সশস্ত্র গণ-বিস্ফোরণ

সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় বাঙালীদের যেমন উতসাহিত করেছিল, তেমনি পাকিস্তানী শাসক-শোষকগোষ্ঠীকে করে তুলেছিল ভীত সন্ত্রস্ত। পশ্চিম পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর ‘পিপলস পার্টি’ এবং পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়লাভের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় অঞ্চলের জনগণই যে স্পষ্ট রায়টি দিয়েছিল তা ছিল আর এক রাষ্ট্র নয়, আমরা দু’টি ভিন্ন রাষ্ট্র, আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-সাধ এবং চাহিদা ভিন্নতর। উভয় দেশের জনগণের রায়ই যেন দুই দেশের জন্য দুটি ভিন্ন পতাকা রচনার সিদ্ধান্ত দিয়ে দিল। আর তাই তো মিঃ ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ অধিবেশনে যোগদান করতে সরাসরিই অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। শুধু কেবল তাই-ই নয়, তাঁর পিপল্‌স পার্টির কোন সদস্য যদি সেই সংসদ অধিবেশনে যোগদানের লক্ষ্যে ঢাকায় আসে, তাহলে সে সকল সংসদ সদস্যদের পা ভেঙে দেয়া হবে বলেও হুমকি প্রদান করলেন। এদিকে তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান বার বার সংসদ অধিবেশনের বৈঠক আহ্বান করেও অধিবেশন বসাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিলেন। বেশ কয়েকবার বৈঠকের তারিখ পরিবর্তন করা সত্ত্বেও সংসদ অধিবেশন হলো না। ঢাকা থেকে লাহোর গমনের এক পর্যায়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকা এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে বিজয়ী নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে করমর্দন করতে করতেই শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও উল্লেখ করে ফেলেছিলেন। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হলো ‘৭০-এর ডিসেম্বরেই, কিন্তু এদিকে ফেব্রুয়ারী মাস অতিবাহিত হয়ে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ চলছে। মার্চের নির্ধারিত সংসদ অধিবেশন বসলো না। ঢাকাসহ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে চরম উত্তেজনা বৃদ্ধি পেল। ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় বাঙালী বিহারী সংঘর্ষের সূত্রপাত দেখা দিল। বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনায় গোটা জাতি হয়ে উঠলো বলিষ্ঠ থেকে বলিষ্ঠতর এবং প্রচণ্ডভাবে উদ্দীপ্ত। শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তার ছাপ দেশের আনাচে-কানাচে, আকাশে-বাতাসে বিদ্যমান হয়ে উঠল। সর্বস্তরের জনগণের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে লাগল একটি প্রিয় নাম ‘মুজিব’। বাউলের একতাঁরা য় শুনেছি তাঁর নাম, মাঝির গাওয়া ভাটিয়ালীতে শুনেছি তাঁর নাম, বস্তাটানা কুলী-মজুরের কণ্ঠে শুনেছি তাঁর নাম, কিষাণের ভাওয়াইয়ায় ফুটে উঠেছে তাঁর নাম। সেকি আলোড়ন সারা দেশব্যাপী, সে কি হিন্দোল। এ যেন ছিল মহাসাগরেরই উত্থানের মত দিকে দিকে ভরপুর সে। ‘এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ শ্লোগানটি যেন তৎকালীন বাস্তবতার সাথে অঙ্গীভূত হয়ে পড়ল। ‘মুজিব’ জাতীয় চেতনার কেন্দ্রবিন্দু এবং একমাত্র প্রতীক-এ পরিণত হলেন। এই ‘প্রতীকটিই’ বাঙালীর সশস্ত্র গণবিস্ফোরণের প্রথম উপাদান হিসেবে পরিণত হয়ে গেল। মুজিবের কণ্ঠই তখন যে কোন সশস্ত্র শক্তির তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী হয়ে পড়ল। তার নির্দেশে জাতি তখন যে কোন শক্তির মোকাবিলা করার মত মানসিকতা অর্জন করল। এখানেই মুজিবের নেতৃত্বে পরিচালিত গণ-আন্দোলনের চরম সার্থকতা। একটি কণ্ঠই যখন সমগ্র জাতিকে সশস্ত্ররূপে সজ্জিত হওয়ার সাহস জোগায় সে জাতিকে পরাভূত করার শক্তি তখন আর কারোর থাকে না। ১৯৭১ সনের ৭ই মার্চ ঢাকা রেস কোর্সে দেশ ও জাতির উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবের সেই জাদুকরী কণ্ঠে যে ভাষণ প্রচারিত হলো, তার মধ্য দিয়েই মূলত পূর্ব পাকিস্তানের সমাধি রচনা এবং আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনা লগ্ন ঘোষিত হয়ে যায়। ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়- ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলঃ’

উপরিউক্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়েই বস্তুতপক্ষে বাঙালীদের জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়ে গেছে। আমি যদি বলি উপরিউক্ত বক্তব্য প্রদানের মধ্য দিয়েই শেখ মুজিব একজন জাতীয়তাবাদী নেতার আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের চূড়ান্তরূপ ঘোষণা করে দিয়ে তাঁর শেষ দায়িত্ব সার্থকভাবেই সমাপ্ত করেছেন, তাহলে মোটেও ভুল হবে না। বস্তুত তাই একজন প্রকৃত জাতীয়তাবাদী নেতার চরম পাওয়াই হচ্ছে তাঁর জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনের মানসিকতা দিয়ে সজ্জিত করা। সেদিক থেকে মুজিব অনেকাংশেই সফল।

