মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান

আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবীভিত্তিক নির্বাচনে ব্যাপক বিজয় লাভ সমগ্র জাতিকেই উৎসাহিত এবং অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৭০ সনের সেই নির্বাচনী ফলাফল বাঙালী জাতীয়তাবাদেরই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ বলে প্রতীয়মান হয়েছিল আমার কাছে। সেদিন আওয়ামী লীগের বিজয় জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী নয় এবং আওয়ামী লীগ বহির্ভূত এদেশের বুদ্ধিজীবী, আমলা, সেনাবাহিনী, পুলিশ, ই.পি.আর, আনসারসহ সাধারণ জনগণও আওয়ামী লীগের বিজয়ে অভূতপূর্ব উল্লসিত হয়েছিল। সে মুহূর্তে আওয়ামী লীগ অতি সার্থকভাবেই জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারণ এবং লালন করেছিল। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে, ক্ষেতে-খামারে, অফিস-আদালতে, হাটে, ঘাটে, মাঠে, নদীতে-সাগরে এমনকি বিদেশ-বিভূঁয়ে বসবাসরত প্রত্যেকটি বাঙালীর বুক জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বেলিত আলোড়িত হয়ে উঠেছিল। আমরা বিহারী নই, আমরা নই পাঞ্জাবী, আমাদের পরিচয় আমরা বাঙালী এই চেতনাবোধে জাগরিত হয়ে উঠেছিল বাঙালীর মন ও প্রাণ। এর ব্যতিক্রম ছিল কেবল তাঁরা ই, যারা ‘৭০-এর সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী ভূমিকায় লিপ্ত হয়ে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছিল। তাঁরা আওয়ামী লীগের বিজয়ে খুশী তো হতে পারেইনি, বরং শঙ্কিত ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। তখন থেকেই তাদের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে ওঠে যে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয়ের পেছনে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কারসাজি ছিল। অনেকে এ কথাও প্রমাণ করতে চেয়েছে যে, ১৯৪৭ সনে ভারত বিভক্তির সময় যে সকল হিন্দুরা পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চলে গিয়েছিল, তাদের বেশ একটা সংখ্যা বর্ডার পাড়ি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবের পক্ষে ভোট প্রদান করার জন্য চলে আসে। এটা সত্য কি মিথ্যা তা জানা নেই। স্বাধীনতার এত বছর পরে ঐ ধরনের একটি অভিযোগ শুনতে অনেকের কাছেই আজগুবি মনে হলেও, ব্যাপারটি আজ পর্যন্ত তলিয়ে দেখা হয়নি, কিংবা দেখার তাকিদও বোধ করেনি কেউ। আদৌ এমনটি হয়েছিল কি না। হলে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হয়েছিল, না পূর্ব পরিকল্পিত? এ ধরনের পরিকল্পনার পেছনে উদ্দেশ্য কি ছিল- শুধুই কেবল আওয়ামী লীগের বিজয়কে নিশ্চিত করা না আরো সুদূরপ্রসারী কিছু? এটা কি তবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেরই মগজের খেলা ছিল, না আওয়ামী নেতৃত্বও এ সম্পর্কে ছিল সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল? স্বাধীনতার ১৭ বছর পরেও আমার মত একজন সাধারণ লড়াকু মুক্তিযোদ্ধার মনে এ প্রশ্নগুলো নিভৃতে উঁকি-ঝুঁকি মারে এ কারণেই যে, ২৫শে মার্চের সেই ভয়াল রাতের হিংস্র ছোবলের সাথে সাথেই পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী এবং পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যবর্গ কি করে পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে পরিচিত ভারতের মাটিতে আশ্রয় গ্রহণের জন্য ছুটে যেতে পারল? কোন্ সাহসে কিংবা কোন্ আস্থার উপর ভর করেই বা তাঁরা দলে দলে ভারতের মাটিতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল? তাহলে কি গোটা ব্যাপারটাই ছিল পূর্ব পরিকল্পিত? তাহলে কি স্বাধীনতা বিরোধী বলে পরিচিত ইসলামপন্থী দলগুলোর শঙ্কা এবং অনুমান সত্য ছিল। তাদের শঙ্কা এবং অনুমান যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে দেশপ্রেমিক কারা? আমরা মুক্তিযোদ্ধারা না রাজাকার-আলবদর হিসেবে পরিচিত তাঁরা? এ প্রশ্নের মীমাংসা আমার হাতে নয়, সত্যের উদঘাটনই কেবল এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর নির্ধারণ করবে। উত্তর যা-ই হোক, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার চিরদিনেরই দাবী থাকবে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা- আমিই সাচ্চা দেশপ্রেমিক। অন্যায়কে আমি ঘৃণা করতে শিখেছি, অন্যায়কে আমি চিরদিনই ঘৃণা করব। নির্যাতিত মানবতার পাশে আমি দাঁড়িয়েছি বলে আমি গর্বিত। আমার গর্ব খাটো করার অধিকার কারো নেই। ষড়যন্ত্রের কালোহাত আমি দেখিনি, আমি দেখেছি গণহত্যা। তাই রুখে দাঁড়িয়েছি হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে।

