স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি ও ইসলাম

আওয়ামী লীগের ৬ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীর অন্তরালেই স্বাধীনতা আন্দালনের বীজ লুকায়িত থাকলেও ৬ দফার প্রণেতাঁরা এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এক জিনিস নয়। ৬ দফার অভ্যন্তরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সুর ছিল নেহায়েতই প্রচ্ছন্ন এবং আন্দোলনের ধাপে ধাপে সে লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার পরিকল্পনা হয়ত বা ছিল। তবে আওয়ামী লীগের ৬ দফাকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কখনো স্বাধীনতার আন্দোলন হিসেবে সচেতনভাবে মনে করেনি, কিন্তু দেশের সংগ্রামমুখর জনগণ ৬ দফার আন্দোলনকে ১ দফার আন্দোলন হিসেবেই যে গণ্য করত এ কথা সত্য। জনগণের কাছে স্বায়ত্তশাসনের দাবীটি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করার দাবী হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। পাকিস্তানী শাসক শোষকের কাছেও ৬ দফা মূলত এক দফারই শামিল ছিল এবং সে কারণেই তাঁরা ৬ দফাকে ‘৭০-এর নির্বাচনের পরেও মেনে নিতে চায়নি। এটা কিন্তু শাসক গোষ্ঠীর নিছক অনীহাই ছিল না, এটাই ছিল তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত- যার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটে ‘৭০-এর সেই ভয়াল ২৫শে মার্চ রাতে। মরহুম জননেতা জনাব আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র আগেভাগেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই ১লা মার্চ তারিখেই তার পল্টন ময়দানের জনসভায় জনগণের কাছে ১ দফা ঘোষণা করেছিলেন। সেই জনসভায় ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ এই শ্লোগানটিই প্রাধান্য লাভ করেছিল। তাই পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশ হিসেবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বপ্ন সচেতন বাঙালীদের মধ্যে অবশ্যই বিরাজ করছিল। তবে সেই স্বাধীন বাংলাদেশের রূপরেখা কি হবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধ্যান-ধারণা তাদের মধ্যে ছিল না। জনাব সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সচেতন ক্ষুদ্র একটি অংশ বিশেষ বামপন্থী সংগঠনসমূহের চিন্তা চেতনায় পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে স্থির ছিল সে কথা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। স্বাধীনতা অর্জনের পরে উক্ত চেতনাকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে জাতির উপর আরোপিত করা হয়েছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক, সামাজিক শক্তিসমূহ এবং সংগ্রামী জনগণ উক্ত চেতনা সম্পর্কে মোটেও ওয়াকিফহাল ছিল না। তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করার জন্য সক্রিয় উদ্যোগ কিংবা প্রতিক্রিয়া মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ছিল না বলে মুষ্টিমেয় লোকের চেতনাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে পরিচিত এবং গ্রহণ করানোর সকল প্রয়াসই আজ নিস্ফল রূপ ধারণ করছে। সঠিক এবং আদর্শিক চেতনাহীন ‘৭১-এর যুদ্ধটিই প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের রূপ না নিলেও এটি যে নিঃসন্দেহে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের রূপ ধারণ করেছিল এ বিষয়টি দিবালোকের মতই উজ্জ্বল। সত্য জনগণের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার আবেগ-অনুভূতি, সত্য তাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের সক্রিয়তা, স্বতঃস্ফূর্ততা এবং আন্তরিকতা। এ সত্যগুলো কোন অশুভ শক্তির ষড়যন্ত্রের ফলে মোটেই মিথ্যা কিংবা ভুলে রূপান্তরিত হতে পারে না। বিদেশী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান রাখা এবং সতর্কতা অবলম্বন করার অর্থ এই নয় যে, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও অনুভূতির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা কিংবা তা অস্বীকার করা। এই হিসেবে যারাই গরমিল করেছে তাঁরা ই প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে তাদের এই ভুলের অর্থ বোধ হয় এ দাঁড়ায় না যে, তাঁরা বাঙালী জনগণের সার্বিক স্বার্থের বিরুদ্ধে ছিল। তাঁরা বাংলাদেশর জনগণের জন্য স্বাধীনতা চেয়েছে কোন বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপ ব্যতীতই। বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশ ভারতের হস্তক্ষেপ করাকে তাঁরা স্বাধীনতা নয়, গোলামীরই নতুন এক রূপ হিসেবে বিবেচনা করত। স্বাধীনতা যুদ্ধ বিরোধী বলে যারা পরিচিত তাঁরা সকলেই কম-বেশী ভারত বিরোধী হিসেবেই অধিক পরিচিত। এদের ভারত বিদ্বেষী মনোভাব কোন নতুন উপাদান নয়। ভারত বিভক্তির অনেক পূর্ব থেকেই ‘অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস’ ‘মুসলিম লীগ’-এর মধ্যকার তীব্র দ্বন্দ্বের কারণেই ঐ বিদ্বেষ-এর বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে। ইতিহাসের দীর্ঘ জটিল পথ বেয়ে বেয়ে বিদ্বেষের অঙ্কুর মহীরুহে পরিণত হয়েছে এবং আজ কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে সংঘর্ষের আনুষ্ঠানিক কোন মহড়া না চললেও উপরিউক্ত দল দুটির সংঘর্ষের ফলে জন্ম নেয়া ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে তা তীব্রভাবেই বিরাজমান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সেই বিদ্বেষেরই একটি নতুন বিস্ফোরণ একটি নব সংস্করণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শুরু থেকেই ভারতীয় হস্তক্ষেপ বিদ্যমান ছিল এই সন্দেহে ভারত বিদ্বেষী রাজনৈতিক দলগুলো তাই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ না হয়েও যুদ্ধ করেছে এ লক্ষ্যে ‘যে কোন মূল্যে দেশ স্বাধীন করতে হবে।’ যে কোন মূল্যে অর্জিত স্বাধীনতা যে নিজেদের ভোগের বাইরে চলে যেতে পারে এ ধারণা মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল না। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সাহায্য সহযোগিতা স্বাধীনতার রূপ ও স্বাদ পাল্টে দেয়, স্বাধীনতা বিনষ্ট করে দেয় এ সচেতনতা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও ভারতীয় চক্রের মধ্যকার ষড়যন্ত্র সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের জানার কথা ছিল না। তাঁরা হানাদার বাহিনীকে অত্যাচার করতে দেখেছে, অত্যাচারিত হয়েছে বলেই আত্মরক্ষার্থে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়ে পড়েছে। তাদেরকে আওয়ামী লীগ নেতাঁরা বুঝিয়েছেন ‘আগে দেশ, পরে ধর্ম’, দেশ রক্ষা করতে না পারলে ধর্মও রক্ষা করা যাবে না। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ধর্ম রক্ষা করার চেয়ে দেশ রক্ষা করার বিষয়টি প্রাধান্য লাভ করে।

