্থে ১৪ হাজার ভারতীয় সৈন্য প্রাণ বিসর্জন দিল? বাংলাদেশের স্বার্থে কিসের টানে? না, একটি ‘মার্সিনারী আর্মির’ সদস্যদের কোন স্বার্থ নেই, থাকতে পারে না। তাঁরা কেবল প্রাণ দেয় স্বার্থান্বেষী মহলের নির্দেশে, কোন প্রাণের টানে নয়। জীবন তাদের কাছেও প্রিয়, কিন্তু তবু তা তুচ্ছ, যেহেতু তাঁরা বেতনভুক কর্মচারী। বেতনভুকদের কোন আপন ইচ্ছে নেই, তাঁরা কেবল প্রভুর ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটাতে বাধ্য থাকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাধারণ সদস্যসহ নিম্নপদবীধারীরা ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল শাসক চক্রেরই সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে কেবল। বাংলাদেশের কোন খালে, কোন বিলে ভারতীয় বাহিনীর কোন সদস্য লাশ হয়ে ভেসে গেছে, সে ইতিহাস কেউ কোনদিন লিখবে না, তবে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সনে ভারতীয় সেনাপতি জেনারেল অরোরার কাছে পাকিস্তানী সেনাপতি জেনারেল নিয়াজী যে আত্মসমর্পণ করেছে সে ইতিহাস চিরযুগই অম্লান হয়ে থাকবে। বেতনভুক্তদের ইতিহাস লেখা হয় না, তাঁরা ইতিহাস নয়, তাঁরা ইতিহাসের খোরাক মাত্র। ঐতিহাসিক ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসানের দিন। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ভারতের পূর্ব অঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। যে যুদ্ধ বাঙালীদের সশস্ত্র গণবিস্ফোরণ এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার শেষ হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধিনায়কের কাছে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর অধিনায়কের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। হিসেব মিলছে না কেন? হিসেবের এই গরমিলের জন্যে দায়ী কে বা কারা? যারা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল যুদ্ধ শেষে পরাজিত শত্রুপক্ষ সেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করল না কেন? পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে তো কোন মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং মুক্তিকামী বাঙালী জনগণের মধ্যে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের হেতুটি দেখা দিল কেন- কোন উদ্দেশ্যে?

মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীর কাছে পাকিস্তানের পরাজিত জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করলেন না কেন? আত্মসমর্পণের সময় কর্নেল ওসমানী অনুপস্থিত ছিলেন কেন? আত্মসমর্পণের বেশ কয়েকদিন পরে কর্নেল ওসমানী ঢাকায় এলেন কেন? এ সময়কাল তিনি কোথায় ক্ষেপণ করেছেন। তিনি কি তাহলে সত্যিই কোলকাতায় বন্দী ছিলেন? আজো বাংলাদেশের জনমনে নানান প্রশ্নের ভীড় জমছে। এসব প্রশ্নের উত্তর দেশবাসী আওয়ামী লীগের কাছে প্রত্যাশা করছে, কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এবং ভারতে অবস্থানরত প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এ সকল প্রশ্নের জবাব দেয়ার আজ পর্যন্ত কোন তাকিদই বোধ করেনি।

তাছাড়া আত্মসমর্পণের প্রায় এক সপ্তাহ ‘পরে প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে ফিরে এসে বিনা প্রশ্নে গদিতে বসেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কেন অনুপস্থিত ছিলেন, সে সত্যটি উদঘাটন করার জন্য আজ পর্যন্ত কোন তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো না। অথচ মুক্তিযুদ্ধের এই অসহায় মহানায়ক কর্নেল ওসমানীর কতই না প্রশংসা। কেন এই মিছেমিছি প্রশংসা? এর অন্তরালে কি রহস্য? রহস্য তো নিশ্চয়ই রয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধিনায়কের কাছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ১৬ই ডিসেম্বর, যাকে আমরা ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে অভিহিত করি, সেই দিন থেকেই বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি অস্বীকার করা হয়েছে। ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বিজয় দিবস’-এর পরিবর্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে ইতিহাসে আনুষ্ঠানিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের পেছনে আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামকে অস্বীকার করা এবং পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্বাঞ্চলের রণাঙ্গনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয় ঘোষণা করা।

এই বিজয়ে বাংলাদেশের মুক্তিপিপাসু জনগণ এবং মুক্তিযোদ্ধারা ছিল নীরব দর্শক, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ছিল বিনয়ী তাবেদার এবং কর্নেল ওসমানী ছিলেন অসহায় বন্দী। এ যেন ছিল ভারতের বাংলাদেশ বিজয় এবং আওয়ামী লীগ সরকার এই নব বিজিত ভারতভূমির যোগ্য লীজ গ্রহণকারী সত্তা। সুতরাং যেমন সত্তা তেমনই তার শর্ত- আর যায় কোথায়। এতো গেল ১৬ই ডিসেম্বর সম্পর্কে কিছু কথা।

অনুরূপভাবে ১৭ই ডিসেম্বর তারিখে খুলনার সার্কিট হাউস ময়দানেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। নবম সেক্টরের অধিপতি হিসেবে আমি সেখানে উপস্থিত থাকলেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্তৃপক্ষ আমাকে একরকম জোর করেই পেছনের সারিতে ঠেলে দেয়। বার বার প্রচেষ্টা চালানো সত্তেও আমাকে সামনে আসতেই দেয়া হলো না। আমার প্রতিপক্ষ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল দলবীর সিংকে দিয়েই সেই আত্মসমর্পণের নেতৃত্ব বজায় রাখা হয় অথচ দলবীর সিংয়ের অধীনস্থ সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে সব সময়ই আমার বাহিনীর অনেক পেছনে অবস্থান করত।

মুক্তিযোদ্ধাদের দীর্ঘ ন’টি মাসের অসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং আত্মহুতির মধ্য দিয়ে রচিত বিজয়পর্ব এভাবেই ভারতীয় শাসক চক্র দ্বারা লুণ্ঠিত হয়ে যায়। সংগ্রামী, লড়াকু বাঙালী জাতি প্রাণপণ যুদ্ধ করেও যেন বিজয়ী হতে পারল না, পারল কেবল অপরের করুণায় বিজয় বোধ দূর থেকে অনুভব করতে। বিজয়ের সরাসরি স্বাদ থেকে কেবল বাঙালী জাতি বঞ্চিত হলো না, বঞ্চিত হলো প্রকৃত স্বাধীনতা থেকেই। সুতরাং সেই বঞ্চনাকারীদের কবল থেকে বঞ্চিতদের ন্যায্য পাওনা আদায় করার লক্ষ্যে আর একটি প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন কি এখনও রয়ে যায়নি?