তবে এখানেই আর একটি প্রশ্ন জাগে। জাতির জন্য স্বাধীনতা অর্জনই যদি শেখ মুজিবের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তাহলে ৭ই মার্চের অমন জ্বালাময়ী বক্তব্য প্রদানের পরে তিনি কি করে শত্রুপক্ষের সাথে বৈঠকে বসার আশা পোষণ করেছিলেন? পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল সামরিক সরকার প্রধান ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে স্বাধীনতা ঘোষণার পরে পুনরায় শেখ মুজিব কেন বৈঠকে বসতে চেয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণাকারী শেখ মুজিবের কি ধরনের প্রত্যাশা ছিল জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে? যার যা আছে তাই নিয়ে জাতিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ প্রদান করার পরে কোন ভরসায় জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আপোসরফার আলোচনার টেবিলে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন? তাহলে কি শেখ মুজিব স্বাধীনতা চাননি? তিনি কি চেয়েছিলেন পাকিস্তানী প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদে পৌঁছতে? জাতিকে চূড়ান্ত ত্যাগের জন্য নির্দেশ দিয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোন ত্যাগের প্রস্তুতি না নিয়ে ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত কেনই বা শত্রুপক্ষের সঙ্গে বৈঠকের চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। এখানেই খুঁজতে হবে মুজিবের নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণ। তাঁর নেতৃত্বের সংকট স্পষ্টভাবেই প্রতিভাত হয়ে উঠেছে এখানে। একটি জাতীয়তাবাদী আন্দালনের চূড়ান্ত পর্যায়ই হচ্ছে স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং তেমন একটি ঐতিহাসিক পর্বে নেতৃত্ব দানের লোভ এবং মোহ থাকলেই নেতা হওয়া যায় না। শ্রেণীগত দুর্বল চরিত্রের কারণে শেখ মুজিবের মধ্যকার দোদুল্যমানতা এবং সংশয়ই তাঁকে স্ববিরোধী ভূমিকায় লিপ্ত করেছে।

তাই ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘মুক্তির সংগ্রাম’ এ ধরনের মন্তব্য করতে যেমন তার বাধেনি, তেমনি বাধেনি মুক্তির সংগ্রাম ঘোষণা করার পরেও শত্রুপক্ষের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসার জন্য অপেক্ষা করতে। দেশের তখনকার বাস্তব অবস্থা স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণার পক্ষেই ছিল। তাই তখনকার ছাত্র নেতৃত্বের চাপেই শেখ মুজিব ৭ই মার্চ ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ এ ধরনের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি প্রকাশ্যে বলেও ফেলেছিলেন, “আমি যদি আপনার কথা মত কাজ করি, তাহলে ছাত্র নেতাঁরা আমাকে গুলী করবে, আর যদি আমি ছাত্র নেতাদের কথামত চলি তাহলে আপনি আমাকে গুলী করবেন, বলুন তো এখন আমি কি করি।” শেখ মুজিব তাঁর নেতৃত্বের অসহায় এবং করুণ অবস্থাই ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর উপরিউক্ত মন্তব্যের মধ্য দিয়ে। তবে সংগ্রামী ছাত্র নেতৃত্ব এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান এই দু’য়ের মাঝখানে আর যে ঘটনাটি বিদ্যমান ছিল তা হলো বাঙালী জনগণের স্বাধীনতার পক্ষে সচেতনতা। শেখ মুজিব একদিকে ছাত্র নেতৃত্বের কাছে নতি স্বীকার করে স্বাধীনতার পক্ষে যেমন কাজ করেছেন, ঠিক তেমনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন পাকিস্তানকে রক্ষা করতে। শেখ মুজিবের এই স্ববিরোধী ভূমিকার জন্য ইতিহাস একদিন তাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করালে তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।

তবে শেখ মুজিবের এই স্ববিরোধী ভূমিকার জন্য জনগণের যুদ্ধ থেমে থাকেনি। ১৯৭১ সনের সেই ভয়াল ২৫শে মার্চের রাতে পাকিস্তানী বাহিনীর হিংস্র বর্বরদের মতন নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সাথে সাথেই সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিরোধের বারুদ জ্বলে উঠেছিল। সে অবস্থায় নিরস্ত্র বাঙালীদের সশস্ত্ররূপ ধারণ করতে সময় লাগেনি। মৌমাছির চাকে ঢিল ছুঁড়তেই যেমন আক্রমণকারী নিজেই অকস্মাৎ আক্রান্ত হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি সেদিন ঘটেছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ভাগ্যে। গণ-ন্দোলন অবশেষে রূপান্তরিত হলো সশস্ত্র গণ-বিস্কোরণে। তবে শেখ মুজিবের অনুপস্থিতি বাঙালীদের জন্য ছিল দুর্ভাগ্য এবং ব্যক্তি মুজিবের জন্য ছিল রাজনৈতিক বিপর্যয়। নেতৃত্বহীন অবস্থায় একটি জাতির সশস্ত্র গণ-বিস্ফোরণ যেমন হতে পারে আত্মবিধ্বংসী, তেমনই তা হতে পারে নিদারুণ বিপজ্জনক। কিন্তু ১৯৭১ সনের সশস্ত্র গণবিস্ফোরণ শেষ পর্যন্ত যে একটি সফল মুক্তিযুদ্ধের রূপ নিতে সক্ষম হয়েছে, তার কৃতিত্ব কোন একক নেতৃত্বের নয়, সমগ্র সংগ্রামী জনগোষ্ঠীই সে কৃতিত্বের দাবীদার। জনগণের সশস্ত্র বিস্ফোরণই প্রয়োজনের তাকিদে বিকল্প নেতৃত্ব জন্ম দিয়েছে। সশস্ত্র গণ-বিস্ফোরণ যুগে যুগে এভাবেই নতুন নেতৃত্বের জন্ম দিয়ে থাকে।