অপরদিকে, সাধারণ জনগণও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের আসল উদ্দেশ্য জানতে সক্ষম হয়নি। তাদেরকে বুঝানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নাম করে ভারতই প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশকে দখল করে নিতে চায়। মুক্তিযুদ্ধ ভারতেরই একটি গভীর ষড়যন্ত্র মাত্র। ভারত দেশ দখল করে নিলে বাংলাদেশের মাটি থেকে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ধর্মই যদি না থাকে তাহলে দেশ দিয়ে কি হবে। কাফির হয়ে কাফিরদের অধীনে বেঁচে থাকার চেয়ে ঈমানের সাথে লড়াই করে মুসলমান হিসেবে শাহাদাত বরণ করা অধিক শ্রেয়। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে রাজাকার, আলবদর এবং আশ-শামস হিসেবে অংশগ্রহণকারী সাধারণ যোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করার তুলনায় ধর্ম রক্ষা করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছে। তাঁরা এ কথা হয়ত বুঝত না যে, নির্যাতনকারীদের পক্ষে যুদ্ধ করে ইসলাম ধর্ম রক্ষা করা যায় না। পুঁজিবাদী পাকিস্তানকে টিকিয়ে রেখে প্রগতি, শান্তি ও সাম্যের ধর্ম ইসলামকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। পুঁজিবাদের অধীনে পাকিস্তান টিকে গেলেও পুঁজিবাদের বিষবাষ্পে ইসলাম বিকৃত ও পঙ্গু রূপ ধারণ করবে।

মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বিপক্ষের সাধারণ যোদ্ধারা উভয় পক্ষের কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর কূট প্রোপাগান্ডার শিকারে পরিণত হয়েছে এবং এরই মাঝে অসহায়ভাবে বলির শিকার হয়েছে শান্তিপ্রিয় ধর্মভীরু নিরপেক্ষ জনগোষ্ঠী। উভয় পক্ষেরই সাধারণ যোদ্ধারা সহজ, সরল এবং নির্দোষ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বিপক্ষের সাধারণ যোদ্ধাদেরকে উপরিউক্ত আলোকেই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক মূল্যায়ন করা এবং তার ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যকার বিভ্রান্তি দূরীভূত করার আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশ ও জাতির ঐক্য এবং ভারসাম্যপূর্ণ ভবিষ্যত রচনা করার স্বার্থেই এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন।

তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন অবস্থায় উভয় পক্ষের যোদ্ধারা যা কিছুই করেছে তা করেছে স্ব স্ব প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণেই কেবল। বাঙালী হয়ে যারা বাঙালীর ঘরে আগুন দিয়েছে, বাঙালী মা বোনদের উপর পাশবিক নির্যাতনে শরীক হয়েছে, অহেতুক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তারা যে পক্ষেরই হোক না কেন মানবিক দিক থেকে তারা অপরাধী। অপরাধীদের কোন পক্ষ নেই। অপরাধীদের অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, তাদের একমাত্র পরিচয়ই হচ্ছে তারা অপরাধী। অপরাধের বিচার কাম্য- এটা নৈতিক, সামাজিক, মানবিক এবং প্রচলিত আইন-প্রশাসনেরই দাবী। কোন অপরাধের বিনা বিচারে ক্ষমা প্রদর্শন একটি ক্ষমাহীন অপরাধই বটে।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রকৃত অপরাধীদের সুযোগ্য বিচারের দাবীতে বাংলাদেশের জনগণ আকুলভাবেই সোচ্চার ছিল, কিন্তু আন্তর্জাতিক মুরুব্বীদের চাপে দুর্বল শাসকগোষ্ঠী অসহায়ভাবেই নতি স্বীকার করেছে। তাদের এই নতি স্বীকার করার ফলে প্রকৃত অপরাধীরা হয়ত জীবনে বেঁচে গেছে, কিন্তু দেশ ও জাতি রক্তক্ষরণের হাত থেকে মোটেই নিস্তার পায়নি। তাই স্বাধীনতার ১৭ বছর পরেও স্বাধীনতা আজো তেতো, মুক্তিযুদ্ধ আজ বিকৃত এবং বিস্মৃতপ্রায়।

