(শ্রীমতী গিরীন্দ্রমোহিনী ভগিনীপ্রণীত সন্ন্যাসিনী-
ঐতিহাসিক নাট্য।)
নীরবে কাননমাঝে গাছ আলো করি,
এক বৃত্তে দুটী ফুল ফুটেছিল মরি!
তাদের সে শোভা কেহ ছিল না দেখিতে,
প্রেমেতে মগন ছিল তাহারা দুটীতে। ১।
এক দিন নিরদয় এক্টী পরাণ,
বৃত্ত হ’তে ছিন্ন করি এক্টী সে ফুল,-
লয়ে গেল নিজবাসে লইতে আঘ্রাণ,
-বারেক সে ভাবিল না আপনার ভুল! ২।
ছাড়াছাড়ি হোলো দোঁহে, পেরেছে কি তবু,
দুজনে, দুজন কথা ভুলিবারে কভু?
ঝালোরের ফুল শ্রুতি, চিতোর উদ্যানে
আসিয়া তো পেলে নাক সুখশান্তি প্রাণে। ৩।
মুছিতে হৃদয় হ’তে করিছে যতন-
সেই ফুলটীর স্মৃতি, বৃথায় বৃথায়!
ভোলা নাকি যায় কভু হৃদয়রতন?
ভুলিতে যাহারে সাধ, এবে সে কোথায়? ৪।
ওই দেখ বনে বনে হ’য়ে ব্যাকুলিত
ভ্রমিতেছে; হৃদে তার আজো জাগরিত
শ্রুতির মিলন আশা; সতৃষ্ণ নয়নে
কভু থাকে চাহিয়া চিতোর দুর্গ পানে। ৫।
ওই খানে আছে তার প্রাণের প্রতিমা,
ওই খানে আছে তার হৃদি প্রাণ মন;
এক বার যদি সেই মূর্ত্তি মধুরিমা
পড়ে চোখে তার, আহা! হবে কি এমন? ৬।
কে গিয়া বলিবে হায়! শ্রুতিরে তাহার,-
অভাগা দেখিতে শুধু চাহে এক বার।-
নিশি দিন যে মূরতি হৃদয়ে ধরিয়া
পূজিছে, কৃতার্থ হবে বারেক হেরিয়া। ৭।
বালিকা! তুমি কি দয়া করিবে রতনে?
যাবে যদি যাও তবে বোলো গিয়া তারে,-
বাল্যের সে মুখ-স্বপ্ন পড়ে নাকি মনে?
রাজরাণী হয়ে সে কি ভুলেছে তাহারে? ৮।
রতন জনমে কিন্তু ভুলিতে নারিবে,
চিরদিন সে মুরতি হৃদয়ে ধরিবে;
বারেক হেরিবে তারে, বড় সাধ চিতে,
পারে না গো এক বার সে কি দেখা দিতে? ৯।
একি গো! একি গো! শ্রুতি এমন নিঠুর
হয়েছ এখন! তবে ভুলেছ কি সবি-
সেই পুরাতন কথা! করেছ কি দূর
হৃদয় হইতে সেই সুমধুর ছবি? ১০।
ভাবিলে না এক বার তোমার বিহনে
রতন যাপিছে দিন কি দুখে, কেমনে;
রাজার মহিষী হয়ে সত্যই কি তারে
ও হৃদি উপেক্ষা এবে করিবারে পারে? ১১।
না-না-না-না! ও হৃদয় নয়তো তেমন,
ধরায় রমণীপ্রেম অতুল অজয়;
ধরমে, তা’হতে নারী দেয় উচ্চাসন,
ধরমের কাছে নত পৰিত্ৰ প্ৰণয়। ১২।
বুঝেছি বুঝেছি শ্ৰুতি! বুঝেছি তোমায়!
ভেবেছ জ্বলুক্ হৃদি কি ক্ষতি তাহায়?
ছি ছি ছি ছি! কিনিব না কলঙ্কিনী নাম,
-কলঙ্কিত করিব না এ পবিত্র ধাম। ১৩।
করিনু যতন কত ভুলিবার তরে,
সকলি হইল বৃথা; হৃদয় এ মম
হোলো না হোলো না বশ, জ্বলিছে অন্তরে
দাবানল, আবার কি ভুলিব ধরম? ১৪।
ত্যজেছেন রাণা এই অভাগিরি লাগি
এ প্রাসাদ, হয়েছেন বিষয়বিরাগী;
বিশ্বাসঘাতিনী ছি ছি! হইব আবার?
কলঙ্ক ঢালিয়া দিব সিংহাসনে তাঁর? ১৫।
মরণ এ হ’তে ভাল লক্ষ কোটী গুণে,
নাশিব এ ছার দেহ জ্বলন্ত আগুনে।
ধন্য নারী! ধন্য শ্রুতি! ধন্য ও প্রণয়!
পুরুষে পারে কি হেন বাঁধিতে হৃদয়? ১৬।
জ্বাল জ্বাল জ্বাল চিতা! আজিকে যাইবে
পবিত্র কুমারী চির আনন্দের দেশে;
আজিকে যন্ত্রণা জ্বালা সবি ফুরাইবে,
-ও কেগো! রতন নাকি? জীবনের শেষে। ১৭।
শ্রুতির,- দেখিতে এলে ও নবীন সাজ্?
স্বরগে যাইবে শ্রুতি শুভ দিন আজ্।
যাও শ্রুতি, যাও তবে এ ধরা ত্যজিয়া;
স্বর্গবাসী লবে তোমা আগু বাড়াইয়া। ১৮।
রতন! রতন! একি উন্মত্তের মত
চলিলে শ্রুতির সাথে তুমিও কোথায়?
-অথবা কি হবে রাখি ও ভীষণা হত-
প্রাণ আর,- শ্রুতি যথা যাইবে তথায়। ১৯।
ধরণীর খেলা সবি হয়ে গেল শেষ;
মিলিবে দুজনে মহামিলনের দেশ।
এক সাথে দুটী ফুল ফুটেছিল মরি!
আজিকে উভয়ে গেল এক সাথে ঝরি। ২০।
২৫শে ভাদ্র, ১৩০১।