মুমূর্ষুর কাহিনী

(১)
ওগো! তুমি কি করিবে মনে চপল বলিয়া?
দোষ, ক্ষমিও আমার;
বিপুল-আবেগ-ভরা এ প্রেমের গতি,
পারি না রোধিতে আমি আর;
আজি, নিকটে তোমার।
সে যে, গিরি-নির্ঝরিণী সম চাহে উৎসরিতে,
ভাঙি’, সরম-পাষাণ-অবরোধ;
সে যে, চাহে ছুটে গিয়ে তব চরণে লুঠিতে,
না মানে নিষেধ উপরোধ।
সে তো, চাহে না- চাহে না প্রতিশোধ।
শুধু, চাহে সে দেখাতে একবার;
মরমের কোনখান্‌টীতে
রচিয়াছে আসন তোমার!

ওগো! দাঁড়াও ক্ষণেক তুমি নিকটে আমার,
আমি আজি দিব প্রাণ খুলে;
মোর, সঞ্চিত মাণিকগুলি চরণে তোমার,
অঞ্জলি ভরিয়া দিব তুলে।
তুমি, না হয় ফেলিয়া দিও উপল ভাবিয়া;
তুমি, না হয় ফিরিয়া নাহি চেও;
তুমি, না হয় লইয়া পূজা, কঠিন পরাণে
হৃদয় দলিয়া চলে যেও।
তবু, করিও না আমার এ প্রেমে অবিশ্বাস;
নহে ইহা বিস্ময়ের কথা;
ক্ষুদ্র জবা, চেয়ে থাকে সেও রবি-মুখ;
নলিনী কি সূৰ্য্যমুখী যথা।

আজ, আনন্দ-মদিরা-ঘোরে বিবশ হৃদয়,
বুঝি, প্রাণ-গ্রন্থি পড়ে শিথিলিয়া;
আর, পারি না রাখিতে স্থির, তনু আপনার;
ধীরে, নেত্রপক্ষ্ম আসে নিমীলিয়া।
চিরদিন যেই সাধ পুষেছিদু মনে মনে,
আজি পূর্ণ সে সাধ আমার!
কৃতার্থ জীবন; এবে সুখে উত্তরিব;
সম্মুখীন মৃত্যু-পারাবার

(২)
তবে, শোন গো! প্রথম আজি কাহিনী আমার,
আজি, জীবনের মোর শেষ দিনে;
তবে, জনমের মত আজি প্রাণের রাগিণী
শেষ, ধ্বনিয়া উঠুক মনোবীণে!

“ছিল না তখন পরিচয় বেশি,
জানিতাম নাকো নাম;
শুধু সুকরুণ সুর একখানি,
শুধু প্রাণভরা ছুটী গীতবাণী,
পরশিয়া ছিল প্রাণ।

“সেই গীতরবে মোর ধ্বনিয়া উঠিত হিয়া!
দেখিতাম কি যে ছবি সেই সুরমাঝে গিয়া।
সুশুভ্র মু’খানি-মাঝে আয়ত নয়ন দুটী,
কি করুণা-মাখা সে যে মানসে উঠিত ফুটি’!
শৈশবের খেলাঘরে, সে অস্ফুট পরিচয়,
আজিও হৃদয়-গ্রন্থে লেখা আছে সমুদয়।

“তার পর নব জীবনে জাগিনু;
দেখিলাম চারিভিত-
আলো আর বাঁশী হাসি আর গানে
ফুলে ফুলে পূরণিত!
নিমেষের তরে হ’নু দিশাহারা;
নয়নে লাগিল ঘোর!
নিমেষের তরে বাঁধিষ্ণু পরাণে-
সে এক ভুলের ডোর!
মেঘের আড়ালে নিমেষের তরে
লুকায় যে শশধর,
তটিনীর বুক করিতে কেবল
দ্বিগুণ উজ্জ্বলতর।

“ভেঙে গেল ভুল, দেখিনু চাহিয়া মরম-মন্দির-মাঝে
অতুল প্রভায় উজলিয়া দিক্, এ কোন্ দেবতা রাজে!
অরুণের মত বরণ তাহার, কিরণ-কিরীট মাথে’,
সারা নিখিলের হিয়া দিয়া গড়া, মায়া-বীণাখানি হাতে।
তার সে মোহিনী রাগিণীর সুরে, চিনিনু নূতন ক’রে,
আমারি সে প্রিয় চির পুরাতনে, আমারি সে মনচোরে!

“তার পর গেছে কাটি’ এ জীবন,
পূজায় সে দেবতার;
ছিলনাকো কিছু সুখ সাধ আশা
বাহিরেতে তার আর!
স্বপনের দেশে করিতাম বাস,
কল্পনা সহচরী;-
মায়াবলে কত নূতন জগৎ
তুলিতাম গড়ি’ গড়ি’!-
তোমারে সে নব জগতের মাঝে
করিতাম রাণী, সুখে;-
রাজকররূপে সরবস্ব মম,
সঁপিতাম পদযুগে!

তুমি আর আমি, আর কেহ নাই
সে জগৎ-মাঝখানে:
দুই নিয়ে এক হ’ত চরাচর;
কি মিলন প্রাণে প্রাণে!
কত শত বেশে সাজাতাম তোমা’,
মনের মতন করি’;
নিমেষে নিমেষে নব নব রূপ;
হেরিতাম প্রাণ ভরি’!
কত মধুময় অভিনয়, আমি
করিতাম তব সাথে;-
সে সব কাহিনী মনে হ’লে, আজো
জল আসে আঁখিপাতে!
হায় গো!
সে সব, ভাষায় কখনো
প্রকাশ কি হ’তে পারে?
ভাবের নিকটে এইখানে ভাষা
হার মানে একেবারে!
* * * *
“এই শুধু বড় সাধ ছিল মনে, চেয়েছিলু বর আমি,
‘জান তুমি সব প্রভু ভগবান! ওহে অন্তর্যামি!
জীবন মরণ ঢালা এ আমার পূজা, প্রেম-দেবতার,
বৃথায় কেবলি নাহি হয় যদি, এই দিও ফল তার,
মরণের কোলে ঘুমাবার আগে, সে যেন জানিতে পারে,
নিখিলের মাঝে সব চেয়ে বড়, দেখেছিনু আমি তারে।

“আর বেশি কথা নাই বলিবার,
সময়ো ফুরায়ে এল;
শুধু একবার সুধাই তোমারে,
বল দেবি! বল, বল,
সাধের সে মম মনোময় পূজা, প্রাণময় উপহার,
স্বপনেও কি গো! আসে নাই কভু অনুভবে দেবতার?”

১৩০৩।