হানাদার পাকবাহিনী যারা দীর্ঘ ৯টি মাস ধরে বাংলাদেশের বুকে অবলীলাক্রমে গণহত্যা চালিয়ে ইতিহাসের পাতায় এক জঘন্য অধ্যায় সৃষ্টি করল, তাদেরকে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী কিসের স্বার্থে উদ্ধার করে নিয়ে গেল ভারতে? সেই সকল হত্যাকারী গণদস্যুদেরকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হস্তান্তর করা হলো না কেন? যারা মুক্তিযুদ্ধের মৈত্রী বাহিনী হিসেবে বাংলাদেশের দরদী সেজে বাঙালীদেরকে উদ্ধার করতে এলো তারাই বাঙালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া পাকিস্তানী হত্যাকারী বাহিনীকে নিরাপদ আশ্রয়ে উদ্ধার করে নিয়ে বাঙালী প্রেমের পরিচয় দিয়েছে না পাঞ্জাবী প্রেমের পরিচয় দিয়েছে? মুক্তিযুদ্ধে মৈত্রী বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যাকারীদের প্রতি অতটা দরদী হয়ে ওঠার পেছনে কারণটা কি ছিল? রসুনের গোড়া নাকি এক জায়গায়। এ সকল মার্সিনারী আর্মির গোড়াও একই জায়গায়- আমেরিকার পেন্টাগনে। সুতরাং ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’, ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ ও সকল কিছু না, লৌকিকতা মাত্র। সংগ্রামমুখর জনগণকে বিভ্রান্ত এবং হতাহত করে আন্তর্জাতিক মুরুব্বীদের প্রভাববলয় ঠিক রাখাই হচ্ছে এ সকল যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার আসল উদ্দেশ্য। তা না হলে মানবতার খাতিরেও আন্তর্জাতিক মহল থেকেই বাংলাদেশে গণহত্যাকারী পাকিস্তানী নরপশুদের বিচারের দাবী শোনা যেত। না তেমন কিছুই হয়নি, হবেও না যতদিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহল অভিশপ্ত সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত না হবে।

নির্যাতিত বাঙালীরাই কেবল বিচারের দাবীতে চিৎকার করেছে। সে চিৎকার কেউ শোনেনি। বাংলাদেশে সংঘটিত ইতিহাসের একটি নারকীয় গণহত্যা বিনা বিচারেই ধামাচাপা পড়ে রইল। অপরাধের প্রধান নায়করাই যেখানে বিনা বিচারে মুক্ত হলো, সে ক্ষেত্রে প্রধান নায়কদের স্থানীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার বাংলাদেশ সরকারের থাকে কি? সাম্রাজ্যবাদ নির্ভরশীল কোন সরকারই মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের কোন বিচারই করতে সক্ষম হবে না। তবে মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ আনার চেষ্টা না করে যাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাদের অবশ্যই বিচার হওয়া প্রয়োজন। যতদিন পর্যন্ত অপরাধীদের বিচার না হবে, ততদিন পর্যন্ত জাতি দুর্ভাগ্যজনক দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকবে এবং এ কারণে বাংলাদেশের মাটিতে (স্বাধীনতা বিরোধীদের কারণেই) পবিত্র ইসলাম ধর্ম বিরোধী প্রোপাগান্ডার অবসানও হয়ত ঘটবে না। স্বাধীনতা বিরোধী প্রায় সকল দল ও গোষ্ঠী যেহেতু ইসলামভিত্তিক, সেহেতু ইসলামই সমালোচনার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ইসলামে কোন অপরাধীরই আশ্রয় থাকার কথা নয়। ইসলাম অন্যায়, অপরাধ বিরোধী এক সক্রিয় জীবন ব্যবস্থা।

ইসলাম অপরাধমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। ইসলাম শোষণহীন, শ্রেণীহীন, সাম্যবাদী সমাজ কায়েম করে। ইসলাম পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, রাজতন্ত্রসহ সকল ধরনের স্বৈরশাসনের ঘোর বিরোধী। ইসলাম মুক্তি এবং শান্তির এক বিপ্লবী ঘোষণা। স্বাভাবিক কারণেই ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ চেতনার পক্ষের শক্তি। মানুষের সার্বিক মুক্তির সংগ্রামে ইসলাম প্রতিবন্ধক তো নয়ই, বরং যুগান্তকারী এক সহায়ক শক্তি- মূলশক্তি বললেও অত্যুক্তি হবে না। সর্বশক্তিমান আল্লাহকে একমাত্র প্রভু ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইসলাম মানুষকে মূলত স্বাধীন করে দিয়েছে। এই স্বাধীন মানুষের উপর একমাত্র আল্লাহর প্রভুত্ব ব্যতীত যে কোন ধরনের প্রভুত্ব চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ইসলাম আপোসহীন জিহাদ ঘোষণা করে। এমন একটি জীবন দর্শন যা চূড়ান্ত অর্থেই পরিপূর্ণ, সেই ইসলাম সম্পর্কে যারা অসহিষ্ণু মনোভাব প্রদর্শন করে, তা তাঁরা অজ্ঞতাবশতই করে বলে আমার বিশ্বাস।

