আমরা সাতটী

(অনুবাদ)

দেখেছি আমি কুটীরবাসিনী
ক্ষুদ্র এক বালিকারে,
আট বৎসর, বয়স তাহার,
কয়েছিল সে আমারে।

কুঞ্চিত, ছোট, চুলগুলি তার
পড়েছে মুখেরোপরে
সরলতামাখা সে মু’খানি প্ৰতি
চাহিনু স্নেহের ভরে।

সুধাইনু আমি সাদরে তাহারে
“বালিকা কয়টী তোরা-
ভাই ভগিনীতে?” বিস্মিতা কুমারী
কহিল, “ক জন মোরা?”-

আশ্চর্য্য হইয়া, বিস্ফারিত চোখে
চাহিল আমার পানে,-
এই কথা যেন নাহি জানি আমি-
অসম্ভব তার জ্ঞানে।

কহিনু আবার-“হাঁ বালিকা তাই
জিজ্ঞাসি তোমায় আমি-
ভাই বোন্ আর আছে কি তোমার?
অথবা একাই তুমি?”

মধুর হাসিয়া কহিল বালিকা
“না! আমরা সাত জন।”
সুধাইনু পুন “কোথায় এখন
তোমায় সে ভাই বোন্?”

“আমাদের মাঝে, দুইটা এখন
কনোয়েতে বাস করে;”
কহিল বালিকা- “আর দুটী এবে
নাবিকের কাজ করে।

বাকী আর দুটী ভাই ও ভগিনী,
ওই যে গির্জ্জার কাছে-
আছে গোর স্থান, ওই খানে তারা
দু জনে শুইয়া আছে।

নিকটে তাদের, এই কুটীরেতে
মা ও আমি বাস করি।”
বিস্মিত হইয়া চাহিলাম আমি
তাহার মুখের পরি।

ভাবিলাম মনে, বলে কি বালিকা!
তারা ত মরিয়া গ্যাছে;
কহিমু কৌতুকে, “কহিতেছ তুমি-
কনোয়ে ভু জন আছে।

আর দুই জন, সুদূরে বিদেশে
নাবিকের কাজ করে;
তবে ও বালিকা, হইবে তোমরা
সাতটী কেমন করে!”

হাসিয়া বালিকা, করিল উত্তর-
“বুঝিতে নারিলে তুমি?
সাত ভাই বোন্ আমরা সকলে;-
-গির্জ্জা প্রাঙ্গণ ভূমি-

আর দুইটীর বাসস্থান এবে;-
ওই যে বৃহৎ গাছে
ফুটিয়াছে ফুল! ওরি তলে তারা
আরামে শুইয়া আছে।”

“তুমি ত বালিকা যাহা ইচ্ছা হয়
তাহাই করিয়া থাক;
তোমার মতন হাসিতে, খেলিতে,
তারা ত পারিবে না ক?

চেতন তোমার অঙ্গ সমুদায়
অচেতন তারা এৰে;
যবে আছে গোর স্থানে, তবে
তোমরা পাঁচটী হবে।”

শুনিয়া এ কথা, কহিল বালিকা
“তরুলতা তৃণে ঢাকা-
ওই গোর স্থান, এ কুটীর হতে
নিকটে যেতেছে দেখা।-

বার হাত হবে, এখান হইতে,
আমাদেরি খুব কাছে;
ওই গাছতলে, ভাই বোন্ দুটী
পাশাপাশি রহিয়াছে।

আমি প্রায় রোজ, সকালে বিকালে
ওদের নিকটে যাই-
মোজা বুনি, করি রুমাল সেলাই,
কখনো বা গান গাই’;-

শুনাই ওদের;- কভু ফুল তুলে
তোড়া বাঁধি, মালা গাঁথি,
আবার তপন অস্তাচলে গেলে,
থাকিলে বিমল রাতি,-

লয়ে আমি নিজ পেয়ালাটী ছোট
বসিয়া ভূমিরোপরি-
উহাদেরি কাছে, প্রায় রোজ আমি
রাতের আহার করি।

ছোট ভগিনীটী- জেন তার নাম,
প্রথমে মরিয়া গেল;
পীড়িত হইয়া শয্যাগত থাকি
যাতনা পাইতেছিল।

পিতা পরমেশ করুণা করিয়া
মুক্ত করি যাতনায়-
লইলেন কোলে এই ধরা হ’তে,
আগে সেই চলে যায়।

গির্জ্জাপ্রাঙ্গণে, ওই গোর স্থানে
শুইয়া রেখেছে তারে;
জন্ ভাই মোর তাহার সহিত
ওই কবরের ধারে-

খেলা করিতাম নিদাঘ সময়ে;
-নিদাঘের শেষে যবে-
তুষারে আবৃত হইল ধরণী,-
যখন প্রথমে সবে-

শিখেছিলু আমি, তুষার উপরি
খেলিতে, যাইতে চলে,
মনে আছে মোর, জন ও তখনি
ধরা হতে গেছে চলে।

সেও ওই খানে, ওই তরুতলে
ভগিনী জেনের কাছে;
স্নিগ্ধ শীতল, গাছের ছায়ায়
নীরবে ঘুমিয়া আছে।”

বালিকার কথা শুনিয়া কহিনু
“তারাত স্বরগে এবে;
বালিকা তোমরা, কয় ভাই বোন্
হইলে এখন তবে?”

বিস্মিত হইয়া কহিল কুমারী
“কয়েছি ত মহাশয়,-
সাত জন মোরা” কহিমু “তারাতো
ধরণীর আর নয়।

দু জনেই তারা মরিয়া গিয়াছে,
স্বরগে গিয়াছে চলে;-
আত্মা তাহাদের” “সাত জন আছি”
তবুও বালিকা বলে!

যতই তাহারে বুঝাই না কেন,
বুঝিল না সে কুমারী;
দৃঢ় বিশ্বাসের নিকটে তাহার
মানিলাম আমি হারি।

ওয়ার্ড্‌স ওয়ার্থ।
৭ই আশ্বিন, ১৩০১।