কারো পূর্ব পরিকল্পনা খতিয়ে দেখার সময় আমার ছিল না। আমার সম্মুখে ছিল দায়িত্ব, আমি তা কেবল পালন করেছি। যুদ্ধের মাধ্যমে মানবতার সেবা কতটুকু হয়েছে জানি না, তবে অপরাধীদের মোকাবিলা আমি সক্ষমভাবেই করেছি। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী হিসেবে আমি নিপীড়িত ছিলাম। সেনাবাহিনীতে আমাকে ভেতো বাঙালী বলে উপহাস ও কৌতুক করা হতো। ‘৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পরে আমি ব্যক্তিগতভাবে দারুণ উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম। রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে হাতেখড়ি না থাকলেও আমি চেতনাহীন ছিলাম না। বাঙালীর জীবনের দুঃখ-কষ্ট আমাকে ভাবিয়ে তুলতো, বাঙালী-বিহারী, বাঙালী-পাঞ্জাবী দ্বন্দ্ব আমাকে পীড়া দিত। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য আমাকে লাঞ্ছিত করতো। তাই ‘৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়ের মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আমার অবিকাশিত সত্তার মুক্তির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত। সত্য অনুসরণে আমার নিষ্ঠা থাকলেও প্রতিহিংসার অনল আমাকে অহরহ দহন করেছে। এ অনল আমি জ্বলতে দেখেছি প্রত্যেকটি সাধারণ বাঙালীর বুকে। এই প্রতিহিংসার দাবানল বিস্ফোরিত হলো আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয়ের মধ্য দিয়ে। বিহারী তাড়াও, পাঞ্জাবী তাড়াও এক কথায় অবাঙালী পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাড়াও এই চেতনাটি অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বিকশিত হতে লাগল। সত্তরের শেষ এবং একাত্তরের শুরুর সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী জনগণের মাঝে বিজাতীয়দের চরম ঘৃণা ও বিদ্বেষ পরিলক্ষিত হলেও ইসলাম ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ মোটেও পরিলক্ষিত হয়নি, অথবা ধর্মহীনতা আমাদের পেয়ে বসেনি। তৎকালীন সময়ে কট্টর আওয়ামী লীগার বলে পরিচিত নেতা-কর্মীদের মুখে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ নাম গন্ধও শুনতে পাইনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দামাল তরুণ-যুবকদের অধিকাংশই ছিল এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সন্তান-সন্ততি। যুদ্ধের রক্তাক্ত ময়দানেও আমি মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেছি বাকায়দা নামায পড়তে, দরূদ পাঠ করতে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসককুল পবিত্র ইসলাম ধর্মকে বিভিন্ন সময়ে তাদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করেছে বিধায় তাদের বিরুদ্ধে সচেতন জনগণ সোচ্চার ছিল বটে, তবে প্রকাশ্যে পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রতি কোন মহলই ঘৃণা কিংবা বিদ্বেষ প্রদর্শন করেনি। ইসলাম ধর্মের বিষয়টি আমি এখানে এ কারণে উল্লেখ করেছি যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধের পরের ইসলাম- এর মধ্যে হঠাৎ করে এমন কি ঘটে গেল যাতে ইসলামের কথা শুনলেই কোন কোন মহল পাগলা কুকুরের মত খিঁচিয়ে উঠেন। যে দেশের শতকরা নব্বই জনেরও অধিক পবিত্র ইসলাম ধর্মের অনুসারী, সে দেশে এ করুণ উন্মাদনার মধ্য দিয়ে ধর্মের নিকুচি করা কি আদৌ যুক্তিসম্মত? এই দুঃখজনক এবং লজ্জাকর অধ্যায়ের জন্য দায়ী কে বা কারা? বাস্তবতার অস্বীকৃতিই প্রতিক্রিয়াশীলতা নয় কী? অপরদিকে বাস্তবতার স্বীকৃতিই প্রগতির শর্ত এবং দাবী নয় কী? তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভেই বর্তমান বাংলাদেশ ভূমিষ্ঠ হয়েছে। সেই পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের আচার-আচরণ, উৎসব অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ মুক্তিযুদ্ধের এক খোঁচায়ই কি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে? এটা কি কারো খেয়াল-খুশীর উপর নির্ভরশীল, না বাস্তব-নির্ভর? আমাদের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ, আমাদের জাতীয় জীবনকে সুষ্ঠুভাবে বিকশিত করতে সক্ষম। সত্যানুরাগই কেবল আমাদের মুক্তির দিশারী হতে পারে অন্যথায় আমাদের ধ্বংসের জন্য আমরাই যথেষ্ট। এ বিষয়ে অধিকতর আলোচনা পরবর্তী অধ্যায়সমূহে সন্নিবেশিত করা হবে।