আর যদি কেউ সজ্ঞানেই ইসলাম বিরোধী প্রচারে লিপ্ত হয়, তা তারা করে কায়েমী স্বার্থেরই কারণে কেবল কোন পরামর্শ কিংবা সমালোচনাই তাদেরকে অপপ্রচারের কুৎসিত পথ থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয় না। তবে অপপ্রচারকারীদের অধিকাংশই যে হচ্ছেন ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে এই ইসলাম এলার্জী শিক্ষিত সমাজের মধ্যে একটা মানসিক ব্যাধির ন্যায়ই বিরাজ করছে। ইসলামের কথা শোনামাত্রই তারা বিরক্তি ও ঘৃণাভরে কতকটা তোতাপাখীর মতনই কতিপয় শব্দ উচ্চারণ করে বসে- যেমন, প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি। বিনা জ্ঞানে কোন কিছু সম্পর্কে মন্তব্য করার স্বভাবটাই যে প্রতিক্রিয়াশীলতার লক্ষণ সে কথা তারা বেমালুম ভুলে যায়। কোন দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করতে হলেও যে সেই দর্শন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। এখানে একটি কথা বলে রাখা আবশ্যক যে, ইসলামে সাম্রাজ্যবাদের রূপ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক এবং ইসলামে বিপ্লবের রূপ হচ্ছে সাম্যবাদ। বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রেই আজ ইসলামে সাম্রাজ্যবাদ বিরাজ করছে। একমাত্র ইরানই হচ্ছে এর ব্যতিক্রম। বিপ্লবী গণজাগরণের মধ্য দিয়ে যেমন সাম্রাজ্যবাদকে হটিয়ে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করা হয়, ঠিক তেমনি আদর্শিক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ইসলামকেও সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত করতে হবে। আমাদের মত মুসলিম প্রধান দেশে ইসলামহীন স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে গণমানুষের স্বাধীনতা নয়, ঠিক তেমনি স্বাধীনতাহীন ইসলামও গণমানুষের ইসলাম নয়, তা থেকে যায় ‘দরবারী ইসলাম’ অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ নির্ভরশীল প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত ইসলাম।

যে কোন মূল্যে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে যারা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ভূত মাথায় বহন করে এনেছে তারা যেমন ভুল করেছে, ঠিক তেমনি ভুল করেছে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিসমূহ, যারা ইসলামকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করতে গিয়ে স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করে বসেছে। তাই মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার প্রকৃত রূপ হতে হবে সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, রাজতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রমুক্ত ইসলাম। ইসলামহীন স্বাধীনতা অথবা সাম্রাজ্যবাদ ও রাজতন্ত্র নির্ভরশীল ইসলাম সহকারে স্বাধীনতা এর কোনটিই বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুক্তির পথে সহায়ক হবে না। ইসলাম ভিন্ন বাংলাদেশে বসবাসরত অন্যান্য ধর্মাবলম্বী শতকরা ১০ ভাগ মানুষও ধর্মভীরু এবং তারাও ধর্ম সহকারেই স্বাধীনতা এবং মুক্তি কামনা করে। প্রকৃত ইসলামের সাম্যবাদী নীতি এবং ইসলামের ঐতিহ্যবাহী নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কোন বিরোধ তো নেই-ই বরং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিধান রয়েছে ইসলাম ধর্মে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতাকে প্রশ্রয় দান ইসলাম তো করেই না, অন্যান্য ধর্ম মতেও তদ্রূপ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ ছিল, ধর্মযুদ্ধ ছিলনা। সুতরাং যুদ্ধোত্তরকালে ধর্মের প্রতি উষ্মা কিংবা কটাক্ষ করার কোন যুক্তিই নেই, থাকতেও পারে না। তবুও রয়েছে কেন?