মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রকৃত অবস্থা

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধবিরতির পর থেকে ১৯৭১ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত আমি পাকিস্তানের মুলতান শহরে ১২ নম্বর ক্যাভালরী রেজিমেন্টে (ট্যাংক রেজিমেন্ট) চাকরীরত ছিলাম। ১৪ই ফেব্রুয়ারী এক মাসের ছুটি নিয়ে ঢাকায় অবতরণ করি। তারপরে বরিশালের উজিরপুর থানায় দেশের বাড়িতে থাকাকালীন অবস্থায় ২৬ মার্চ সকাল ৮টায় আমি বরিশাল শহরে মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব গ্রহণ করি। মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে দেশে আসা সৈনিক দেশ-মাতৃকার দুর্দিনে মায়ের রোগশয্যা ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি বৃহত্তর ডাকে সাড়া দিতে। শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। তরুণ যুবকদের বুকে প্রচণ্ড আবেগ, উচ্ছাস ও উত্তেজনা- বয়স্কদের চোখে-মুখে ভীতি, অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগ। শিশু-কিশোরদের চোখজুড়ে সীমাহীন কৌতূহল- নারী সমাজের বুক অজানা উৎকণ্ঠায় প্রকম্পিত। অহরহ মায়ের বুক খালি করে হাজার হাজার তরুণ যুবকরা ছুটে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে। দিকে দিকে বাংলার জননীর অশ্রুসিক্ত চোখের উদাস চাহনিই যেন তাদের ছেলে-সন্তানদের পিছু পিছু দোয়া-আশীর্বাদ নিয়ে ছুটছে। পরিবেশ-পরিস্থিতি থমথমে। মানুষ কেবল ছুটে চলছে এখান থেকে ওখানে, শহর থেকে গ্রামে। এর মধ্যে রয়েছে তাড়া খাওয়া সেনা, পুলিশ এবং ই.পি.আর বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরাও। এখানে-সেখানে হঠাৎ গুলির শব্দ। তরুণ যুবকরা ট্রেনিং নিচ্ছে এবং তাদেরই সংগে প্রতিনিয়ত যোগদান করে চলছে তাড়া খাওয়া সেই সশস্ত্র সদস্যরা। তাদের চোখে-মুখে আগুন ঠিকরে দেশ স্বাধীন করার অংগীকার সোচ্চারিত হচ্ছে।

বিহারী এবং অবাঙালী অধিবাসীরা প্রাণের ভয়ে এদিক-ওদিক, ঝোঁপজঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কারো সঙ্গে শিশু সন্তান, কারো সঙ্গে যুবতী মেয়ে। প্রাণ এবং সম্ভ্রম দুটোই বাঁচিয়ে চলতে হবে, অথচ মানব হিংস্রতার মুখে এ কোনটিরই সামান্যতম নিরাপত্তা নেই। বাঙালীর ভয়ে বিহারী পালিয়ে বেড়াচ্ছে, আর বিহারী-পাকিস্তানীদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে বাঙালী। অথচ কারো সঙ্গে কারো কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই, তবু ‘৭১-এর ২৫শে মার্চের পরে শক্রতার যেন কোন শেষ নেই। স্বাধীনতার নামে স্বার্থবাদী মহলের ক্ষমতা দখলের উন্মত্ততা ঘর সংসার করা সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের মধ্যে আকস্মিকভাবেই জন্ম দিয়েছে ভয়াবহ হিংস্রতা এবং প্রতিশোধ গ্রহণের বর্বর নেশা। মানুষ মানুষের মধ্যকার স্বাভাবিক মানবতাবোধভিত্তিক সম্পর্কের ছেদ ঘটেছে, সকলেই যুদ্ধংদেহী।

পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অতর্কিতে হামলা দিচ্ছে বিভিন্ন শহরে বন্দরে। টার্গেট হচ্ছে তরুণ, যুবক, ছাত্র এবং শ্রমিক সমাজ। সুন্দরী নারীরা বিশেষ টার্গেটরূপে বিবেচিত। শহরের বিভিন্ন ডাকবাংলোগুলোতে বিলাস-অনাচারের জমজমাট পাকবাহিনীর আড্ডা। পচা গলিত লাশের চারিদিকে শেয়াল, কুকুর ও শকুনের ভীড়। রাতের গভীরে নির্যাতিত নারীর বুকফাটা চিৎকার। বধ্যভূমিতে মেশিনগানের ব্রাশফায়ারের ঠা ঠা শব্দ। নদীতে হামলাকারী গানবোটের বিকট উল্লাস। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার দলে দলে শরণার্থীরূপে বর্ডারে আহাজারী। ত্বরিতে নৌকায় নদী পাড়ির সময় মাঝ নদীতে নৌকাডুবি- আপনজনদের হাহাকার। পঙ্গু ও অসহায়দের আর্তনাদ। বাতাসে বারুদের গন্ধ। মুক্তিযুদ্ধ চলছে।

হাট বাজার জমছে না। ব্যবসা বাণিজ্যে ভাটা। মিল ফ্যাক্টরী, কারখানাগুলো নীরব শূন্য শূন্য। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিগুলো নিস্তব্ধ। অফিস-আদালতগুলো প্রাণহীন। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের অনেকেই দেশের অভ্যন্তরে গা-ঢাকা দিয়ে আছে। কিছু কিছু বর্ডার অতিক্রম করে ভারতে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সেনাবাহিনী থেকে ছুটে আসা তরুণ অফিসারদের নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং শিবির। দলে দলে তরুণ ছাত্র যুবকরা যোগ দিচ্ছে ট্রেনিং শিবিরে।

সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে সর্বস্তরের সাধারণ জনগণ। দেশ শত্রুমুক্ত হবে এটাই তাদের কামনা। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শত্রুপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে স্থাপিত স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারকেন্দ্র থেকে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভার ঘোষণা করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং শেখ মুজিবের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য জনাব তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, জনাব খোন্দকার মোশতাক আহমদ বৈদেশিক এবং আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী, জনাব এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জনাব মনসুর আহমদকে অর্থমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল মোহাম্মদ আতাউল হক ওসমান গণিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সনের ১৭ই এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর থেকে আরো ঘোষণা করা হয় ৯ জন সেক্টর কমান্ডারের নাম। সমগ্র রণক্ষেত্রকে ৯টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় এবং নবম সেক্টরের দায়িত্বভার অর্পিত হয় আমার উপর। প্রায় সমগ্র দক্ষিণ বাংলা নিয়েই গঠিত হয়েছিল এই ৯ নম্বর সেক্টর। বৃহত্তর বরিশাল জেলা, ভোলা, পটুয়াখালী, ফরিদপুর এবং খুলনা সহকারে ৯নং সেক্টর বস্তুতপক্ষে ছিল বৃহত্তম সেক্টর।

এই ঘোষণার সাথে সাথেই এলোমেলো মুক্তিযুদ্ধ একটা নির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করল। কোন সেক্টরে আওতাধীন নয় এমনও অনেক স্বাধীন গ্রুপ ছিল যারা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় তৎপর ছিল। এদের মধ্যে টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী এবং বরিশালের একটা অঞ্চলে সর্বহারা পার্টির নেতা সিকদার বিশেষভাবেই উল্লেখযোগ্য। আরো কিছু বামপন্থী দল তাদের নিজস্ব উদ্যোগেই যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। তাঁরা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেনি। তবে ৯টি সেক্টর ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই পাক বাহিনী অধিকতর সতর্ক এবং সক্রিয় হয়ে পড়ল। হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধি পেল, মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরবাড়ী পোড়ানো শুরু হলো। দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি দানা বাঁধতে লাগল। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি জন্ম নিল পুরাতন মুসলিম লীগ, নেজাম-ই-ইসলাম, জামায়াত-ই-ইসলাম সহ অন্যান্য ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠনসমূহ থেকে।

