নির্বাচন ও অতঃপর

এক কঠিন ও অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশ। সরকারি দলের শাসন প্রলম্বিত কিংবা বিরোধী দলের ক্ষমতায়নের জন্য প্রাণ দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। ক্ষতির শিকার হচ্ছে দেশের অর্থনীতি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা ও শিক্ষা কার্যক্রম। বিরোধী দলগুলোর কাছে এমনকি সর্বদলীয় সরকারও গ্রহণযোগ্য নয়, চাই নির্দলীয় সরকার। কারণ, দলীয় লোকজনকে বিশ্বাস নেই, যদিও তাঁরাই দেশ পরিচালনা করবেন। অন্যদিকে সরকারের কাছে সংবিধান রক্ষা করাই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়। যদিও সন্ত্রাসী তৎপরতায় নিয়মিতভাবে জীবন দিচ্ছে সাধারণ নাগরিক, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। যুগ যুগ ধরে আমাদের নেতৃত্বে দূরদর্শিতার অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। যারা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না, তারা এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করছে। আর যারা কেবল পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয় ভাবত, তারা এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না, যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে উভয় দল কম নাজেহাল হয়নি। এই অপরিণামদর্শিতার জন্য উভয় দলেরই জাতির কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।

প্রাণী হিসেবে বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, জাতীয় স্বার্থে সরকারি ও বিরোধী দলের এই মুখোমুখি সাংঘর্ষিক অবস্থানের পরিবর্তন হোক। দেশ রক্ষায় দুটি দল যদি একমতও হয়, ঘটনাগুলো এত দ্রুততার সঙ্গে ঘটবে যে স্বল্পকালীন যেকোনো সমাধান নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে এবং কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের বোধোদয় ঘটবে যে তা স্থায়ী সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। অথচ দেশ শাসনের নিয়মকানুন ঠিক করা দরকার, এমন সময়ে যখন কোনো দলই সরকারে নেই। কারণ, তখন তাদের লক্ষ্য প্রায় অভিন্ন হবে। এতৎসংক্রান্ত কিছু প্রস্তাব নিম্নে উত্থাপন করছি।

১. পরমতসহিষ্ণুতা ও মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। দলগুলোর মধ্যে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় নির্বাচনের মতো কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হলে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন। সেই সমঝোতা প্রয়োজন তত্ত্বাবধায়ক/নিরপেক্ষ/ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠায় কিংবা স্বাধীন কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠনে।

২. ৯৬-এর নির্বাচনে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার সিদ্ধান্তটি যে কতটা অপরিপক্ব ও অদূরদর্শী ছিল, তা বোঝার জন্য সাধারণ জ্ঞানই যথেষ্ট। সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি কে হবেন তা সরকার যেখানে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এ রকম ব্যবস্থা বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

৩. নিয়মিতভাবে বিরোধী দলের সংসদ বর্জন এবং সাংসদ হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণের বিষয়টি সংসদ ও সাংসদদের ভাবমূর্তি ম্লান করছে। সংসদ বর্জন এবং সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের বিষয়টি আমাদের জাতীয় এবং সমাজ-জীবনে দারুণ ঋণাত্মক প্রভাব যে ফেলবে, তা বলাই বাহুল্য। এই বিষয়টি উভয় দলের ইশতেহারে বর্ণিত হওয়া উচিত।

৪. আমাদের সংবিধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অপার ক্ষমতা দিয়েছে। তা-ই যদি হয়ে থাকে, তাহলে এ বিষয়েও সমঝোতা প্রয়োজন, তাও নির্বাচনের আগে, যাতে উভয় দলই একই সমতল থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

৫. ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাঁদের অবস্থান, তাঁদের বিত্তবৈভব অগ্রহণযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাংসদদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে আমাদের সংবিধানে যদি বিধান থেকে থাকে, সে বিষয়েও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সংবিধান সমুন্নত রাখা অবশ্যই আমাদের সাংসদদের পবিত্র দায়িত্ব, যেমনটি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। নেতারা যদি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন অনুশীলন করেন, তা সাধারণ মানুষকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ করবে। এ বিষয়ে নির্বাচনের আগেই উভয় দলের মধ্যে গ্রহণযোগ্য সমঝোতা প্রয়োজন।

৬. দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচারব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার, নির্বাচন কমিশনের গঠন কিংবা কার্যপরিধি, ক্ষমতার বিষয়েও নির্বাচনের আগেই উভয় দলের মধ্যে সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন। উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য মানুষ খুঁজে পেতে যথেষ্ট স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে টেলিভিশনের পর্দায় জনসমক্ষে তা করা সম্ভব, যাতে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততাও থাকবে।

৭. সম্প্রতি ভারতে ‘না’ ভোট দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং তা সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। আমাদের দেশেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নিতে পারলে তা আমাদের সাংসদদের জনকল্যাণমুখী কাজ করতে উৎসাহিত করবে।

৮. বিগত নির্বাচনগুলোর ফল বলে, একটি দলের সর্বমোট প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে সংসদে আসনসংখ্যার কো-রিলেশন সামান্যই। যেমন, গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি প্রাপ্ত ভোটের শতকরা ব্যবধান পাঁচ-সাত হলেও লীগ আসন পায় কয়েক গুণ কমবেশি। তাই প্রার্থীদের আঞ্চলিক জনপ্রিয়তা এবং দলগুলোর সাধারণ জনপ্রিয়তার বিষয়টিও বিবেচনা করে সম্ভবত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়টি ভাবা দরকার, যাতে সংসদে দলগুলোর যথাযোগ্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়।

৯. ভোগ করে নয় বরং ত্যাগ করেই আমাদের নেতারা সারা দেশের মানুষকে দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে কী কী সুযোগ-সুবিধা পাওয়া উচিত, তার থেকে সাধারণ জনগণের জন্য কী কী সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত, তা নিয়ে ভাবলে ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হবে।

১০. আমাদের রাজনৈতিক কর্মীরা কাজ না করে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে যখন-তখন অংশগ্রহণ, নেতাদের সংবর্ধনা জানাতে বিমানবন্দরে গমন এবং রাস্তাঘাটে যানজট তৈরিতে অবদান রাখছেন। একই সঙ্গে দেশের সম্পত্তি রেল, যানবাহন ভাঙচুরসহ সব রকম ঋণাত্মক কাজেই রাজনৈতিক দলের অনুসারীদের পাচ্ছি। খুব ভালো হতো জনকল্যাণমুখী কাজে যদি তারা নেতৃত্ব দিত। যেমন, বয়স্কদের শিক্ষার জন্য, রাস্তাঘাট মেরামতসহ অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ডে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করা। তাহলে নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মী ও সংগঠনের সদস্যদের প্রতি মনোভাব অনেক ইতিবাচক হতো।

আশা করি, দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে উল্লিখিত বিষয়সমূহ আমলে নিয়ে কার্যকর স্থায়ী সমাধানে আমরা দূরদর্শিতার পরিচয় দেব।

প্রকাশকালঃ ডিসেম্বর ৩০, ২০১৩।