নিদাঘ-মধ্যাহ্নে চাতক পক্ষী

(১)
প্রচণ্ড নিদাঘ দ্বিপ্রহর!
রবি-রশ্মি জ্বালাময়,
অবিষহা অতিশয়,
তপ্ত দেহ, তাপিত অন্তর!
আকাশ-নীলিমা হায়!
পুড়িয়া অঙ্গার প্রায়,
চাহিলে ঝলসি’ যায় চোখ!
অনলের কণা-সম
বহিতেছে সমীরণ,
পথে ঘাটে নাহি আর লোক ।
অদূর সরসী-নীরে
আগ্রীব ডুবায়ে ধীরে
ভাসি’ ভাসি’ চলিছে মরাল;
তীর-তরুরাজি-শাখে
নানা পাখী ঝাঁকে ঝাঁকে
বসিয়া পাতার অন্তরাল।
তরুতল-সুখ-ছায়
আরামেতে নিদ্রা যায়,
রাখাল বালক হেথা হোথা;
ক্বচিৎ বাজায় কেহ
(অতন্দ্ৰিত মন, দেহ,)
মেঠো সুর বাঁশরীতে কোথা!
ত্যজি শ্যাম শল্প নব
গো, মেষ, মহিষ সব
খুঁজি ফিরে সুশীতল স্থান;
সরসীর স্বচ্ছ জলে
তৃষাকুল দলে দলে
কোথাও বা করে স্নান পান ।

এ নিদাঘ-দ্বিপ্রহরে
কেহ আর নাহি করে
দ্বিতীয় কামনা শান্তি বিনা;
নাহি কোনো কাজ আর,
জীব জন্তু সবাকার,
সৃষ্টি যেন প্রাণশক্তি-হীনা!

(২)
সহসা এ কার স্বর
ভেদিয়া মরম-স্তর
আকুল করিয়া দিল প্রাণ?
“ফটিক্ ফটিক্ জল”
সুকরুণ সুকোমল
আকাশ হইতে নামে গান!
করপুট-ছায়ে ঢাকি’
দেখি চেয়ে তুলি আঁখি,
ক্ষুদ্রকায় চাতকের দল,
তুচ্ছ করি তীব্রতর
বিষম সে রবি-কর,
যাচে, নভ-কাছে মেঘ-জল।

কঠোর সাধনা তার
হেরি লাগে চমৎকার,
অবাক্ হইয়া চেয়ে রই
ভাবি মনে “হায় পাখি!
“তোর তৃষা মেটে না কি
“আকাশের বারি-বিন্দু বই?
“জনমি ধরার ক্রোড়ে,
“পাখী রে! কেমন ক’রে
“ধরার সলিলে হ’ল ঘৃণা?
“পুড়িয়া মরিবি, তবু
“পান করিবি না কভু
“জলদের বৃষ্টি-বারি বিনা?
“একি এ ভীষণ ঘোর,
“হায় রে প্রতিজ্ঞা তোর!
“বল্ পাখি! বল্ শুনি, খুলে;
“কেন বিধি এ কামনা,
“একাগ্রতা, এ সাধনা,
“দিলা ওই ক্ষুদ্র প্রাণ-মূলে?”

ভাবিতে ভাবিতে কথা,
হইলাম নিদ্রাগতা,
খোলা বাতায়ন-পাশে শুয়ে;
মনোরম সুশীতল
ছায়াময় গৃহতল,
বাহুর উপরে মাথা থুয়ে।

(৩)
স্বপনে উঠিনু জাগি’,
একটী চাতক পাখী
বাতায়নে বসিল আসিয়া;
সম্ভাষি মানব হেন,
শুনিনু, কহিল যেন,
“কহি তবে শোন মন দিয়া।
“বিহঙ্গের বেশ ধরি
“ঈশ্বরের অনুচরী,
“মোরা সবে জনমি মরতে;
“দেখায়ে দৃষ্টান্ত স্বীয়,
“পারি যদি একটীও
“মানবের হৃদয়-পরতে,-
“জাগাতে ঈশ্বর-প্রীতি,
“বিশ্বাস, মঙ্গল, নীতি,
“নীচ সংসারের ধূলি হ’তে;
“তাঁহার চরণামৃত-
“পানে লালায়িত চিত
“লইয়া যাইতে ঊর্দ্ধপথে!

“একাগ্র সাধন-বলে
“কি অসাধ্য ভূমগুলে?
“হের! চেয়ে দেখ! নভোপানে;
“নিবিড় জলদ-মালা
“আচ্ছাদি’ তপন-জ্বালা,
“আনন্দ সঞ্চার করে প্রাণে!”

এতেক বলিয়া পাখী
“ফটি-ইক্ জল” ডাকি’,
উড়িল ক্ষুদ্র সে পক্ষপুটে;

গভীর মেঘের স্বরে,
বরিষার ঝর-ঝরে,
চকিতে স্বপন গেল টুটে!

১৩০৪। শ্রাবণ।