তাদের যুক্তি হলো যে, তাঁরা বাঙালীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নয়, তবে তাঁরা ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির সাহায্য নিয়ে দেশ স্বাধীন করার পক্ষে মোটেও নয়। কারণ হিসেবে তাঁরা মত প্রকাশ করেছেন যে, পাকিস্তানী শাসক-শোষকের শোষণ-যুলুম থেকে মুক্ত হয়ে ভারতীয় শাসক-শোষকদের অধীনস্থ হওয়াকে স্বাধীনতা হিসেবে বিবেচনা হওয়ার কোন যুক্তি নেই। তাঁরা ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তিকে পাকিস্তানী আধিপত্যবাদী শক্তির তুলনায় অধিকতর বিপজ্জনক বলে গণ্য করেছেন। তাদের মতে ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী মুসলমানদের বাসভূমি সৃষ্ট পাকিস্তানকে কেবল দ্বিখণ্ডিত করতে আগ্রহী নয়, বরং দ্বিখণ্ডিত করার পরে পূর্ব অঞ্চল অর্থাৎ বাংলাদেশকে সর্বতোভাবেই গ্রাস করার হীন পরিকল্পনায়ও লিপ্ত। এমন যুক্তিকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় সাধারণ দেশবাসী মনেপ্রাণে মেনে না নিলেও একেবারে অগ্রাহ্য করতে পারেনি, কারণ এ কথা অতীব সত্য যে, এদেশের জনগণের মধ্যে একটা স্বাভাবিক ভারতভীতি বিদ্যমান।

তবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে তাড়া খাওয়া বাঙালী আত্মরক্ষার স্বার্থে ‘৭১-এর সেই দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে ভারতের বুকেই নির্ধিধায় ঠাঁই নিয়েছিল এবং ঠাঁই সেথায় পেয়েছিল। এই ঠাঁই লাভের পেছনে উভয় পক্ষেরই স্বার্থ জড়িত ছিল। স্বার্থ ছাড়া কখনো সন্ধি হয় না। বাঙালীর স্বার্থ ছিল ভারতের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে দেশ মুক্ত করা, আর ভারতের স্বার্থ ছিল দেশ মুক্ত করার নামে তার চিহ্নিত এবং প্রমাণিত শত্রু পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার মধ্য দিয়ে শত্রুপক্ষকে স্থায়ীভাবে দুর্বল করে রাখা এবং মুক্ত বাংলাদেশের উপর প্রাথমিকভাবে খবরদারী করে পরবর্তীতে সময়ও সুযোগমত ভারতের সাথে একীভূত করে নেয়া। এটাকে কেবল তাদের নিছক স্বার্থ হিসেবে চিহ্নিত করলে ভুল হবে, বরং এটা ছিল তাদের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন।

১৯৪৭ সনের দেশ বিভক্তির সময় বঙ্গভঙ্গের ইচ্ছা ভারতীয় কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দের মধ্যে মোটেও ছিল না। তাঁরা সমগ্র বাংলাকেই পেতে চেয়েছিলেন ভারতের সঙ্গে, কিন্তু মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ চেয়েছিলেন ‘বাংলাকে’ একটি পূর্ণ স্বাধীন দেশ হিসেবে দেখতে যা হবে কমনওয়েলথভুক্ত একটি স্বাধীন রাজ্য। শেরে বাংলা জনাব এ. কে. ফজলুল হক, জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবরাও ছিলেন ঐ ধরনেরই স্বাধীন বাংলা রাজ্যের পক্ষে। কিন্তু বাধ সাধলেন কিছু কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে শ্রী প্যাটেল বাবু এবং দেশ বিভক্তির একান্ত শেষ মুহূর্তে অজানা কারণে অবশেষে পূর্ববাংলা পশ্চিম বাংলা থেকে বিভক্ত হয়ে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে শামিল হয়ে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ রকম একটি নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়েই বাঙালী জাতি ঐতিহাসিকভাবে দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে মুসলিম প্রধান পূর্ব বাংলা এবং হিন্দু প্রধান পশ্চিম বাংলা হিসেবে। বাঙালী মুসলমান এবং বাঙালী হিন্দুর মধ্যে ধর্মের তারতম্য থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই একে অপরের অনেক কাছাকাছি ছিল। যদিও বা উভয়েরই সাংস্কৃতিক ধ্যান-ধারণার উৎসস্থল ছিল ভিন্ন। ১৯৪৭ সনের দেশ বিভক্তির মধ্য দিয়ে যে ঐতিহাসিক ছেদ ঘটানো হলো তার সাময়িক অবসান ঘটলো ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তার বড় প্রমাণ লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে পশ্চিম বাংলায় অনায়াসে নিরাপদ আশ্রয় প্রদান। পশ্চিম বাংলার বাঙালী জনগণের প্রাণঢালা আন্তরিকতা, আতিথেয়তা এবং ভালবাসা স্নেহশীলা মায়ের কোলকেই কেবল স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

পশ্চিম বাংলার আনাচে-কানাচে তাই গড়ে উঠতে পেরেছে শত শত ট্রেনিং শিবির, অসংখ্য শরণার্থী শিবির। রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে, বাগানে বাগানে, বাড়ীর বারান্দায় পর্যন্ত ভীড় জমেছে শরণার্থীদের। মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের সকল ধরনের অত্যাচার নীরবে এবং হাসি মুখে সয়েছে পশ্চিম বাংলার বাঙালী জনগণ। মানবতার এই অপূর্ব নিদর্শন ছিল তুলনাহীন। পশ্চিম বাংলার বাঙালীদের এই মমতাভরা সাহায্য-সহযোগিতার অবর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা এবং লাখো লাখো শরণার্থীরা আদৌ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে টিকে থাকতে পারতো কিনা আমার সন্দেহ।

বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারের প্রথম অফিস ছিল এই পশ্চিম বাংলারই কোলকাতা নগরীর ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে এবং এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের হেডকোয়ার্টার। পশ্চিম বাংলার বর্ডারে বর্ডারে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শিবির। আর্থিক, নৈতিক, সামাজিক, মানসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে প্রতিনিয়ত সাহায্য-সহযোগিতার মধ্য দিয়ে পশ্চিম বাংলার রাজ্য সরকার এবং জনগণ বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধকে বিশেষভাবেই করেছে অনুপ্রাণিত। স্বাধীন বাংলা সরকার ঘোষণা করার সাথে সাথেই তো আর সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সনের জুন মাসের পূর্ব পর্যন্ত ‘স্বাধীন বাংলা’ সরকারের কোন নির্দিষ্ট অফিস পর্যন্ত ছিল না। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে অবস্থিত ভারতীয় বি.এস.এফ-এর অফিস খালি করে জনাব তাজউদ্দীন গঠিত মন্ত্রিসভাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বসার সুযোগ করে দেয়া হয়। এর পূর্বে এই মন্ত্রিসভার মাননীয় সদস্যবৃন্দকে আমি দেখেছি আনুমানিক ৫৬/এ, বালিগঞ্জে অবস্থিত একটি দোতলা বাড়ীর দোতলায় মেসে ভাড়া থাকা বেকার যুবকদের ন্যায় গড়াগড়ি করতে এবং তাস খেলতে। এসব কথা বলতে গেলে আর একটু পেছনে যেতে হয়। বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চলসহ আমার সেক্টরের প্রত্যেকটি জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা, শহর প্রতিরক্ষার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাদিসহ মোটামুটি প্রস্তুতি গ্রহণের পর্ব প্রায় শেষ। কিন্তু অস্ত্রের দিক দিয়ে যে দুর্বলতা ছিল তা পর্বতপ্রমাণ। কিছু কিছু পুরানো ধাঁচের থ্রি নট থ্রি রাইফেল, কিছু স্টেনগান এবং গ্রেনেড ছাড়া আমার কাছে তেমন আর কিছুই ছিল না। কেবল মনোবল এবং মানসিক প্রস্তুতিই যুদ্ধের জন্য যথেষ্ট নয়, সাথে সাথে আধুনিক সমর অস্ত্রও যুদ্ধ জয়ের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। অস্ত্র সংকট আমাকে সব সময়েই ভাবিয়ে তুলত। তাই সমগ্র ৯নং সেক্টরকে কয়েকটি সাব সেক্টরে বিভক্ত করে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা চালু রেখে আমি একুশে এপ্রিল কয়েকটি মোটর লঞ্চ সহকারে সুন্দরবনের পথ ধরে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি। প্রধান লক্ষ্যই ছিল ভারতের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা। বরিশাল সদর থেকে নির্বাচিত জনপ্রিয় সংসদ সদস্য (প্রাদেশিক) জনাব নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ইতিপূর্বেই পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে বরিশাল ফেরত এসে আমাকে জানালেন যে, লেঃ জেনারেল অরোরা ভারতের পূর্ব অঞ্চলীয় সর্বাধিনায়ক এবং তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাঙালী সামরিক অফিসারের কাছে অস্ত্র সাহায্য প্রদান করতে প্রস্তুত আছেন। এই তথ্য লাভের মাত্র ১ দিন পরই আমি কিছু মুক্তিযোদ্ধা সহকারে ভারত অভিমুখে রওয়ানা হয়ে প্রথমে পৌঁছি পশ্চিম বাংলার বারাসাত জেলার হাছনাবাদ বর্ডার টাউনে। ঐ অঞ্চলের বি.এস.এফ-এর কমান্ডার লেঃ কমান্ডার শ্রী মুখার্জীর সঙ্গে হয় প্রথম আলোচনা। কমান্ডার মুখার্জী অত্যন্ত সুহৃদ বাঙালী অফিসার। তিনি সর্বান্তকরণেই আমাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে সরাসরি লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে নিয়ে গেলেন। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে তাঁর হেড কোয়ার্টার। তিনি আমাকে প্রথম সাক্ষাতেই সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতে পারলেন না। সাক্ষী-প্রমাণ দাবী করলেন আমার। তখনই আমাকে সদ্য ঘোষিত স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন এবং সর্বাধিনায়ক কর্ণেল ওসমানী সাহেবের নাম নিতে হয়েছে। উত্তরে জেনারেল অরোরা সাহেব আমাদের নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে যা বাজে মন্তব্য করলেন, তা কেবল ‘ইয়াঙ্কী’দের মধেই সদা উচ্চারিত হয়ে থাকে। সোজা ভাষায় তার উত্তর ছিল ‘ঐ দু’টা ব্লাডি ইঁদুরের কথা আমি জানিনা, ওদের কোন মূল্য নেই আমার কাছে। অন্য কোন সাক্ষী থাকলে বলো।’

মহা মুশকিল দেখছি। এই ভারতের মাটিতে আমার মত একটা নাম না জানা তরুণ মেজরকে কোন দুঃখে কেউ চিনতে যাবে? ব্যাটা বলেটা কি? আমার স্বাধীন বাংলায় প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাবাহিনীর প্রথম সর্বাধিনায়ক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের সম্পর্কেই যে ব্যক্তি এরূপ কদর্য উক্তি করতে ছাড়েননি, তিনি আমার মত চুনোপুঁটিদের যে কি চোখে দেখবেন, তা অনুধাবন করতেই একটা অজানা আতঙ্কে আমার সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল। অমনি আমি জেনারেল অরোরাকে অতি স্পষ্ট ভাষায় একজন বিদ্রোহীর সুরে জানিয়ে দিলাম যে, আমার অস্ত্রের কোন প্রয়োজন নেই, আমি শূন্য হাতেই দেশের অভ্যন্তরে ফিরে গিয়ে যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুবরণ করব তবু তাঁর কাছে আর অস্ত্রের জন্য আসব না। আমার এই বিদ্রোহী ভূমিকায় জেনারেল রীতিমত চমকে উঠেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার সিকিউরিটি এবং ইনটেলিজেন্স-এর লোকদের কাছে হাওয়ালা করেন। চারদিন বন্দী অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, বিশেষ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। আমার দ্রুত মুক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পর্কে কিছুটা তথ্য প্রদান করি। পূর্ব অঞ্চলের ‘চীফ অফ স্টাফ’ জেনারেল জ্যাকব আমার দেয়া তথ্য বিশেষ প্রয়োজনীয় মনে করেন এবং আমাকে যে কোন ধরনের অস্ত্রপাতি যোগান দেয়ার আশ্বাসও প্রদান করেন। এভাবে কোলকাতার সেই ব্রিটিশ রচিত দুর্গ ফোর্ট উইলিয়ামের অন্ধকূপ থেকে আমি মুক্তি পেয়ে জনাব তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে সাক্ষাত করতে যাই।২

দেশের সাধারণ শান্তিপ্রিয় জনগণকে হিংস্র দানবের মুখে ঠেলে দিয়ে কোলকাতার বালিগঞ্জের আবাসিক এলাকার একটি দ্বিতল বাড়ীতে বসে প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভা সহকারে (খোন্দকার মোশতাক বাদে) নিরাপদে তাস খেলছিলেন দেখে আমি সে মুহূর্তে কেবল বিস্মিতই হইনি, মনে মনে বলছিলাম ‘ধরণী দ্বিধা হও’। ধরণী সেদিন দ্বিধা না হলেও আমি কিন্তু সেদিন থেকেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের প্রতি চরমভাবে আস্থাহীন এবং বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি। এর ফলাফল ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য মঙ্গলজনক না হলেও, আমি আমার সকল ক্ষতিকে নীরবে মাথা পেতে নিয়েই আওয়ামী লীগের এই দায়িত্বহীন, উদাসীন এবং সৌখিন মেজাজসম্পন্ন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রাম অব্যাহত রাখার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। দেশ ও জাতির স্বার্থে বাস্তবেও আমি করেছি তাই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসই তার সাক্ষী। যে জাতির নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ জনগণকে যুদ্ধে লেলিহান শিখার মধ্যে নিক্ষেপ করে কোন নিরাপদ আশ্রয়ে বসে বেকার, অলস যুবকদের মত তাস খেলায় মত্ত হতে পারে, সে জাতির দুর্ভাগ্য সহজে মোচন হবার নয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের আচরণে এ ধরনের ভূরি ভূরি নমুনা রয়েছে। যুদ্ধকালীন অবস্থায় তাদের আরাম-আয়েশী জীবনধারা কোলকাতাবাসীদেরকে করেছে হতবাক।

ব্যক্তিজীবন পদ্ধতিতে সীমাহীন ভোগ-লালসার কারণেই আশ্রয়দানকারী ভারত কর্তৃপক্ষ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দুর্বলতাসমূহ অতি সহজেই নির্ণীত করে নিয়েছে এবং তাদের ভোগ-বিলাসে কোনরূপ বাধা প্রদান করা থেকে বিরত থেকেছে। এ ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ঔদার্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে উত্তরোত্তর কলঙ্কময় করে তুলতে সহায়তা করেছে। অপরদিকে কোলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে স্বাধীন বাংলাদেশের অফিস থাকলেও ক্ষমতার সকল উৎসই ছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল ওসমানী সাহেব একজন ‘সম্মানিত বন্দীর’ জীবন যাপন করা ব্যতীত আর তেমন কিছুই করার সুযোগ ছিল না তার। সেক্টর পরিদর্শন করা তো দূরেরই কথা তাঁর তরফ থেকে লিখিত নির্দেশও তেমন কিছু পৌঁছতে পারতো না সেক্টর কমান্ডারদের কাছে।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মুক্তি যোদ্ধাদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করার আগ্রহ প্রদর্শন যা করেছে তার তুলনায় অধিকতর উৎসাহ এবং আগ্রহ প্রদর্শন করেছে তথ্য সংগ্রহ করার ব্যাপারে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র প্রদান নয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে জরুরী তথ্য সংগ্রহই ছিল যেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মূল উদ্দেশ্য। তাদের এ ধরনের আচরণই তাদের গোপন লালসা পূরণের ‘নীল নকশা’ তৈরি করার ইঙ্গিত প্রদান করেছে। আমার এ সন্দেহ সত্য বলে প্রমাণিত হতে খুব বেশী সময়ের প্রয়োজন হয়নি।